ঘনিয়ে এল ঘুমের ঘোর,গানের পালা সাঙ্গ মোর`
রুমাল থেকে বিড়াল হওয়ার হদিশ লুকিয়ে ছিল তাঁর কলমের ডগায়। ওরাংওটাং-এর রং যে হলদে-সবুজ হতে পারে আর তার সঙ্গে ইঁট পাটকেলের যে একটা গভীর সম্পর্ক আছে সেই রহস্যও উদ্ঘাটন করে গিয়েছিলেন তিনি। তিনি সুকুমার রায়। ১০ই সেপ্টেম্বর, বাংলার (সম্ভবত ভারতেরও) `নন সেন্স` সাহিত্যের জনকের মৃত্যুদিন। অথবা বলা ভাল পাগলা দাশু, প্রফেসর হেঁসোরাম, হুঁকোমুখো হ্যাংলাদের লিস্টে নতুন সদস্য সংযোজনের শেষ।
রুমাল থেকে বিড়াল হওয়ার হদিশ লুকিয়ে ছিল তাঁর কলমের ডগায়। ওরাংওটাং-এর রং যে হলদে-সবুজ হতে পারে আর তার সঙ্গে ইঁট পাটকেলের যে একটা গভীর সম্পর্ক আছে সেই রহস্যও উদ্ঘাটন করে গিয়েছিলেন তিনি। তিনি সুকুমার রায়। ১০ই সেপ্টেম্বর, বাংলার (সম্ভবত ভারতেরও) 'নন সেন্স' সাহিত্যের জনকের মৃত্যুদিন। অথবা বলা ভাল পাগলা দাশু, প্রফেসর হেঁসোরাম, হুঁকোমুখো হ্যাংলাদের লিস্টে নতুন সদস্য সংযোজনের শেষ।
ছোটবেলায় আবোল-তাবোল হাতে পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই একটা দুনিয়া খুলে যায় সবার কাছেই। মোম রঙের বাক্সে ঘুমিয়ে থাকা লাল, নীল, সবুজ, হলুদ রঙ গুলো সবার চোখ এড়িয়ে চুপিচুপি কেমন জানি মিশে যায় রোজকার জীবনে। বাস্তবের স্কুল, বাড়ি, একটু খেলা আর অনেক পড়ার মাঝে এক ঝাঁক নতুন বন্ধু। সেই যে রামগরুড়ের ছানার না হাসির বাসার সঙ্গে ইস্কুলের ক্লাস রুমের মিল খোঁজা শুরু হয়, বেশ গম্ভীর বড় বেলাতেও অফিসে বসের সামনে মনের মধ্যে কিন্তু চুপচাপ উঁকিঝুঁকি মারে সেই সব মিল গুলোই।
আর এখানেই অনন্য সুকুমার রায়। ১৮৮৭ থেকে ১৯২৩। মাত্র ৩৬ বছরে তিনি আসলে তৈরি করে গিয়েছেন একটা ভিন্ন যুগ,একটা অন্য জগত। অনেকটা পিটার প্যানের নেভারল্যান্ডের মতন সেই জগত। যেখানে একবার ঢুকে পড়তে পারলে বয়সটা যেন এক্কেবারে থমকে যায়। খুঁড়োরকল, বুড়ীর বাড়ি, হুঁকোমুখো হ্যাংলা, কুমড়ো পটাশরা সেই যে পড়তে শেখার সঙ্গে সঙ্গে একবার ঘাড়ের উপর চেপে বসে বড় বেলাতেও মোটেও পিছু ছাড়ে না। বুদ্ধির গোড়ায় পাকামি একটু একটু করে বাসা বাঁধা শুরু করে যখন প্যান্ত ভূতের জ্যান্ত ছানাকে তার মায়ের আদরে ভরিয়ে তোলার মধ্যে বাঙালি মায়ের চিরাচরিত রূপটাই চোখের উপর ঝুপ করে ভেসে ওঠে। প্যাঁচা-প্যাঁচানীর প্রেম গাথা বড় বেশি বাঙালি প্রেমিকের প্রেমিকাকে 'ঢপ' প্রশংসায় ভরিয়ে দেওয়া মনে করিয়ে দেয়। সব কিছু হওয়ার চেষ্টায় আম বাঙালির কিস্যু না হতে পাড়ার যথার্থ চেহারাটা 'কিম্ভূত' এরই 'রেপ্লিকা' মনে হয়। আর হযবরল র উধো-বুধোর ৬৪র পর বয়েসের উল্টো দিকে হাঁটাতো আসলে আমাদের সবার মনে লুকিয়ে থাকা সুপ্ত ইচ্ছা।
বাঙালি বড় হতভাগ্য। তাই সুকুমার রায়কে বেঁধে রাখতে চেয়েছে শিশু সাহিত্যিকের আবরণেই। আর সেই সাহিত্যের সীমাটাও 'ছড়াকারের' বেড়াতে বেঁধে দেওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করে গেছে দিনের পর দিন। সেই চেষ্টায় ঢাকা পড়ে গেছে লক্ষ্ণণের শক্তিশেলের মতন অসাধারণ নাটক। 'পপাত চ মমাত চ' র মত হারাতে বসেছে দ্রিঘাংচুর মতন ছোট গল্প। বিজ্ঞান বিষয়ক তাঁর একগুচ্ছ প্রবন্ধের কথাতো কোন কালেই ভুলে বসে আছে তাঁরা।
আর ছবি?
তাঁর সব সৃষ্টির নাম গুলো মনে করলেই চোখের সামনে জ্যান্ত হয়ে ওঠে যে ছবিগুলো সেই সব কিছুই তাঁর নিজের আঁকা। ইংরেজিতে লিয়র বা ল্যুই ক্যারল ননসেন্স সাহিত্যের যে অপূর্ব ধারা সৃষ্টি করেছিলেন বাংলায় সেই ধারাই সযত্নে লালন করেছিলেন সুকুমার রায়। কিন্তু সুকুমার রায় সত্যিই লিয়র বা ক্যারলের মতন সমাদৃত হতে পেরেছেন কি না সেই নিয়ে বিতর্ক চলে আজও।
মৃত্যুর আগে নিজেই সাজিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন তাঁর সব সৃষ্টিকে। নিজে দেখে যেতে পারেননি সেই সব অসামান্য সৃষ্টির প্রকাশিত রূপ। তোড়ায় বাঁধা ঘোড়ার ডিমকে সঙ্গে করে গানের পালা সাঙ্গ করে মেঘ মুলুকে ভেসে গিয়েছেন সুকুমার রায় সেই ১৯২৩-এর ১০ই সেপ্টেম্বর। ভীষণ মন খারাপের দিনে যখন হঠাৎ হাতে পাওয়া তাঁর কোন লেখা পেটের মধ্যে এলোমেলো হাসির বুড়বুড়ি তৈরি করে দিয়ে যায় তখন সেই হাসির হাত ধরেই তিনি বারবার ফিরে আসেন আমদের সবার কাছে। সবাইকে হাঁসিয়ে কাঁদিয়ে রয়ে যান আমাদের মধ্যেই।