ইনস্টা-মুখী যদিদং হৃদয়ং অথবা ফেবু সুন্দর বাঙালির বিবাহ অভিযান...

ওয়ালে -ওয়ালে সানাই বাজছে। রিলসের ঠোঁটে লেগে আছে, ‘পিয়া তোসে নয়না লাগে রে...নয়না লাগে রে...পিয়া তোসে’। ‘সারাক্ষণ সিঙ্গল মোর্চা’র সদস্যবৃন্দ গ্রুপ ছেড়ে দিতে চায় ঠিক এই নভেম্বর মাসে। তাঁদের চোখ নমকিন। 

Updated By: Nov 30, 2022, 08:06 PM IST
ইনস্টা-মুখী যদিদং হৃদয়ং অথবা ফেবু সুন্দর বাঙালির বিবাহ অভিযান...

 শুভঙ্কর চক্রবর্তী (রম্য রচনা) 

ওয়ালে -ওয়ালে সানাই বাজছে। রিলসের ঠোঁটে লেগে আছে, ‘পিয়া তোসে নয়না লাগে রে...নয়না লাগে রে...পিয়া তোসে’। ভিক্টোরিয়ার পরী মাথায় গোঁজা পাত্রীর। গঙ্গার সিল্যুটে নর-নারীর অবয়ব। প্রিওয়েডিং, ওয়েডিং, পোস্ট ওয়েডিং, প্রি হানিমুন, হানিমুন, পোস্ট হানিমুন এমনকি ‘অষ্টমঙ্গলা’ মঙ্গল্যে শিবে সর্বার্থ সাধিকের ছবিও এখন স্টেটাস বাড়াবে। ‘সারাক্ষণ সিঙ্গল মোর্চা’র সদস্যবৃন্দ গ্রুপ ছেড়ে দিতে চায় ঠিক নভেম্বর মাসে। তাঁদেরও চোখ নমকিন। মিমে ধেয়ে আসা, ‘এই বেশ ভাল আছি’, ‘একলা ঘর আমার দেশ’ কিংবা অরিজিতের ‘আচ্ছা চলতা হুঁ...দুয়াও মে ইয়াদ রখনা’ আনহ্যাপিলি সিঙ্গলদের মন্ত্র।

প্রিওয়েডিং বিষয়টা একেবারে অন্য ডিগ্রিতে। কোলে তুলতে হয়...ওজন যখন ৭০ (কিলো) (দম লাগাকে হাইশ্যা), গোটাটাই কেলো! তারপর দুই হাত জুড়ে পান আঁকতে হয় আঙুলে (তুম হো তো), এছাড়াও চিবুকে চুমু খাওয়া (হোঁটো সে ছুঁলো তুম) , ট্রামের লাস্ট সিটে বসে ‘রবিঠাকুর’ পড়া, (রাস্তায় সাজি ট্রামলাইন, কবিতায়..) ব্র্যাকেটে লেখা গানগুলো চলতে পারে। পাত্র-পাত্রীর পছন্দ অনুযায়ী যা বদলে যাওয়াটাই স্বাবাবিক। ভিডিয়োর রংয়ে শান্তিনিকেতনের দোল খেলা যায়। সবুজ-হলুদ-লাল সব রং ঠিকরে বেরিয়ে আসে। ন্যাচেরাল শুধু হেয়ার কালারে, ভিডিয়ো কালারে থাকে না। স্লো মোশনে ভিডিয়োর খেলা। নায়িকা–নায়ক যা করবে তাই ধীরে। কোনও তাড়া নেই। সারা শহরে ট্যাংট্যাং করে ঘোরা ফলত গায়ের ট্যান, সব মিলে মিশে একাকার হয়ে যায়।

এমনই ভিডিয়োর টিজার হয়। কোনও এক শট কেটে, শেষে বসিয়ে দেওয়া ‘save the date’। ক্লিপ কোনও কোনও সময় বিয়ের কার্ড হিসেবে গণ্য হয়, তাই ‘জাস্ট হোয়াটস অ্যাপ কর’।

আরও পড়ুন-  Mr. Bean Viral Video: গাইছেন লতা, নাচছেন মি.বিন এবং আয়েশার মোহময় হাতছানি...

এরপর সেই মাহেন্দ্রক্ষণ! বাই দ্য ওয়ে, একটা জোক মনে পড়ল। একমাত্র বিয়ের দিনে পাত্র হাসে, এবং পাত্রী কাঁদে। তারপর থেকে গোটাটাই উল্টে যায়...(ফেমিনিস্ট স্কোয়াডদের আমার ভয় লাগে)। বাঙালি সব সময় ইংরেজিতে বিয়ে করে চলেছে। কোনও বাঙালি বিয়ের দরজায় এই লেখা পুষ্পাক্ষরে বা অন্য কোনও রকম অক্ষরে দেখিনি: ঝন্টু বিয়ে করছে ঝিন্টিকে বা কিংবা ঝিন্টি ঝন্টুকে!

