'সেনাদের হাতে মরার চেয়ে সমুদ্রের ঝাঁপ দেওয়া ভাল'
খড় কুটোর মতো প্ল্যাস্টিক ড্রামের উপর ভেসে শাহ পরীর দ্বীপে আসছেন তাঁরা। নবি বলে, "মৃত্যুর ভয় আমাকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। সমুদ্রে যেদিন ঝাঁপালাম, সেদিনই মনে হয়েছিল ওটাই আমার শেষ দিন।"
সংবাদ সংস্থা: শাহ পরীর দ্বীপ এখন রোহিঙ্গাদের বাঁচার সৈকত। মায়ানমারের মুংদাও থেকে এক ঝাঁপে প্রায় ৪ কিলোমিটার সাঁতরে শরীরটাকে যদি শাহ পরীর দ্বীপে নিয়ে এসে ফেলতে পারা যায়- ব্যস! এ বারের মতো রক্ষে। মায়ানমার থেকে আসা বহু রোহিঙ্গার মতো নবি হুসেনও সেই ভরসাতেই ঝাঁপ দিয়েছিল অথৈ জলে। সাঁতার যে জানে না সে কথা হয়ত নবির খেয়ালও ছিল না। আগে তো বাঁচতে হবে। বছর তেরোর নবির কথায়, "ওখানেই মরতাম। আর ঝাঁপ দিয়ে মরলে বা ক্ষতি কী!"
আরও পড়ুন- সংবাদের মাঝে হঠাৎ ‘সেক্স নয়েজ’, তারপর.. দেখুন ভিডিও
নবি একা নয়, তাঁর মতো লক্ষ লক্ষ মানুষ এখন প্রাণ বাঁচাতে সাঁতরে বাংলাদেশে পাড়ি দিচ্ছেন। খড় কুটোর মতো প্ল্যাস্টিক ড্রামের উপর ভেসে শাহ পরীর দ্বীপে আসছেন তাঁরা। নবি বলে, "মৃত্যুর ভয় আমাকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। সমুদ্রে যেদিন ঝাঁপালাম, সেদিনই মনে হয়েছিল ওটাই আমার শেষ দিন।" আর এক রোহিঙ্গা কমল হুসেনেরও অভিজ্ঞতা একইরমক। তেলের ড্রাম বুকে বেঁধে সে ও সমুদ্রে ঝাঁপ দিয়েছিল। "নানা সমস্যায় দিন কাটছিল। ভাবলাম জলে ঝাঁপ মারাটাই বেটার অপশন হবে আমাদের। তাছাড়া আমাদের অত টাকা কোথায়, যে বোটে করে যাব?"
বৌদ্ধ প্রধান মায়ানমারের রাখাইন প্রদেশে কয়েক দশক ধরে বাস মুসলিম রোহিঙ্গাদের। অভিযোগ, মায়ানমারের সেনাদের অত্যাচারে তাদের ঘর ছাড়তে হচ্ছে। পুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে তাদের ঘরবাড়ি। খুন, ধর্ষণ কোনও অভিযোগই বাদ নেই সান সু কি সরকারের বিরুদ্ধে। মানবতার দিক বিচার করে শরণার্থী রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিচ্ছে বাংলাদেশ। যদিও চাপে পড়ে মায়ানমারের বিদেশমন্ত্রক জানিয়েছে, উপযুক্ত প্রমাণপত্র দেখালে দেশে ঢুকতে পারবেন রোহিঙ্গারা। কিন্তু উপযুক্ত প্রমাণ পাবে কোথায়? নবি যখন দেশ ছেড়েছিল, তখন তাঁর ঘর বলতে ছিল পোড়া কাঠ আর ভাঙা ইটের স্তুপ। সেখানেই যেনতেন প্রকারে মায়ের সঙ্গে দিন গুজরান করছিল সে। কারণ গ্রামের পর গ্রাম পুড়িয়ে দিয়ে শশ্মান বানিয়ে ফেলেছে মায়ানমার সেনারা, অভিযোগ নবির। মায়ের কথা উঠতেই চোখ ছলছলিয়ে ওঠে ছেলের। নবি বলে, "মা আমাকে ছাড়তে চায়নি। দু'মাস আগে দাদা বাংলাদেশ চলে এসেছিল। আমি ওখানে একা গিয়ে কী করব, সে কথাই চিন্তা করতেন মা।" নবি আরও জানায়, ২০ জনের একটি দল বাংলাদেশ যাচ্ছিল, তাদের সঙ্গেই সে চলে আসে। তার কথায়, "পিছন ফিরে মায়ের দিকে আর তাকাইনি।"
আরও পড়ুন- বৃহস্পতি-শুক্রের বিবাদ মিটল? একসঙ্গে তাদের দেখে প্রশ্ন সোশ্যাল মিডিয়ার
সেপ্টেম্বরে মায়ানমারের সেনাদের ‘অকথ্য অত্যাচারে’র বিরুদ্ধে রোহিঙ্গারা ‘প্রতিরোধ’ শুরু করেছিল। এর ফলে সে দেশের সেনারা আরও ‘হিংস্র’ হয়ে ওঠে। ঘর থেকে বার করে পুরুষদের হত্যা করে, মেয়েদের ধর্ষণ করে, সম্পত্তি লুঠ করে ঘর পুড়িয়ে দেয় তারা, অভিযোগ এমনটাই। এই সব স্মৃতিচারণা করতে করতে নবি হুসেন জানায়, "আর হয়ত কখনও ঘরে ফেরা হবে না"। হাজার হাজার রোহিঙ্গাদের ভিড়ে সে এখন সম্পূর্ণ একা।
শাহ পরীর দ্বীপে যখন বেলা পড়ে আসে, সমুদ্রতটে দাঁড়িয়ে তার ফেলা আসা দেশের দিকে তাকিয়ে থাকে সে। নিজের দেশ, ঘর এবং মায়ের উদ্দেশে নবির একটাই কথা, "দেশে শান্তি চাই। আমি মাকে ফিরে পেতে চাই।"
(তথ্য সূত্র- এপি)