সাবধান! আপনি কিন্তু নজরদারি ক্যামেরার আওতায়!
ফিল্টারে এমন ব্যালান্স থাকবে, যাতে স্রষ্টার মনের সততা ও স্বচ্ছতারও উদ্বোধন হবে, আবার শাসকের শক্তিও স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠবে না।
সৌমিত্র সেন
স্বাধীনতা তুমি কার?
স্বাধীনতা কখনও শাসকের কখনও শাসিতের।
শাসিতের স্বাধীনতা বোঝা সহজ। নিজের মনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে যা কিছু সে করতে পারে, তাতেই তার স্বাধীনতা অনুশীলিত হয়। এ না হলেই সে পরাধীন। এবং সে-পরাধীনতার মাত্রা স্থূল-সূক্ষ্ণ দু'রকমেরই হয়।
কিন্তু শাসকের স্বাধীনতা?
শাসক যখন শাসিতের ভূত-ভবিষ্যৎ-বর্তমান সব কিছুর ওপরই নজরদারি চালাতে পারে, তখনই তার স্বাধীনতা ব্যক্ত হয়। এবং, বলাই বাহুল্য, এই স্বাধীনতা মূলতই সূক্ষ্ণ।
মুশকিল হল, দু'পক্ষের স্বাধীনতা কখনও এক সঙ্গে সম্পাদিত হতে পারে না। এখানে একটা অক্ষ-কোটি ভেদাভেদ আছে।
সেই ভেদাভেদটাই আরও একবার সামনে চলে এল। কেননা, জানা গেল, নেটফ্লিক্স থেকে নিউজ, সবটাই এবার নজরে রাখবে তথ্য সম্প্রচার মন্ত্রক। অর্থাৎ, এখন থেকে গোটা ডিজিটাল মিডিয়া কেন্দ্রীয় তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রকের অধীনস্থ হল। আইন সংশোধন করে আজ এই মর্মে বিজ্ঞপ্তিও জারি করেছে কেন্দ্র। এর ফলে সমস্ত অনলাইন খবরের সাইট, ওটিটি (ওটিটি হল 'ওভার দ্য টপ', গ্রাহকের সম্মতি-নিরপেক্ষভাবে ইন্টারনেট প্ল্যাটফর্মে যে সিনেমা বা টিভি কনটেন্ট প্রকাশিত হয়) প্ল্যাটফর্ম এবার থেকে কেন্দ্রীয় তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রকের আওতায় এল।
প্রসঙ্গত, বহু সময়েই অনলাইনে বহু 'আপত্তিকর' খবর প্রকাশ করার অভিযোগ উঠেছে। নেটফ্লিক্সের মতো ওটিটি প্ল্যাটফর্মগুলিতে যৌনতায় ভরপুর ভিডিয়ো কনটেন্ট প্রকাশ করার অভিযোগ উঠেছে। এই গোটা বিষয়টিই এবার থেকে কেন্দ্রীয় তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রকের আওতায় আসায় ফেক নিউজ ও যৌনতায় ভরপুর কনটেন্ট আটকানো সহজ হবে বলে মনে করছে ওয়াকিবহাল মহল।
খুব ভাল কথা। অপসংস্কৃতি যদি রোধ করা যায়, তার চেয়ে ভাল আর কী হতে পারে! চিরন্তন ভারতীয় সংস্কৃতির সুস্থ শাশ্বত আবহে কেন থাকবে সেক্স-ভায়োলেন্সের আমিষগন্ধ? যে-দেশ বরাবর আত্মিক শুদ্ধতার কথা বলে এসেছে, অবদমিত যৌনতার মোড় ঘুরিয়ে দেওয়ার রাস্তা বাতলেছে, ইন্দ্রিয়নিগ্রহের কথা বলেছে, সেই দেশের আকাশে-বাতাসে কেন ভেসে বেড়াবে ক্রোধরিপু ও শৃঙ্গাররসের জলীয়বাষ্প?