যাই হোক, বিয়ের শিডিউলের একটা ব্রিফ দিই। বিয়ের দিন সকাল সকাল যা হয়ে থাকে, দু’পক্ষের ফোন-ফেসবুকের ব্লক লিস্টে অনেকজনের নাম গোঁতাগুঁতি করে ঢুকে যায়। (যদি) মনখারাপ করে ‘গিলতে’ ইচ্ছে করে, কিন্তু পরিবারের ঐতিহ্য জলাঞ্জলি যাবে বলে, নিজেকে আটকায় কেউ-কেউ। বন্ধুরা শেষবার বলে, ‘ভাই তুই-ও’। তাঁদেরও চোখ নমকিন। কী করব আর কী করব না এটা নিয়ে ভাবনা বাড়ে।

শেষমেশ বড় গাড়ির হালকা ন্যাতানো ফুলের গন্ধ, যজ্ঞের হট স্মোকিনেস এবং সিঁথির সিঁদুর গোটা খেলা শেষ হয়ে যেতে পারত, কিন্তু তা হয়ে ওঠে না। ফোটো এবং ভিডিয়োগ্রাফারদের ‘ওয়ান্স মোর প্লিজ’, তাতে মাল্টি টেক যায়, ১৫ ডিগ্রিতে খই আগুনকে, ৩৮.৫ ডিগ্রিতে সিঁদুর কপালকে ছোঁবে এবং সাঁত পাঁকে বাঁধা মোট তেরো বার হতে ‘এক্সট্রা টাইম’ (ওটা নয়, সময়ের কথা বলছিলাম) দিতে হয়। বিয়ের সময় যদি ফেসবুক লাইভের একটা ব্যবস্থা রাখা যায়, তাহলে কুয়েতে থাকা কানু পিসিও ল্যাপটপ স্ক্রিনে দেখতে পারবেন যে তাঁর দেওয়া টিকলিটি কনে পড়েছে।

আরও পড়ুন- The Kashmir Files: IFFI-র মঞ্চে ‘দ্য কাশ্মীর ফাইলস’ বিতর্ক! ক্ষমা চাইলেন ইসরায়েলের কনসাল জেনারেল

খাবারদাবারের এপিসোডে, ‘মিনারেল ওয়াটার’ মেনু কার্ডে দাগিয়ে দিতে হয়, ভাবটা এমন জলের নাম জীবন, আর মিনারেল জলের নাম জীবনসুধা! ক্যাটরিংয়ের ছেলেপুলেদের নাম বদলে যায়। কারওর নাম, ‘এই ফিশ ফ্রাই’, কারওর ‘এই আলু-ফুলকপি’ আবার কারওর নাম ‘এই বাটারস্কচ’। মাংসের পিস মুখে ঢোকাতেই হ্যালোজেন জ্বলত এককালে, এখন এক ফ্ল্যাশেই কাজ খতম্। বাফে হলে, কাউন্টার থেকে চেয়ার অবধি পৌঁছতে অ্যক্রোব্যাটস হলে বিশেষ সুবিধে। কারওর প্লেটে নুন থেকে পান, সবকটা পদ মিলে গিয়ে ‘গন্ধমাদন’ পর্বত। পেট ভরিয়ে, ভুঁড়ি দুলিয়ে, দাঁতে টুথপিক মেরে, অতিথিরা বলবে, ‘মিষ্টিটা একটু বেশি মিষ্টি’! হাউ স্যুইট‌! (

উপোসী) বরকনের পেট খালি। কিন্তু এই মহাভোজ পর্ব মেটার পর খাবার বরাত। তাই হাসিতে গাল চালাতে হয়। তবে শেষ পাতে খেতে গিয়ে, এও হয় ‘গলদা চিংড়ি’ দু’পিস কম পড়িয়াছে’!‌ বাসর রাতে গান গাইতে হয়, জয় গোঁসাইয়ের কবিতা, টুক করে ফচকে চুটকি! এই সব পেরিয়ে, ভাল, খারাপ, টু ফানি, ট্যানট্রাম, দেখনদারি, যাবতীয় গোত্তা খাওয়া শব্দ পেরিয়ে বাঙালি বিয়ের সম্পর্কগুলোয় মর্চে ধরেনি।

‘কী রে তোরটা দেখে যেতে পারব তো!’, এমন সব কথাবার্তায় মাসিমা-কাকিমা-জেঠিমা-পিসিমাদের আনকাউন্টেড মিম বেরনোর পরও, এই ডাকখোঁজগুলোর জন্য বেঁচে থাকে বাঙালির বিবাহ অভিযান। 

(Zee 24 Ghanta App দেশ, দুনিয়া, রাজ্য, কলকাতা, বিনোদন, খেলা, লাইফস্টাইল স্বাস্থ্য, প্রযুক্তির লেটেস্ট খবর পড়তে ডাউনলোড করুন Zee 24 Ghanta App) 

.