সান্টার কাছে চাওয়া, নবান্নের আকাশে উঠুক লাল-নীল-সাদা রামধনু
স্বরূপ দত্ত
আর একটু পরই সন্ধে ঘনিয়ে আসবে। চারিদিক আলোয় ঝলমল করবে। সেজে উঠবে রাস্তা, দোকান, বাড়ি, গাছ আর অবশ্যই মনটা। আজ মনের আউট লাইনেও এলইডি টুনির ঝলকানি। বড়দিনের জন্য ছোট্ট ছোট্ট অপেক্ষা। মাঝরাতেই তো আসবে সে। বছরে একবারই আসে। সান্টা। মা ছেলেবলায় আদর করে ডাকতো, সোন্টা অথবা সন্টা। ভাবতাম, সান্টা কি তাহলে আমার কোনও দাদা-টাদা নাকি! বেশ কয়েকটা বড়দিন কেটে যেতেই বুঝলাম - না, সান্টা আমার একার নয়। সকলের। তাঁর কাছে দু হাত ভরে চাওয়া যায়। কিন্তু বুড়ো মানুষটার মনের বয়স আজও বাড়লো না একটুও। দেবে। সব দেবে। কিন্তু টুক করে বাড়ানো হাতের তালুতে দেবে না। ঘুমিয়ে পড়লে লুকিয়ে এসে ঠিক মোজার মধ্যে গুঁজে দিয়ে যাবে আমার-আপনার চাওয়া জিনিসটা।
সেই দিনগুলো 'বড়' তাড়াতাড়ি চলে গেল। দিনগুলোর সাথে সাথেই বড় হয়ে উঠলাম। বড় মন কতটা হল জানি না। কিন্তু বড় শরীর হল। আর হল, বড় চাওয়া। তাই আজও সান্টার কাছে চাইতে বসলাম। মন থেকে অনেক ভেবেই চাইতে বসলাম। জানি, এ চাওয়া হাতের মুঠোয় দিয়ে যাবে না সান্টা। জানি এ চাওয়া মোজার মধ্যেও লুকিয়ে গুঁজে দিয়ে চলে যাবে না সান্টা। তবু, চাইলাম। কারণ, এ চাওয়ায় 'প্রাণ' রয়েছে।
সান্টা। তোমার পোশাকটা আমার দারুণ লেগেছে বরাবর। জানি না, তোমার ফ্যশান ডিজাইনার কে। জানি না, তুমি কোন ব্র্যান্ডের পোশাক পরো। কিন্তু 'কালার কম্বিনেশন'টা বড় ভালো। খুব উজ্জ্বল। লাল-সাদা। সত্যিই বিপ্লব আর শান্তির এমন সহাবস্থান, তোমার শরীরে ছাড়া অন্য কোথাও মানায়! ভাবছো, এত ভনিতার কী আছে! যা চাওয়ার চেয়ে নিলেই তো হয়। তার জন্য অত তোমার পোশাকের রঙ নিয়ে 'প্রশংসা' করার কী আছে। আছে গো সান্টা, আছে। আমার যে তোমার ওই রঙ দুটোই এবার একসঙ্গে চাই। তুমি তো প্রতি বড়দিনেই এ শহরে, এ রাজ্যেও আসো, সারা পৃথিববীর সব অলি গলি পেরিয়েও। জানোই তো, এখন আমাদের শহরটা, আমাদের রাজ্যটার দুটো রঙ হয়ে গিয়েছে। নীল-সাদা। আমাদের মুখ্যমন্ত্রীর পছন্দের রঙ এটা। তাই তাঁর পছন্দমতো শহরটা ক'দিনের মধ্যে দেখতে দেখতে নীল-সাদা হয়ে গেল। অথচ, সান্টা মনে করে দেখো, কয়েক বছর আগেও যখন তুমি আসতে, এই শহরটার চারিদিকে তোমার পোশাকের রঙের মতোই লাল রঙা ছিল। কিন্তু মাঝের ক'বছরের মধ্যে একটা ছোট শব্দ ঘটে গিয়েছে যে, আমাদের রাজ্যটায়। পরিবর্তন। ওটা ভুল শব্দ। আসল শব্দটা হওয়া উচিত 'ক্ষমতার পরিবর্তন'। তাই এই শহর, এই রাজ্যে আর লালের কদর নেই এখন। এখন সব নীল-সাদা।
