না-বলা বাংলা ভাষা
ছবির নাম- বাড়ি তার বাংলা পরিচালক- রংগন চক্রবর্তী
শর্মিলা মাইতি
ছবির নাম- বাড়ি তার বাংলা
পরিচালক- রংগন চক্রবর্তী
রেটিং- ***1/2
আ মরি বাংলা ভাষা! মরিয়াও মরিল না। ক্ষতবিক্ষত দেহ নিয়ে তালপাতার তলোয়ার উঁচিয়েই দাঁড়িয়ে রইল বিজ্ঞাপনে, হোর্ডিং-এ, মিছিলে, স্লোগানে। খাঁজে-ভাঁজে ভুল বানান, হিন্দি ও ইংরেজির চোখরাঙানি এবং বুলডোজার সত্ত্বেই কী কইমাছের জান নিয়ে বেঁচে আছে, সেটা বোধহয় এ ছবি দেখার পর আরও গভীর নিবিড়ভাবে অনুভূত হল।
এই প্যারা দিয়ে শেষ হতে পারত এ রিভিউ। প্রথমেই বলে নিতে হল, তার কারণ এ ছবির হার-না-মানার হিম্মত। সাংস্কৃতিক বিস্মৃতি, যার পোষাকি নাম কালচারাল অ্যামনেশিয়াকে সূক্ষ্ম হাস্যরসের আলিঙ্গনে বেঁধে ফেলে একেবারে দর্শকের দরবারে এনে হাজির করা। যেমনই হোক সে দর্শকের ভাষাজ্ঞান, তার মধ্যেও একটা মন-কেমনের পরিধি তৈরি করা।
এ ছবির নায়ক শাশ্বত, মানে রূপচাঁদ, বাংলা লিখতে ভুলে গিয়েছেন। ও একটি হুঁকোমুখো চেহারা নিয়ে দ্বারস্থ হয়েছেন মনোবিদের। ছবির শুরু এখান থেকে, প্রতি ছত্রেই রূপকার্থ ছুঁয়ে যায় অতি সন্তর্পণে। যে ভাষায় চর্যাপদ থেকে দীর্ঘ উপন্যাস লেখা হত যুগের পর যুগ ধরে, কালের থাবায় সে ভাষাই কলেবরে ছোট হতে হতে বিজ্ঞাপনে মুখ লুকিয়েছে। একসময়ে পুরোপুরি ভ্যানিশ। হেজিমনির অভিঘাতে ভাষার আত্মবিশ্বাস এমনই শূন্যে গিয়ে ঠেকেছে যে, যথেষ্ট চাবুকের আঘাত না পেলে বাংলা ভাষার আর ঘুমই ভাঙছে না। মানবজমিনে আর আবাদকর্ম চলছে না। এ সমস্ত কঠিন কথাই কী অপূর্ব সরল, তরল করে বুঝিয়ে দেওয়া গেল আমাদের নায়কের মাধ্যমে। সুন্দরী মনোবিদ যখন ডিকটেশন দিচ্ছেন, তখন কিন্তু তরতর করে লিখে চলেছেন। কিন্তু নিজে যখন লিখতে যাচ্ছেন, কলম চলছে না। শূন্য হয়ে গেছে শব্দভান্ডার।
নায়কের জীবনপথও অত্যাশ্চর্যের সমাহার। যাঁরা প্রচুর ফ্রয়েড, ফুকো, দেরিদা, লাকা পড়েছেন, এবং যাঁরা এঁদের নামই শোনেননি, উভয় পক্ষই এই অত্যাশ্চর্যের রসাস্বাদন করতে পারবেন। কয়েকটি উদাহরণ তুলে ধরি। এক, যেকোনও বয়সেই নায়কের অবয়ব একই। চারমাস বয়সের কাঁথায় মোড়া শিশু থেকে, ইংলিশ মিডিয়ামে পড়া এঁচড়পাকা খোকা, সব বয়সেই এক। হাসি পাবেই, আবার এরই জমি খুঁড়ে নিজেদের কলেজ-পড়া থিয়োরি ঝালিয়ে নিতেও পারবেন। দুই, মায়ের দেখানো পথে মাতৃভাষার লালন। একটি দৃশ্যে মায়ের কাছেই বিজ্ঞাপনী ভাষার প্রথম পাঠ নিচ্ছেন নায়ক (বাংলা সিনেমার ছাত্রের কাছে অন্যতম টেক্সট অবশ্যই