Mahatma Gandhi: দেশ এগোচ্ছে; বাপু, তুমি তফাত যাও!
অনেকটা সরে গিয়ে আমরা মহাত্মা গান্ধীকে স্রেফ আদর্শ খাঁড়া করেছি। ফলে দূরে সরতে পেরেছি।
সৌমিত্র সেন
আমরা তাঁকে 'জাতির জনক' করেছি, আমরা তাঁকে সিংহাসন দিয়েছি, শ্রদ্ধা দিয়েছি, প্রোটোকল দিয়েছি; আমরা তাঁকে অনুসরণ করিনি, গ্রহণ করিনি, লক্ষ্যও করিনি। কেন করিনি, এ কথার উত্তরে এক কথায় বলে দেওয়া যায় যে, পেরে উঠিনি। মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী তো আমাদের কাছে মানুষ নন, মানুষিক অবয়বে ওই 'মনুষ্যত্ব' তো সম্ভবই নয়। তাই অনেকটা সরে গিয়ে আমরা মহাত্মা গান্ধীকে স্রেফ আদর্শ খাঁড়া করেছি। ফলে দূরে সরতে পেরেছি। দূর থেকে নমস্কার করে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে পেরেছি, পারছি, পারবও।
অন্য কারণও আছে। আমরা আসলে (গান্ধীর চেয়ে) মাপে অনেকটা কম পড়ে গিয়েছি। গান্ধী আমাদের পক্ষে বড্ড অলৌকিক রকমের বড়। বেখাপ্পা। ওঁকে ভালো করে বোঝা কঠিন। জানা দুর্বোধ্য। বামন হয়ে চাঁদে হাত দিতে গেলে যা হয় আর কী! দৃশ্যতই বিষয়টা হাস্যকর হয়ে দাঁড়ায়। আমরা হাসিকে গাম্ভীর্য দিয়ে ঢেকে দেওয়ার চেষ্টা করি। সেই গাম্ভীর্যের আবেশেই আমরা যথাবিহিত গান্ধী-পুজো সারি। সেই পুজোর আবহে অনেক খুঁটিনাটি সঙ্কট চাপা পড়ে যায়। গেছেও।
অথচ, কী আশ্চর্য! সঙ্কট চাপা না-দেওয়ার জীবনই গান্ধীর ছিল। নিত্য-নিয়ত নিজেকে নেড়েচেড়ে দেখার এক অসমসাহসী সাধনা ছিল তাঁর। একটা পবিত্র আত্ম-কেন্দ্রিকতা ছিল। তাই 'আত্ম'কে কাটাছেঁড়াও করতেন। এই ব্যবচ্ছেদ-কর্মে গতকাল যেটাকে সত্য বলে মনে করেছেন, আগামীকাল যদি বুঝতেন, তার চেয়েও উন্নততর সত্য কিছু আছে, তবে আগের সত্য থেকে পরের সত্যে যেতে দ্বিধা করতেন না। সেই সত্যের তাড়নাই তাঁকে দিয়ে নানা অসাধ্য করিয়েছে জীবনভর। সেই সত্যই তাঁকে দিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকার রেল স্টেশনে রাত জাগিয়ে রাখে, সেই সত্যই তাঁকে দিয়ে নোয়াখালি-বিহারের দাঙ্গাবিধ্বস্ত পথে পথে ঘুরিয়ে নিয়ে যায়। চিরদিনের ঈশ্বরবিশ্বাসী গান্ধীর কাছে তো 'ঈশ্বরই সত্য' নয়, বরং 'সত্যই ঈশ্বর'!
এই সাধনপথে তাই তিনি একটা ভিন্ন মাত্রা যোগ করে দেন। টু-ডায়মেনশন থেকে সেটা থ্রি-ডায়মেনশনে উত্তীর্ণ হয়। তখন তাঁর ওই থ্রি-ডায়মেনশনাল জীবন-নিরীক্ষাকে বোঝা আরও দুঃসহ হয়ে দাঁড়ায়। কেননা, ওই ভিন্ন মাত্রাটা হল 'আত্মার আইন'। যে-আইন তাঁকে তাঁর সব ধরনের প্রশ্নের দ্বিধার জড়তার দ্বন্দ্বের উত্তর দেয়।
বলাই বাহুল্য সেই উত্তর আমাদের সঙ্গে মেলে না। তাই গান্ধী ক্রমশ আমাদের পিছনে সরে যান। যদিও তাতে তাঁর কোনও ক্ষতি হয় না। আমরাই তথৈবচ অবস্থায় পড়ে থকি। আর এই পড়ে-থাকার কম মূল্য আমাদের দিতে হয় না, দিতে হচ্ছে না! আমাদের পাড়ায়-পাড়ায় হিংসা, অথচ, গান্ধী আমাদে অহিংসা শেখাতে চেয়েছিলেন। আমাদের জনপদে-জনপদে সাম্প্রদায়িকতা, অথচ, গান্ধী আজীবন আমাদের সম্প্রদায়নির্বিশেষে ঐক্য চেয়েছিলেন। আমাদের রাজনীতিতে-রাজনীতিতে মিথ্যা, অথচ গান্ধী আমাদের সত্যের পথে টেনে নিতে চেয়েছিলেন। আমাদের ধর্মে-কর্মে অস্পৃশ্যতা, অথচ, তিনি দেশ থেকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করতে চেয়েছিলেন সব ধরনের ছুঁতমার্গ। আমাদের কথায়-কাজে দ্বিচারিতা, অথচ, গান্ধী আমাদের মন-মুখ এক করার আদর্শ শেখাতে চেয়েছিলেন। আমাদের চিন্তায়-ভাবনায় অশেষ পরাধীনতা, অথচ, তিনি আমাদের জন্য সর্বাঙ্গীন স্বাধীনতাই চেয়েছিলেন!
