নারী আর নরম নদী
ভোর রাত থেকে মাথা নিচু করে চন্দন বেটেই চলেছি। চন্দনপিঁড়িতে দুফোঁটা চোখের জল পড়ে গেল কেন জানি না। মিশে গেল লেই হয়ে। হাওয়ায় ভেসে আসছে চাপাকান্নার মৃদু শব্দ। ইতিউতি দীর্ঘশ্বাস। পাথরের বাটিতে আঙুল ডুবিয়ে কপালে ছোঁয়াই সে নারীর। প্রায় সাত ঘণ্টা কেটে যাওয়ার পরেও শিশুর মতো নরম ত্বক! মনেই হল না কোনও প্রাণহীন দেহ ছুঁলাম...কই বরফের মতো ঠান্ডাও তো হয়ে যায়নি! তবে কি এখনও বুকে কান পাতলে শোনা যাবে প্রাণসমুদ্রের শব্দ?
শর্মিলা মাইতি
ভোর রাত থেকে মাথা নিচু করে চন্দন বেটেই চলেছি। চন্দনপিঁড়িতে দুফোঁটা চোখের জল পড়ে গেল কেন জানি না। মিশে গেল লেই হয়ে। হাওয়ায় ভেসে আসছে চাপাকান্নার মৃদু শব্দ। ইতিউতি দীর্ঘশ্বাস। পাথরের বাটিতে আঙুল ডুবিয়ে কপালে ছোঁয়াই সে নারীর। প্রায় সাত ঘণ্টা কেটে যাওয়ার পরেও শিশুর মতো নরম ত্বক! মনেই হল না কোনও প্রাণহীন দেহ ছুঁলাম...কই বরফের মতো ঠান্ডাও তো হয়ে যায়নি! তবে কি এখনও বুকে কান পাতলে শোনা যাবে প্রাণসমুদ্রের শব্দ?
বাইরে সবাই অপেক্ষা করছে। শেষ প্রণামের পর বিছানাশুদ্ধই তুলে নিয়ে যাওয়া হবে... আগের দিন ছিল দোল। খবরের কাগজ তলায় রেখে এই পায়েই আবির ছড়িয়ে প্রণাম করেছি। সিঁথিতে লাল আবির দিয়ে আশীর্বাদও করেছেন দু`জনকে। বহুদিন বাদে কুঁচকে যাওয়া ঠোঁটে হাসি। মোবাইলে টুকটাক ফোটোও উঠিয়েছি। এক রাতের ব্যবধানে কী হয়ে গেল!
বিয়ের পর থেকে তাঁকে বিছানাতেই দেখেছি বেশি। সারাদিনের সঙ্গী আরও চারজন। রান্নামাসি, কাজের মাসি, রাতের আয়া, দিনেরও আর একজন। প্রতি দু’দিন অন্তর ডায়ালিসিস। কখনও কষ্টেসৃষ্টে স্বেচ্ছায় এ-ঘর ও-ঘর টেনে টেনে চলা। ফুরিয়েও না-ফুরনো এ জীবনকাহিনি। এত অসুস্থ নারীকে সেই প্রথম এত কাছ থেকে দেখা। বিয়ের পর এ বাড়িতে এসে প্রণাম করতে গিয়ে দেখেছিলাম নারকেল-দড়ির মতো পা। মাঝরাতে কখনও বা হাঁপিয়ে ওঠা শরীরটা জড়িয়ে ধরেছি অ্যাম্বুলেন্সে ওঠানোর আগে। তখনও তাঁর পরতে পরতে মাছের আঁশের মতো শুষ্কতা। এ নারী-নারী সম্পর্কে একটা সমাজনির্দেশিত, টিভিসিরিয়ালচর্চিত শুষ্কতা আছে। মায়ের মতো হয়েও মা হওয়া যায় না। মেয়ের মতো হয়েও মেয়ে হওয়া যায় না। এমন এক অলঙ্ঘ্য যা পেরিয়ে কোনওদিন কাছাকাছি আসা যায় না। সামান্য ভর্ত্সনাই মনে হত তীক্ষ্ণ, বড় তীক্ষ্ণ..
-তোমার বাবা বললেন, ও রান্নাবান্না কিছুই জানে না। আপনাদের খুব অসুবিধে হবে। আমাদের বাড়িতে তো এটা খুব লজ্জার কথা!
