কেষ্টপুর কাণ্ডে নয়া মোড়

কেষ্টপুর কাণ্ডে প্রকাশ্যে চলে এসেছে তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব। ঘটনার দায়ে তৃণমূল কংগ্রেসের যুব সভাপতি পার্থ সরকারের গ্রেফতারের পর এই মুহূর্তে নয়া মোড় নিয়েছে রাজারহাটের রাজনীতি।

Updated By: Dec 1, 2011, 06:00 PM IST

কেষ্টপুর কাণ্ডে প্রকাশ্যে চলে এসেছে তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব। ঘটনার দায়ে তৃণমূল কংগ্রেসের যুব সভাপতি পার্থ সরকারের গ্রেফতারের পর এই মুহূর্তে নয়া মোড় নিয়েছে রাজারহাটের রাজনীতি। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সৌগত রায়ের ঘনিষ্ঠ জয়ন্ত দেবনাথ এবং পার্থ সরকারের শিবিরকে কোণঠাসা করতেই এই চক্রান্ত বলে অভিযোগ তৃণমূলের এক পক্ষের। অভিযোগ, রাজ্যের শ্রমমন্ত্রী পূর্ণেন্দু বসুর নির্দেশেই ফাঁসানো হয়েছে পার্থ সরকারকে। মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে আজ বিকেলে তৃণমূলভবনে বৈঠকে বসার কথা দলের শীর্ষনেতাদের। এই বৈঠকে গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের জট কাটাতে বিস্তারিতভাবে আলোচনা হতে পারে বলেই প্রাথমিকভাবে মনে করা হচ্ছে। বৈঠকে উপস্থিত থাকার কথা মুকুল রায়, পূর্ণেন্দু বসু, জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক সহ রাজাররহাটের তৃণমূল নেতৃত্বের। তবে তৃণমূলের একটি মহলের তরফে জানানো হয়েছে শেষ মুহূর্তে নাও হতে পারে এই বৈঠক। আজ কেষ্টপুরে নিহতের বাড়িতে যান তৃণমূল কংগ্রেস সাংসদ সৌগত রায়। কেষ্টপুরে গিয়ে আজ দলীয় কর্মীদের সঙ্গে কথা বলেন তৃণমূল নেত্রী কাকলি ঘোষ দস্তিদার।
এড় আগেই কেষ্টপুরে তৃণমূলের কর্মী খুনের ঘটনায় শুক্রবার গ্রেফতার হয়েছিলেন রাজারহাট যুব তৃণমূল সভাপতি পার্থ সরকার। গত ২৭ নভেম্বর দুপুরে কেষ্টপুরে খুন হন তৃণমূল কর্মী স্বপন মণ্ডল। অভিযোগ, খুনের ছক হয়েছিল স্থানীয় এক তৃণমূল নেতার বাড়িতে বসেই। অঞ্চলের একাংশের মত, কোটি কোটি টাকার ইমারতি ব্যবসা বা সিণ্ডিকেটের দখলদারি কার হাতে থাকবে, তা নিয়েই তৃণমূলের সমর্থক দুই সমাজবিরোধী গোষ্ঠীর রেষারেষিতেই রবিবার খুন হতে হয় স্বপন মণ্ডলকে। আর এই ঘটনায়ই উঠে এসেছে রাজারহাট এলাকার তৃণমূলের একাধিক নেতার নাম।  তবে কেষ্টপুর মোড়ে খুনের ঘটনা রাজনৈতিক কারণেই কিনা সেটাই এই মুহুর্তে সবথেকে বড় প্রশ্ন। প্রকাশ্য দিবালোকে খুনের ঘটনা কি তবে দিনের আলোর মতো স্পষ্ট করে তুলল তৃণমূল কংগ্রেসের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বকে?