শুধুই স্বাধীনতা অবশ্য চাননি। আরও কয়েক পা এগিয়ে তিনি আমাদের জন্য মুক্তি চেয়েছিলেন। রাজনৈতিক স্বাধীনতা তো বোঝা গেল, কিন্তু মুক্তি? সেটা আবার কী?
হ্যাঁ, ওটাই আসলে গান্ধীয়ানা। ওটাই গান্ধীর 'আত্মার আইন' প্রকল্প। সত্যধর্মে মথিত এমন এক নির্মোহ সংযত অহিংস মহাপৃথিবী গান্ধী চেয়েছিলেন মানুষের জন্য, যেখানে রাজনীতির বোলচাল কূটকচালিকে বহু দূরে ঠেলে দিয়ে আরও গাঢ় কোনও আনন্দের দিকে হেঁটে যাওয়ার নিভৃত আশ্বাস ছিল। তখন 'কংগ্রেসি গান্ধী' 'স্বাধীনতা আন্দোলনকারী গান্ধী' 'সত্যাগ্রহী গান্ধী' 'শহিদ গান্ধী'--এসব পরিচয় খাটো হয়ে যায়। বড় যে-চেহারা বেরিয়ে আসে, তাতে ভয় পেয়ে যাই আমরা।
অথচ, গান্ধীর জীবনব্যাপী সাধনার মধ্যে এই 'ভয়'কে জয় করার প্রকল্পটাও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। ভয়কে ভয় পেতেন গান্ধী। নির্ভীক হওয়াই তাঁর দীক্ষা। যেখানেই ভয়ের কৃষিকাজ সেখানেই অভয়ের কীটনাশক নিয়ে তিনি হাজির হতেন। তাই তো তিনি জীবনভর ঘোরতর একলা। একলা গান্ধী লাঠি হাতে বিহার-নোয়াখালির দাঙ্গারক্তপিচ্ছিল পথে অভয়ের উপস্থিতি নিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন-- এর চেয়ে মর্মস্পর্শী ছবি মানবেতিহাসে কখনও তৈরি হয়েছে?
হ্যাঁ, হয়েছে! গান্ধীই তৈরি করেছেন। যে-সময়ে দাঁড়িয়ে তিনি বলেছিলেন-- পরের জন্মে তিনি 'হরিজন' হয়ে জন্মাতে চান, তখনও দেশের সামাজিক প্রেক্ষাপটের নিরিখে অভয়দনের মর্মছোঁয়া একই রকম এক খাপছাড়া ছবি তৈরি হয়েছে। কেননা, কোটি কোটি পদদলিত নিপীড়িত বঞ্চিত প্রতারিত অত্যাচারিত শাসিত প্রবঞ্চিত দলিতের হয়ে তিনি 'ভদ্রসমাজ' থেকে গলা তুলছিলেন। আজীবন ধর্মপ্রাণ শাস্ত্রনিষ্ঠ গান্ধীকেও কিন্তু এই গান্ধী হারিয়ে দিয়েছেন।
১৯২৭ সাল। দক্ষিণ ভারতে ঘুরছেন গান্ধী। এক ব্রাহ্মণ পণ্ডিত দেখা করতে এলেন গান্ধীর সঙ্গে। তিনি আবার অস্পৃশ্যতায় বিশ্বাসী। তিনি পরাশর-স্মৃতি থেকে শ্লোক তুলে গান্ধীকে বোঝাবার চেষ্টা করলেন, হিন্দু ধর্মে অস্পৃশ্যতা ছিল এবং থাকাই উচিত। গান্ধী তাঁকে বলে দিলেন-- 'তোমার শাস্ত্র ফেলে দাও। অস্পৃশ্যতা একটা ব্যাধি। হিন্দুধর্মে ওটা থাকবে না।'
প্রতিস্পর্ধী। কিন্তু 'আউট অফ দ্য ব্লু' নন তিনি। সিস্টেমের ভিতরে থেকেই সিস্টেমকে একটু-একটু করে বদলানোর চেষ্টায় ছিলেন। তাই তাঁর মনে অ-সাধকসুলভ 'পাপবোধ'ও ছিল। কিন্তু পাপবোধশূন্য এক জীবনচর্যাই তাঁর অন্বিষ্ট ছিল। তাই তিনি পাপগুলিকে চিনতন। পাপগুলি সরাতেন, আর এগিয়ে যেতেন। তাই তাঁকে ধরা খুব মুশকিল হয়ে পড়ে।
আরও পড়ুন: Jammu and Kashmir: এনকাউন্টারে নিহত JeM কমান্ডার Zahid Wani সহ ৫ সন্ত্রাসবাদী