একটা বা দুটো রঙে নিজের শহরটা, চারপাশটা সেজে উঠলে খারাপ লাগার তো কারণ নেই কোনও। সেটা কোন পয়সায় হচ্ছে। এমনটা হওয়া উচিত কিনা, এই প্রসঙ্গে তো ঢুকছিই না এখন। তোমায় শুধু বলার যেটা তা হলো, এই যে চারপাশটায় নীল-সাদার স্তর পড়ে গেল, এতে কিছু মানুষের ভালো লাগা রয়েছে। আছে উল্টোটাও। কিছু মানুষ নীল-সাদায় আপত্তি করে না। কিন্তু তাদের প্রিয় রঙ যে লাল। তাই দুই রঙা মানুষের মধ্যে বিভেদটা বড় প্রকাশ্যে এসে গিয়েছে। অভিমান, ক্ষোভ, রাগ, বিদ্বেষ বাড়তে বাড়তে হিংসায় পরিণত হয়ে গিয়েছে। আজ যতটুকু রয়েছে, তা কাল আরও বাড়তে চলেছে। এ যে রাজনীতির রঙ। এই দুই রঙের সহাবস্থান করাবে কে! কেউ করাবে না। তাতে যে লাভ নেই কারও। কিছু হিংসা জিইয়ে রাখলে, অনেক মানুষের লাভ।
জানো তো সান্টা, একটা কথা খুব ভালো করে বুঝে গিয়েছি। কোনও ভালো জিনিস তখনই ভালো হিসেবে দাম পায়, যখন সেটা 'লাভজনক' হয়ে ওঠে। লাভের না হলে আর ভালো হবে কীভাবে! তাই লাল-নীল-সাদার দুরত্ব বাড়ছেই। তোমার কাছে সান্টা, এবারের বড়দিনে একটাই উপহার চাওয়ার। তুমি প্লিজ এমন কিছু করো, যাতে মুখ্যমন্ত্রীর নীল-সাদার সাদা আর বামেদের লালকে অন্তত একটু অহিংসার কাছাকাছি এনে দিও। রাজনৈতিক জোট, ফায়দা, ওসব নেতারা বুঝুক। কিন্তু এই দুটো রঙকে ভালোবাসা মানুষদের কাছাকাছি আসা উচিত একটু। আমাদের সমাজটার জন্যই। না হলে, লাল আর নীল-সাদার লড়াইয়ে যে প্রতিদিন, প্রতিরাতে, প্রতিমুহূর্তে কত মানুষ মারা যাচ্ছে।
দ্যখো সান্টা, জন্মিলে মরিতে হবে, অমর কে কোথা কবে, এসব লাইনের মানে মানুষ বোঝে। মানে। কিন্তু মানুষকে কেন ওই লাল আর নীল-সাদার লড়াইয়ে মরতে হবে? কেন গ্রামের বা শহরের উঠতি বয়সের প্রাণকে একটা বোমার আওয়াজের পর গোটা শরীরে পাওয়া যাবে না। শরীরের ভেতরের শিরা দিয়ে বয়ে যাওয়ার কথা যে তরলের, তা কেন, তার শরীরের উপর দিয়ে বয়ে যাবে অঝোরে! রাজনৈতিক খুনটা একটু বন্ধ করে দাও সান্টা। মৃত্যুর কারণ তো শরীর অসুস্থ হওয়া হবে। রোগ হবে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ হবে বড়জোর। সেখানে মানুষকে কেন কালের নিয়ম না মেনে চলে যেতে হবে শুধু আর একটা রঙকে মন দিয়ে ভালোবাসার জন্য!