রাজনৈতিক মহল মনে করছে যে এই অঞ্চলে গোষ্টীদ্বন্দ্বের ইতিহাস শুরু হয়েছিল বৈদিক ভিলেজ কাণ্ড থেকেই। সে সময় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশে দলের অভ্যন্তরে রদবদলও হয়। সেই রদবদলের কারণে বহিষ্কার করা হয় স্থানীয় দুই শীর্ষ নেতাকে। সেই থেকেই কার্যত দুই ভাগে  ভাগ হয়ে যায় রাজারহাটের তৃণমূল কংগ্রেস বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞ।
এর ঠিক পরেই বিধানসভা নির্বাচনে রাজারহাট টাউন তৃণমূল কংগ্রেসের সভাপতি জয়ন্ত দেবনাথকে টিকিট না দিয়ে পূর্ণেন্দু বসুকে টিকিট দেওয়ার ঘটনা গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব আরও বাড়িয়ে দেয়। প্রকাশ্যেই পূর্ণেন্দু বসুর বিরুদ্ধে প্রচার করতেও দেখা যায় জয়ন্ত দেবনাথকে। এই তীব্র  গোষ্টীদ্বন্দ্বের সঙ্গেই ঢুকে পড়ে ইমারতি ব্যবসার সিণ্ডিকেট রাজনীতি। সত্য বাঁপুই এবং শংকর--এই দুই দুষ্কৃতীর নিজেদের মধ্যে রেষারেষি থাকলেও দুজনই তৃণমূলের সমর্থক। দুহাজার নয় সালে সত্য এবং শংকর দুজনই গ্রেফতার হয়। পরে ছাড়া পাওয়ার পর তারা ঘনিষ্ঠ হয় পূর্ণেন্দু বসু গোষ্ঠীর। এই দুজন যখন জেলে, তখন স্থানীয় শিবকালী স্পোর্টিং ক্লাবের দখল এবং এলাকায় সিণ্ডিকেটের ব্যবসা সামলাতে উত্থান হয় স্বপন মণ্ডলের। স্বপন, জয়ন্ত দেবনাথ ঘনিষ্ঠ। দুহাজার এগারো সালের জানুয়ারিতে সত্য ছাড়া পাওয়ার পর ইমারতি ব্যবসার দখলদারি নেওয়ার চেষ্টা শুরু করে সে। ফলে স্বপনই হয়ে যায় তার মূল প্রতিদ্বন্দ্বী। ফেব্রুয়ারিতেই স্বপনের ওপর গুলি চালায় সত্যর দলবল। প্রাণে বেঁচে যান স্বপন মণ্ডল। সেবার সত্যকে ধরতে না পারলেও ছয় জনকে গ্রেফতার করে পুলিস। এরপর পুরনো বিবাদ ভুলে এক তৃণমূল নেতার মধ্যস্থতায় সত্য এবং শংকর নিজেদের মধ্যে আপোস করে নেয়।

এরপর তৃণমূলের ওই নেতা এবং আইএনটিটিইউসির এক নেত্রীর মদতেই সিণ্ডিকেট দখলের লড়াইটা আরও তীব্র হয়। তেঘরিয়ার অস্ত্র ব্যবসায়ী রাধাকান্ত ঘোষের কাছ থেকে পাঁচ হাজার টাকায় চারটে রিভলবার ও কুড়িটি গুলি কেনে তাঁরা। রবিবার কেষ্টপুর মোড়ের কাছে সাগর নামে এক যুবকের চায়ের দোকানে বসেছিলেন স্বপন মণ্ডল। সত্যদের ঘনিষ্ঠ কৃষ্ণ তা দেখতে পেয়ে টুলকো ওরফে বিশ্বজিত্ দাসকে ফোন করে জানায়। ফোন পেয়ে বাপিকে সঙ্গে নিয়ে বাইকে করে কেষ্টপুর মোড়ের কাছে পৌঁছে যায় টুলকো। আরও তিনজন চলে আসে। তাঁরা নজর রাখতে শুরু করে স্বপন এবং তাঁর সঙ্গীদের গতিবিধির ওপর। এরপর সুযোগ বুঝে গুলি চালায় টুলকো। মৃত্যু নিশ্চিত হওয়ার পর টুলকো চলন্ত বাসে উঠে পড়ে। কৃষ্ণ, বাপি বাইক নিয়ে চম্পট দেয়। বাকি তিনজন ট্যাক্সি নিয়ে এলাকা ছাড়ে। বাসে উল্টোডাঙা নেমে ট্রেন ধরে ডানকুনি পৌঁছয় টুলকো। ঘটনার পর সৌগত রায় অবশ্য জানিয়েছিলেন, এই ঘটনা রাজনৈতিক কারণে নয়। সৌগত বাবুর বিরুদ্ধেও স্থানীয় তৃণমূলের একাংশের অভিযোগ, তিনি জয়ন্ত দেবনাথের গড়ফাদার। সৌগতবাবুর ওই বক্তব্যের পর প্রশ্ন ওঠে, তাহলে কী দলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বকে আড়াল করতেই এই মন্তব্য? এ নিয়ে একাধিক প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। সেইসঙ্গে বিশ্বজিত্ দাস এবং রাধাকান্ত ঘোষকে গ্রেফতারের পর অনেকটাই পরিস্কার হয়ে গেছে রাজারহাটের রাজনীতি।

.