যশজি, কুর্নিশ!
ইংরেজিতে swan song বলে যে কথাটা আছে, যার মানে মৃত্যুর বা রিটায়ারমেন্টের আগে করে যাওয়া শেয কাজ, অধুনা ভারতীয় ছবিতে তার একটি উত্তুঙ্গ নিদর্শন এই ছবি। ঠিক কতখানি ক্রিটিকের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে লেখা যায় তা বলা মুশকিল, তবে প্রয়াত পরিচালক যশ চোপড়ার নাম এ ছবির সঙ্গে যেভাবে অঙ্গাঙ্গী জড়িয়ে গেল তাতে, পরিচ্ছন্ন ভাষায় এ ছবি ভারতীয় ছবির একশো বছরে একটা ল্যান্ডমার্ক হবে যশজির সোয়ান সং হিসেবেই।
শর্মিলা মাইতি
রেটিং- নিষ্প্রয়োজন
ইংরেজিতে swan song বলে যে কথাটা আছে, যার মানে মৃত্যুর বা রিটায়ারমেন্টের আগে করে যাওয়া শেয কাজ, অধুনা ভারতীয় ছবিতে তার একটি উত্তুঙ্গ নিদর্শন এই ছবি। ঠিক কতখানি ক্রিটিকের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে লেখা যায় তা বলা মুশকিল, তবে প্রয়াত পরিচালক যশ চোপড়ার নাম এ ছবির সঙ্গে যেভাবে অঙ্গাঙ্গী জড়িয়ে গেল তাতে, পরিচ্ছন্ন ভাষায় এ ছবি ভারতীয় ছবির একশো বছরে একটা ল্যান্ডমার্ক হবে যশজির সোয়ান সং হিসেবেই। আক্ষরিক অর্থেই মুম্বইয়ের ছবির জগতকে যশখ্যাতির উচ্চতম সিংহাসনে বসানোর কৃতিত্ব তাঁরই। স্টারমেকার যশ চোপড়া। বলিউডকে যিনি বাদশা আর শাহেনশা উপহার দিয়েছিলেন শুধু নয়, বিশ্বের কাছে বলিউড-কে প্যাকেজ হিসেবে উপস্থাপন করেছিলেন যে মহান ব্যক্তিত্ব। তিনিই যশ চোপড়া।
শুরুতেই লিখলাম রেটিং নিষ্প্রয়োজন। কারণ এ ছবির নামকরণ থেকে শুরু করে এন্ড স্ক্রোল অবধি এমন জমাট দুঃখের ধোঁয়া-বাষ্প মিশে আছে, যা ভেদ করে রেটিং করা আমার মতো আনাড়ি ক্রিটিকের পক্ষে অসম্ভব। ভালমন্দের নিক্তিমাপের চেয়ে বরং অন্য একটা দিক চেয়ে চেয়ে দেখতে ইচ্ছে করে। ভ্যানগঘের ছবি যেমন চলমান কোনও সময়ের মাঝামাঝি এসে দাঁড়িয়ে থাকে, ঠিক তেমনি বলিউড ছবির অতীত আর বর্তমানের মাঝখানে জায়গা করে নিল যব তক হ্যায় জান। মিসিং লিঙ্ক। সময় থমকে গেল। চলে গেল একটি গোটা জীবন।
এ ছবির শুটিং-এর সময়ে কোনও অজানা কারণে ওয়ার্কিং টাইটেল ব্যবহার করা হয়নি। মাঝে মাঝে খবর আসত, লন্ডনে শুটিং চলছে যশ চোপড়ার ছবির। শাহরুখের বিপরীতে ক্যাটরিনা। সঙ্গে অনুষ্কাও আছেন। পরে জানা গেল লাদাখেও শুটিং চলছে। তবে সবচেয়ে নাড়া দেওয়া ঘটনাটা ছিল, যশ চোপড়ার আনুষ্ঠানিক ঘোযণা। মিডিয়ার সামনে তিনি বলেছিলেন, এটাই তাঁর শেয ছবি। আজকাল বলিউডে প্রিরিলিজ ক্যাম্পেনের অনেক কায়দা থাকে। গোদা অর্থে গিমিক। যেভাবে পারো প্রথম হপ্তায় হলে লোক ঢুকিয়ে দাও। ছোট বাজেটের ছবির গলা