-রান্না পারি না বলে আমি লজ্জা পাই না। দরকারমতো ঠিক করে নেব।
-কিছুই না জানলে দরকারেও সামলাতে পারবে না।
আমার ভেতরের উন্নতশির নারী তখন রাগে ফুটছে। যোগ্য উত্তর পাচ্ছি না। এ কোথায় এসে পড়লাম। শুধুই স্টেনলেস স্টিলের বাসন, রান্নার গ্যাস, টিভির উপর জমা ধুলো, জল-না-পাওয়া টবের গাছ নিয়ে এমন যুদ্ধক্ষেত্রে এর পর থেকে বাস করতে হবে! বলি,
-আমার বাবা আমাকে সাধারণ মেয়ের মতো মানুষ করেননি। উনি আমার ভেতরে অসাধারণত্বটা বুঝতে পেরেছিলেন। আমি খবরকাগজে লিখেছি। ছবি এঁকেছি। সিনেমা বানিয়েছি। ঘরের কাজ করতে এনকারেজ করেননি। যা পারি না, চেষ্টা করব সামাল দিতে। তাও যদি আপনার বলতে ভাল লাগে বলুন। কটকটে কথা। কারওর ভাল লাগতে পারে না আমি জানি। একমুখ বিরক্তি নিয়ে তিনি চুপ করেন কয়েক মুহূর্ত। তার পরে আবার শুরু।
-কী জানি! চাকরবাকরের হাতে ঠেলে দিলে সাজানো সংসার ওলটপালট হয়ে যায়। আমি কি আর সাধে বলছি। রাজার বউ আমার কত আদরের... গায়ে শক্তি থাকলে আমিই তো রেঁধে খাওয়াতে পারতাম।
মনে মনে যে কথাটা খুব পছন্দ হয়, তাও নয়। তবু খটাখটি কম লাগানোর চেষ্টা করি।
...দুধটা জ্বাল দেওয়া হল, আর রাজা খেয়ে বেরোল না? সবে গরম দুধটা কড়া থেকে কাঁচের জগে ঢালছি, সেই সময়েই এমন কড়া কথা! সামান্য দুধ নিয়ে!
-আমি তো বলেইছিলাম। আপনার ছেলের আজ অফিসে লাঞ্চ আছে বলে বেরিয়ে গেল।
-বাড়িতে দুধ গরম করলে ওকে খাইয়ে দিও। না হলে ওর মনে থাকবে না। কাজে ব্যস্ত থাকে।
আহা! দুধের ছেলে... মনে মনে বলি। এখনও মায়ের শিশুটি..আবার খাইয়ে দিও! আদিখ্যেতা! কাজে ব্যস্ত থাকে। কেন আমার কাজ নেই! এমনি নানা রাগের বুদবুদ বিজবিজ করে ওঠে। মুখে কিছু বলি না। বাসনপত্র নিয়ে যথেষ্ট আওয়াজ করতে করতে উষ্মা প্রকাশ করি। এমনি ছোট-বড় নানা ঠোকাঠুকি চলতেই থাকল। কোনওদিন নদীর মতো নরম হয়ে বইল না সম্পর্কটা। তবু ভব্যতা ভুলিনি। অফিস বেরনোর আগে, আসি মা। দুজনে কোথাও গেলে, কখন ফিরব তার একটা আইডিয়া। ভাগ্যিস এসব করেছি। আপনার যদি হাসপাতালে যেতে কষ্ট হয়, তবে বাড়িতেই...
-আবার বাড়িতেও নাটক! দরকার নেই, যেতেই তো হবে তার আগে ছেলেকে পথে বসিয়ে যাবার প্ল্যান করে যাব না।
রাজা মুষড়ে পড়ে। কী বলছ মা, উনি তোমার সুবিধের জন্য...
-শোনো বাবা, মেলা খরচা হচ্ছে। যেমন চলছে চলুক। এই অকেজো জীবন আর ভাল লাগে না। ভগবান আমায় ঠিক ডেকে নেবেন। বাড়িটা একেই আয়াদের লঙ্গরখানা হয়েছে। একে আর হাসপাতাল বানাতে হবে না।...
চোখ বুজলেই কত নারীর মিছিল। এ নারীকে খুব কম দিন কাছে পেলাম। সম্পর্কটুকু ঝাড়াই বাছাইয়ের সময়টুকুও দিলেন না। এখন একলার সংসার আর অফিসের নৌকো বাইতে বাইতে হাঁসফাঁস করি। কাপড়কাচার মাসি না এলে আতান্তরে পড়ি। ডাল-ভাত-সবজি-মাছের মধ্যে কখনও কখনও অদ্ভুত সুঘ্রাণ খুঁজতে থাকি। এক অন্য হাতের ছোঁয়া। একটু-আধটু রেসিপি শিখে নিলে ভাল বই খারাপ হত না। অসম্ভব সাপোর্টিভ স্বামী না পেলে আজ এই আমি আর হতে পারতাম না। সারাজীবন সংসারের দাঁড় বেয়ে চলা এই মানুষটি নিজের ছেলের ভার হঠাত্ই আমার ওপর ছেড়ে না দিয়ে অল্পস্বল্প স্বাভাবিক করতে চেয়েছিলেন আমাকে। গেল বছর নারী দিবসের রাতে তিনি চলে গেলেন। আমার বিয়ের ঠিক সাড়ে তিন মাস পরে। জীবনের প্রথম নারী, যাঁকে ভালবাসতে শুরু করেছিলাম তাঁর মৃত্যুর পর থেকে।