কিন্তু তবু কিছু কথা থেকে যায়।
যদি ধরেও নিই, এই করেছ ভাল হল, তা হলেই-বা তা কেমন তীব্র দহনের ভাল? ইতিমধ্যেই তো কোনও কোনও চিত্রপরিচালক সিনেমার দৃশ্যায়নে ধূমপান বা মদ্যপান থাকলে তার সূত্রে 'স্ট্যাটিউটরি ওয়ার্নিং' দেওয়ার ঘোর বিরোধী। এই বিধিনিষেধ মানতেই যাঁদের আপত্তি, তাঁরা 'ইন্টারনেট প্ল্যাটফর্মে' কোন কনটেন্ট নিয়ে কাজ করে আত্ম-মুক্তির স্বাদ পাবেন, যেখানে নজরদারি চালিয়ে শাসকও খুশি মনে সেটিকে ছাড়পত্র দেবে?
আদৌ দেবে? দেওয়ার আবহ কি থাকবে? না হলে সর্বখর্বতারে দহে মননের মধুর যে উদ্ভাস ও উচ্ছ্বাস-- তার আস্বাদ কি পাবে কোনও বোহেমিয়ান মন? যেখানে বুদ্ধির সঙ্গে আবেগের, সাহসের সঙ্গে দৃঢ়তার, তর্কের সঙ্গে যুক্তির শুভপরিণয় সম্পন্ন না হলে নতুন সৃষ্টির মৌরসীপাট্টা বিরচিত হয় কি স্রষ্টার?
বঙ্কিমচন্দ্রের 'আনন্দমঠ', শরৎচন্দ্রের 'পথের দাবী', নজরুলের 'আনন্দময়ীর আগমনে', বুদ্ধদেব বসুর 'রাতভরে বৃষ্টি', সমরেশ বসুর 'বিবর' বা 'প্রজাপতি', জীবনানন্দের 'ক্যাম্পে'-- বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ভাবে স্রষ্টার মুক্ত মনের লীলাবিলাসের স্রোতে এসেছে রক্তচক্ষু শুদ্ধতাবাদীর প্রগাঢ় শাসন।
ফিল্মের ক্ষেত্রেও কতবার কতভাবে যে শিল্পীর স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করেছে রাষ্ট্র তার ইয়ত্তা নেই! 'ব্যান্ডিট কুইন', 'ফায়ার', 'কামসূত্র-আ টেল অফ লাভ', 'দ্য পিঙ্ক মিরর', 'ব্ল্যাক ফ্রাইডে', 'ওয়াটার'-- তালিকা খুব ছোট নয়। বাধ্যতামূলক ভাবে শাসকের অনুমোদন নিয়ে যে-সব সৃষ্টিকে দিনের আলো দেখতে হয়, নিশ্চয়ই দুর্ভাগ্য তাদের। আর ঠিক এই বিন্দুতেই শাসিতের স্বাধীনতার প্রশ্নটা উঠে পড়ে।
আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে যা সে রচনা করে সেখানে আত্মোপলব্ধির ও আত্মানন্দের একটা গৌরব ছুঁয়ে থাকে। নিয়মের প্রাণহীন চক্র যে কোনও সৃষ্টির স্বচ্ছতাকেই ম্লান করে দেয়।
তা হলে কি অবাধ যৌনতা, অপার হিংস্রতার চাষাবাদেই সিলমোহর কাম্য? না। তা-ও নয়। সেখানে অবশ্যই একটা ফিল্টার থাকা কর্তব্য।
তবে এই ফিল্টারের এমন একটা ব্যালান্স থাকবে, যা দু'দিককেই সমান ভাবে ধরে রাখবে। যেখানে স্রষ্টার মনের সততা ও স্বচ্ছতারও উদ্বোধন হবে, আবার শাসকের শক্তিও স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠবে না। এবং এই ব্যালান্সটা সর্বতোভাবেই দু'পক্ষের সুস্থরুচির ওপরেই নির্ভর করে থাকবে। না হলে নিয়মের বেড়ি প্রতি মুহূর্তে মনুষ্যত্বকেই খর্ব করবে।
আরও পড়ুন: প্রেমিকার পাসওয়ার্ড হাতিয়ে অনলাইন ক্লাসে পর্ন চালাল বয়ফ্রেন্ড! অভিযোগ শিক্ষিকার