টিপে ধরে মাল্টিপ্লেক্সের সবকটা শো কিনে নাও। নায়িকার সঙ্গে পরিচালক/প্রযোজক/নায়কের কেচ্ছার বাতাসা ছোঁড়ো। শেষ তুকতাকের জন্য সব পরিচালকই কিছু না কিছু করে থাকেন যেটার ওপর হিট-ফ্লপের আল্টিমেট ফাটকা হিসেব দাঁড়িয়ে থাকে। সেই প্রেস কনফারেন্সে যশজির ইন্টারভিউ নিয়েছিলেন শাহরুখ খান। সারা ভারতের মিডিয়া হাউসের কাছে পৌছে গিয়েছিল তার ডিভিডি। টেলিকাস্টের জন্য অবশ্যই।
নাঃ, কোনও গিমিক নয়। এই ইন্ডাস্ট্রিতে সামান্য এক অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর হয়ে ঢুকে ধীরে ধীরে সূর্যের মতো সবার উপরে চলে গিয়েছিলেন যিনি, সেই যশ রাজ ফিল্মস সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা যশজির এটাই ছিল শেষ ছবি। কেরিয়ার জীবনের শেষ শ্বাসবায়ু কৌটো করে রেখে দিলেন যে ছবির মধ্যে তার নামই জব তক হ্যায় জান। একনিষ্ঠ পরিশ্রম। এবং মাথা উঁচু করে সিংহাসন ছেড়ে নেমে আসা। বলিউডের প্লেব্যাক মিউজিক যাঁর অপরিসীম পৃষ্ঠপোষকতায় টাইমলেস খেতাব পেয়েছে। রোম্যান্সের বিবর্তন অনায়াসে যিনি ধরে আনতে পারতেন পর্দায়। সময়ের সঙ্গেসঙ্গে প্রেমের অদলবদল যিনি প্রায় আতসকাঁচ দিয়ে দেখতে পেতেন। বলুন তো বিশ্বের সব টেকনিক, শ্রেষ্ঠ তারকা, দক্ষতম অভিনেতা দিয়েও বানানো যাবে আরও একটা সিলসিলা কিংবা লমহে?
সবচেয়ে বড় কথা, ছবি ছেড়ে যাওয়া আর পৃথিবী ছেড়ে যাওয়া এমন একাসনে বসে গেল কীভাবে? কত মহান মনের মানুষ বুঝতে পারেন কবে সব কিছু ছেড়ে দিয়ে চলে যেতে হবে মহাপ্রস্থানের পথে? জীবনের শেষ দিনটিও কেমন জেনে গিয়েছিলেন যশ। জানিয়ে দিয়েছিলেন সবাইকে। জ্যোতিষী না হয়েও..
যেদিন ছবি মুক্তি পেল, স্রষ্টা তখন পরপারে। সৃষ্টি তখন সোনার তরীতে উঠেছে। এক হপ্তার মধ্যেই একশ কোটির লক্ষণরেখা ছাড়িয়েছে। উফফ.. শাহরুখ! কী খেয়েছেন? কী মেখেছেন? পাশে দু দু জন ডাকসাইটে সুন্দরী.. হ য ব র ল-র বুড়োর মতো বলতে ইচ্ছে করে বয়স বাড়তির দিকে না কমতি?
পাঠক, এতদিনে আপনাদের সবারই বোধকরি দেখা হয়ে গিয়েছে জব তক হ্যায় জান। যাঁরা এখনও দেখেননি, তাঁরা নিশ্চয়ই যাঁরা দেখেছেন গল্পটা তাঁদের কাছ থেকে শুনে নিয়েছেন। কাজেই, সাহসে ভর করে গল্পটা তুলে রাখলাম। বিশ্লেষণটাও। আমি অন্তত একটি মানুষও খুঁজে পাইনি যাঁরা জব তক হ্যায় জান-এর গল্পটা জানেন না। কিংবা দেখার জন্য ছটফট করছেন না। সম্ভবত, এটা বলিউড ছবির ইতিহাসে রেকর্ড। শোলে, থ্রি ইডিয়টস কিংবা হাল আমলের একশো কোটির দৌড়ে সামিল যে কোনও ছবিও দর্শকের কাছ থেকে এমন প্রত্যাশার সম্মান পায়নি।