কোন নারী? কার দিবস? আয়নার সামনে আমাদের নতমস্তক
গতকাল কাটোয়ায় আবার একখানা গণধর্ষণের রিপোর্ট করে আজ নারী দিবসের লেখা লিখতে বসলাম। বিগত মাসে প্রায় আধডজন ধর্ষণ রিপোর্টেড হল সংবাদমাধ্যমে। তাই এখনও ঠিক বুঝতে পারছি না, কাকে নিয়ে লিখব!
শময়িতা চক্রবর্তী
গতকাল কাটোয়ায় আবার একখানা গণধর্ষণের রিপোর্ট করে আজ নারী দিবসের লেখা লিখতে বসলাম। বিগত মাসে প্রায় আধডজন ধর্ষণ রিপোর্টেড হল সংবাদমাধ্যমে। তাই এখনও ঠিক বুঝতে পারছি না, কাকে নিয়ে লিখব! ওই ধর্ষিতা নারীদের নিয়ে? পার্ক স্ট্রিটের পানশালা থেকে বেরনোর পর শ্লীলতাহানি হলে যাঁদের আমরা অবলীলায় `বাজে মেয়ে` বলে তকমা দিয়ে দিই, নাকি তাঁদের নিয়ে যাঁরা ধর্ষণের পেছনে খুঁজেছেন রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র, না সেই নির্ভীক মহিলা গোয়েন্দা প্রধান, যিনি তাঁর ঊর্ধ্বতন বা রাজনৈতিক চাপের কাছে নতিস্বীকার না করেই নিজের কর্তব্য পালন করতে অবিচল থেকেছেন? নাকি এক অন্যরকম সাহসী নারীর চরিত্রে বিদ্যা বালানের অভিনয় এবং জাতীয় পুরস্কার লাভের খবরটাকে সেলিব্রেট করার মাধ্যমে এই কলম কুর্নিশ জানাবে মেয়েদের?
অথবা হয়তো এঁদের কাউকে নিয়েই নয়। এঁরা তো কোনও না কোনও অর্থে অসাধারণ। কেউ অসাধারণ অভিনেত্রী, আবার কেউ সাধারণ থেকে অসাধারণ হয়ে উঠেছেন ধর্ষক সমাজের উদ্দেশ্যে `আমি পাল্টাব না` এই সপাট, আত্মবিশ্বাসী জবাব দিয়ে। তাই এঁদের নিয়ে লেখা হয় লাইনের পর লাইন। কিন্তু প্রতিদিন যে মেয়েটা অসুস্থ স্বামী আর দুটো বাচ্চা রেখে কলকাতায় বাবুদের বাড়ি কাজ করতে আসেন, সবজি বিক্রি করেন কলকাতার নাম-জানা, না-জানা বাজারে, বা মাথায় করে বয়ে নিয়ে যান ঝুড়িভর্তি মাটি। অথবা এসব কিছুই না। আমাদের মায়েরা, যাঁরা ভোর থেকে উঠে বাড়ির সমস্ত কাজ সারেন নিঃশব্দে, বরকে টিফিন করে দিয়ে বাচ্চাটাকে খাইয়ে কোনোমতে অফিসের বাস ধরতে ছোটেন, অথবা নিপাট গৃহবধূ, যিনি রান্নাঘরের ছাদটাকেই আকাশ ভেবে চালিয়ে যান হাড়ভাঙা খাটুনি, তাঁদের লড়াইটা কম কিসের? তাঁরাও তো সাধারণের মধ্যেই অসাধারণ। অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী, কাজের মাসি, কামিন, গৃহবধূ--এই নারী দিবসটা আসলে তাঁদেরই। তাঁদের, কারণ আমরা প্রায় ভুলতে বসেছি যে আন্তর্জাতিক নারী দিবসের এককালীন নাম ছিল `ইন্টারন্যাশনাল ওয়ার্কিং উইমেন্স ডে`, এবং প্রথম পালন করেছিল আমেরিকান সোস্যালিস্ট পার্টি। তাই আজ সেই সব ঘরে এবং বাইরে কর্মরত মহিলাদের প্রতি সম্মান জানিয়ে এই কলমের পক্ষ থেকে সহস্র তোপধ্বনি।
বরং গল্প যদি বলতেই হয় তাহলে স্মৃতির ধুলো ঝেড়ে দুজন `সাধারণ` মেয়ের কথা বলা যাক। যাঁদের লড়াই শেষ পর্যন্ত `ক্লিশেড` নারীবাদের লড়াই ছাপিয়ে হয়ে ওঠে মানবমুক্তির বহ্নিশিখা।