কোনওরকমে ২০১৫ টা আর একটা সপ্তাহের মধ্যে চলে যাবে। তারপরই আসতে চলেছে ২০১৬। নতুন বছর। হবে অনেক নতুন কিছু। কিন্তু, মনে ভয়ের মেঘটা কালো হয়ে আসছে। ২০১৬ মানেই তো বিধানসভা নির্বাচন। আমাদের রাজ্যে ভোট হবে জানো তো সান্টা। ভোট কবে হবে, এখনও কিছু ঠিক হয়নি। কিন্তু লাল আর নীল-সাদার ঝামেলাটা বেশ ভালোই লেগে গিয়েছে এখনই। রোজই কেউ না কেউ আমাদের পৃথিবীটা ছেড়ে চলে যাচ্ছে, শুধুমাত্র ওই এক রঙকে ভালোবাসার কারণে। তার মানে বিধানসভা নির্বাচনের দামামাটা বেজে গেলেই কী পরিস্থিত হবে বলো তো! আবারও বেশ কিছু মৃত্যু। কারণ? সেই পৌনাণিক মহামারি। 'রাজনৈতিক খুন'। এবার সান্টা, এমন কিছু করে দাও, যাতে রাজৈনতিক খুনোখুনিটা আর না থাকে। লাল আর নীল-সাদা মানুষগুলোকে একটু সহিষ্ণু করে দাও তোমার জাদুকাঠির ছোঁয়ায়। আর যেন এই বাংলার কোনও মা, তাঁর বড় আদরের সন্টাকে চোখের সামনে নিথর পড়ে থাকতে দেখে, বুক ফুঁড়ে ডুকরে কেঁদে না ওঠে।
এমন চাওয়ার আগে ভালোই জানি, বুঝি, রাজনীতিতে সব এক দল হয় নাকি! কেউ একরকম ভাববে। একরকম মতাদর্শে বিশ্বাস করবে। অন্যজন অন্যরকম ভাববে। অন্য মতাদর্শে বিশ্বাস করবে। এটাই তো স্বাভাবিক। ঠিক। এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এর বেশি অস্বাভাবিক জিনিসগুলো আর চাই না। অন্যের কথা, অন্যের মত, অন্যের আদর্শ, অন্যের পছন্দ কিছু লোকের হোক অপছন্দ, চিরকাল। জাগতিক নিয়মেই। কিন্তু একটু সহিষ্ণুতা দিও গো সান্টা এবার রাজনৈতিক মানুষগুলোকে। তাঁরা যেন কোনও অবস্থাতেই অপরের দিকে ধেয়ে না যায় এই ভেবে-তোকে এবার জানে মেরে ফেলব। ব্যাস সান্টা, ২০১৫-র ২৪ ডিসেম্বর তোমার কাছে চাহিদা এটুকুই। বড়দিনে তোমার কাছে বড় চাওয়া। একটু সহিষ্ণু করো আমাদের আশে পাশে থাকা রাজ্যের সব মানুষকে। রাজনীতি হোক। মত পার্থক্য হোক। এরা ভালো। ওরা খারাপ হোক। সব হোক। কিন্তু রাজনৈতিক ওই খুনগুলো যেন ২০১৬-তে একটাও না হয়।
আশায় থাকলাম সান্টা। তুমি ঠিক মোজার মধ্যে একটা চিরকুট গুঁজে দিয়ে যাবে হয়তো। আর সামনের বছর থেকে দেখতে পাব, লাল-নীল-সাদা-সবুজ-গেরুয়াদের মতের অমিল রয়েছে তখনও। কিন্তু সব রাজনৈতিক দলগুলোর রঙগুলো মিলে মিশে বেশ একটা রামধনু এঁকে দেবে আকাশে। নবান্নের পিছন থেকে গঙ্গার উপরে দেখা যাবে সাতরঙা রামধনুটা। যেদিকে তাকিয়ে আগামীদিনে প্রাণের আশা দেখবে এ রাজ্যের মানুষ। আশায় থাকলাম সান্টা। উপহারটা দেবে তো?