হওয়ার দাবি রাখে এই দৃশ্যের বিষয়বস্তু)। পরবর্তীকালে সেই নায়কের মনন-কলম ঝড় তুলছে বিজ্ঞাপন দুনিয়ায়। মাতৃভাষা ও মা, এই ইকোয়েশনটা এযাবত্ যেমনভাবে সিনেমায় বহুচর্চিত হয়েছে, তার খোলনলচে ভেঙে, এক্কেবারে আধুনিক রং-ঢঙে বেরিয়ে আসছে। মায়ের সঙ্গে ছেলের জীবনরেখার যে একটা ঠান্ডা যুদ্ধ তৈরি হচ্ছে, তার শুরু এখান থেকেই। তিন, পিতৃসত্তায় রাষ্ট্রের রাজনৈতিক বৃত্তান্ত। বাবা কমিউনিস্ট পার্টি করেন। রাষ্ট্র যেমন ব্যক্তিসত্তাকে নিজের কায়েম করতে চায়, তেমনই দেখা যায় শৈশব থেকেই নায়কের উপর বাবার আদেশ কেমনভাবে কায়েম হচ্ছে।
বহুদিন পর এমন একটি বাংলা ছবি, যার চিত্রনাট্য ছানবিন করে বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাস ও যুগপত্ সাংস্কৃতিক সর্বনাশ একই পংক্তিতে বিশ্লেষণ ও বর্ণনা করা যায়। কোথাও পূর্ণচ্ছেদ পড়ে না। রাজনীতির প্রেক্ষাপটে মেরুন পার্টির পতন ও হলুদ পার্টির উত্থান, রুপোলি পরদা ছেড়ে অনায়াসে সাঁতরে বেরিয়ে আসে বাস্তবের ভূমিতে। রাজনীতির জাঁতায় পিষ্ট আ-মরি বাংলা ভাষারও কেমন মরণপণ লড়াই, সেটা ছবির গতিতে না ভাসলে বুঝতে পারবেন না। এমন চিত্রনাট্য সচরাচর তো আসেই না, কতখানি প্রগতিশীল গবেষণার পর এমন ফলপ্রসূ উন্নয়নের ধাপে পৌছনো যায়, তা এই সমালোচকের জানা নেই। চার, প্রকৃষ্ট শব্দসহযোগে লিরিকস! একটিও বাড়তি ব্যাখ্যা না দিয়ে একেবারে তিরের ফলার মতো বিঁধে যায়। গোদা অর্থে বললে, বাংলা ভাষাকে কীভাবে রাষ্ট্রক্ষমতার স্বার্থে দুমড়ে-মুচড়ে ব্যবহার করা হয়েছে, গানগুলো শুনে হাসতে হাসতেই তা অনুধাবন করতে পারবেন। মনে থেকে যাবে, অনেক কিছুই হল না এ জীবনে..
এবং পাঁচ। শাশ্বত। ফাইভ স্টার। প্রতি ছবিতেই নিজেকে ভাঙেন গড়েন, এমন স্ক্রিপ্টে খাপে খাপে এঁটে ওঠার মতো ব্যক্তিত্ব ও প্রতিভা বাংলা ছবিতে একজনেরই আছে। প্রতিটি ছড়া, প্যারডি আর গান এঁরই অভিনয়দক্ষতায় অন্য মাত্রায় পৌঁছেছে। আলোতে, কস্টিউমে, সৌন্দর্যে রাইমা সেন অনন্যা। বেশ ঘুরে ফিরে দেখা যায় তাঁর অভিনয়ও। চোখের পাতায় লেগে থাকে আরও একজনের অভিনয়। তুলিকা।
এবং অবশ্যই টুপি খুলে মেরুন ও হলুদ সেলাম। চিত্রনাট্যকারকে।
বি দ্র: আমাদের সকলেরই বাংলায় বাড়ি। তবু ভাষাটার সঙ্গে এমন আড়ি হয়ে গিয়েছিল, হঠাত্ যেন চমক ভেঙে জানতে পারলাম। এমন ঘুম-ভাঙানিয়া ছবি যেন আরও মেলে এই পরিচালকের কাছ থেকে।
(আসলে, এই শেষ কটা লাইন দিয়েই শুরু করব ভেবেছিলাম। লেখার সময়ে কেন যে মনে পড়ল না কে জানে!)