প্রথমজন, রোজা পার্কস। সময়টা ১৯০০। আমেরিকায় মন্টগোমারিতে চালু হল `সিটি-অর্ডিনান্স`। শ্বেতাঙ্গ-কৃষ্ণাঙ্গ যাত্রীদের বসার আলাদা জায়গা নির্ধারিত হয়ে গেল। প্রথম কয়েকটি সারি নির্দিষ্ট থাকত শ্বেতাঙ্গদের জন্য। মাঝের চারটি সারি কৃষ্ণাঙ্গদের জন্য। তবে এরপর তীব্র বর্ণবিদ্বেষী মন্টগোমারিতে যখন বাসে ভিড় বাড়তে দেখা গেল, কৃষ্ণাঙ্গদের নিজের আসন ছেড়ে শ্বেতাঙ্গদের বসার জায়গা করে দেওয়াটাই হয়ে দাঁড়াল অলিখিত নিয়ম। রোজাই প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ, যিনি এর প্রতিবাদ করে নিজের জায়গা ছেড়ে ওঠেননি। স্থানীয় ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে হাড়ভাঙা খাটুনি সেরে সেদিন বাসে উঠেছিলেন রোজা। মাঝে কৃষ্ণাঙ্গদের নির্ধারিত সিটেই বসেছিলেন। ভিড় বাড়তেই শ্বেতাঙ্গ বাস-ড্রাইভার জেমস ব্লেক তাঁকে উঠতে প্রথমে অনুরোধ করেন এবং পরে দেন হুমকি। মানতে অস্বীকার করায় ১৯৫৫য় কারাদণ্ডে দণ্ডিত হলেন তিনি। সঙ্গে সঙ্গে মুক্তিকামী সাম্যের অধিকারে বিশ্বাসী মানুষ ক্ষোভে ফেটে পড়লেন এই অন্যায়-অসাম্যের বিরুদ্ধে। সেই সিভিল রাইট্স আন্দোলনের আঁচ গিয়ে পৌঁছল পৃথিবীর প্রত্যেক কোণায়। মুহূর্তে আইকন হয়ে গেলেন রোজা। মার্কিন কংগ্রেস তাঁকে `সিভিল রাইট্স` আন্দোলনের `ফার্স্ট লেডি` আখ্যা দিল। এখনও কালো মানুষদের ন্যায় বিচারের লড়াই যেখানে যেখানে চলছে, রোজার প্রতিবাদের ইতিহাস স্মরণ করা হয় সেখানে। ভাবতে গর্ব হয়, যুগ যুগ ধরে চলতে থাকা একটা জঘন্য মধ্যযুগীয় প্রথার বিরুদ্ধে প্রথম গলাটা তুলেছিলেন, হ্যাঁ, একজন নিম্নবিত্ত পরিবারের অতি সাধারণ মহিলা।
দ্বিতীয়জন অবশ্য এখনও বিচার পাননি। স্বীকৃতিও বিশেষ পেয়েছেন কিনা তা-ও তর্কসাপেক্ষ। রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস এবং সেনাবাহিনীর অত্যাচারের বিরুদ্ধে তাঁর দীর্ঘ অনশন আজ ইতিহাস। তবুও, নারী দিবসে মেয়েদের যৌন স্বাধীনতা বা কাজের অধিকারের বিষয়গুলি যতটা গুরুত্ব পায়, রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের বিরুদ্ধে একা দাঁড়িয়ে নিজের জীবন বাজি রেখে একটি মেয়ের এরকম লড়াই কোথাও যেন একটু আড়ালে থেকে যায়। আমরা মিডিয়া তাঁকে মাঝে মাঝে ভুলে যাই, নাগরিক সমাজ মাঝে মাঝে স্মৃতির আলস্য থেকে বাধ্যতামূলক গা-ঝাড়া দিয়ে উঠে বিস্ময়ে বলে ওঠে `আরে ও এখনো বেঁচে আছে? বারো বছর হয়ে গেল না?` রাজনীতির আঙিনায় তিনি হয়ে থাকেন প্রান্তিক। তবু, মানুষের মৃত্যু হলেও মানব থেকে যায়। থেকে যায় মানবীও। ভারতের কোনো এক অখ্যাত হাসপাতালে ধুকপুক করে বেঁচে থাকে টানা ৫০০ সপ্তাহ, মুখে খাবার বা পানীয় না তোলার বেপরোয়া জেদ, একা দাঁড়িয়ে থাকার অদম্য সাহস।
আজ, নারী দিবসের দিনে, একবারও কি আমাদের দ্বিধাকম্পিত মধ্যবিত্ত হাতগুলো কপালের কাছে উঠবে না, শর্মিলা চানু কে স্যালুট জানাবার জন্য?