লকডাউনে পেটের টান বদলে দিয়েছে পেশা, গৃহশিক্ষকরা আজ সবজি বিক্রেতা
লকডাউনে একমুঠো খাবার জোগাড় করতে শুধু গৃহশিক্ষক নয় রাজ্যের বিভিন্ন জেলার সব জায়গাতেই টৌটো চালক, রিক্সা চালক, রাজমিস্ত্রি-সহ একাধিক পেশার মানুষ হয়ে গেছে সবজি বিক্রেতা
অধীর রায়: করোনা ভাইরাসের জন্য মাস খানেকের উপর রাজ্য জুড়ে লকডাউন। এই লকডাউনে সবচেয়ে সমস্যায় পড়েছেন সমাজের শিক্ষিত মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো। তাঁরা না পাচ্ছে বিনামূল্যে রেশন, না পাচ্ছে ত্রাণের লাইনে গিয়ে দাঁড়াতে। এই অবস্থা রাজ্যের উত্তর থেকে দক্ষিণ, পূর্ব থেকে পশ্চিম, সব জেলাতেই। মাস খানেক ধরে রোজগার বন্ধ। এই অবস্থায় নিজের মুখে এবং পরিবারের মুখে দু’বেলা খাবার তুলে দিতে প্রশান্ত পাত্র, কানাই দাস, দীপক বেরা এবং খোকন বাড়ুইরা বদলে ফেলেছেন তাঁদের পেশা। কেউ ছিলেন গৃহশিক্ষক, কেউ ছিলেন টোটো চালক, কেউ রাজমিস্ত্রির কাজ করতেন। আবার কেউ রিক্সাচালক। সাধারণ সময় এরা সবাই ভিন্ন ভিন্ন পেশায় যুক্ত থাকেন। লকডাউনে সবাই পেশা বদল করে এক পেশায়। কানাই , দীপক , প্রশান্ত সবাই এখন সবজি বিক্রেতা।
প্রশান্ত পাত্র। নন্দকুমার থানার অন্তর্গত শ্রীকৃষ্ণপুর এলাকার বাসিন্দা। নিজে উচ্চশিক্ষিত। এম এ (বিএড) হয়েও একটা চাকরি জোগাড় করতে পারেননি প্রশান্ত। তাই শ্রীকৃষ্ণপুর বাজারের কাছে একটি কোচিং সেন্টার খোলেন। এখানে পঞ্চম থেকে দশম শ্রেণির ছাত্রছাত্রীদের পড়াতেন প্রশান্ত। প্রায় পঁচিশ জন ছাত্র এখানে পড়ে। তাদের পড়িয়ে কোনও রকমে সংসার চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। কিন্তু ছন্দপতন ঘটল লকডাউনে। পনেরো- কুড়িদিন কষ্ট করে চালিয়ে নিলেও আর পারলেন না। জীবনযুদ্ধের লড়াইয়ে হার মেনে প্রশান্ত বদলে ফেললেন পেশা। শিক্ষক হলেন সবজি বিক্রেতা।
লকডাউনের জন্য কোচিং সেন্টার বন্ধ। আয় নেই। তাই সংসার চালাতে হলদিয়া-মেচেদা সড়কের পাশে শ্রীকৃষ্ণপুর বাসস্ট্যান্ডে কোচিং সেন্টারের সামনে কয়েকদিন ধরে সবজি বিক্রি করছেন শিক্ষক প্রশান্ত পাত্র। প্রথম দু’দিন একটু জড়তা ছিল। কিন্তু সৎ পথে আয়ের জন্য কোন কাজ ছোট নয়। ছোটবেলায় এই শিক্ষা পেয়েছেন প্রশান্ত। তাই এখন অনেকটা স্বাভাবিক। প্রশান্ত জানান, "পঁচিশ জন ছাত্রছাত্রী এখানে পড়ে। তা দিয়ে ছ’জনের সংসার কোনও রকমে চলে যেত। কিন্তু লকডাউনের জন্য কোচিং সেন্টার বন্ধ। কেউ পড়তে আসছে না । বেতন পাইনি । ঘরে যে কটা টাকা ছিল তা দিয়ে দিন কুড়ি চালিয়েছি। আর সম্ভব হল না। বাধ্য হয়েই সবজি বিক্রি করছি। এই কাজে ছাড় দিয়েছে সরকার। বেশিদিন হয়নি। তবে যেটুকু আয় হচ্ছে কষ্ট করে চলে যাচ্ছে সংসার ।" তবে লকডাউন উঠে গেলে আবার পুরনো পেশা শিক্ষকতায় ফিরে যাবেন প্রশান্ত পাত্র ।
লকডাউনে একমুঠো খাবার জোগাড় করতে শুধু গৃহশিক্ষক নয় রাজ্যের বিভিন্ন জেলার সব জায়গাতেই টৌটো চালক, রিক্সা চালক, রাজমিস্ত্রি-সহ একাধিক পেশার মানুষ হয়ে গেছে সবজি বিক্রেতা। কেন এক পেশায় সবাই ভিড় করেছে। এই প্রশ্নে শ্যামনগরের কানাই, মদনপুরের দীপক এবং হালিসহরের বিমলদের মুখে একই কথা, সবকিছু বন্ধ। কোন যাত্রী নেই। রাস্তায় টোটো-রিক্সা বার করে কোনও লাভ হচ্ছে না। লকডাউন চলাকালীন মাঝে কয়েকদিন বেড়নোয় পুলিশের লাঠি পেটায় সেটাও বন্ধ হয়ে গেছে।
আরও পড়ুন- টাকা ফুরিয়েছে, তাই গুহায় কাটাচ্ছিলেন ৬ বিদেশি; তাঁদের ঋষিকেশের আশ্রমে পাঠাল পুলিস
টোটো চালক বিমল বলেন, ‘ঘরে বসে থাকলে পরিবার নিয়ে না খেতে পেয়ে মরে যাব। আমাদের দৈনিক আয় । সেই ভাবে আমরা চলে অভ্যস্ত। তাই ঠিক করলাম সবজি বিক্রি করব।” শ্যামনগরের কানাইয়ের কথায়, ‘লকডাউনে এই ব্যবসায় ছাড় আছে । আর আমাদের এখানে পঞ্চায়েত এলাকায় প্রচুর চাষ হয়। লকডাউনের আগে আমরাই চাষীদের মাল পৌঁছে দিয়ে আসতাম। ওদের সাথে আমাদের পরিচয় আছে। তাই এই ব্যবসা করতে সুবিধা হল। দু’জন পুঁজি লাগিয়ে একটা ভ্যান ভাড়া করে সবজি বিক্রি করছি। আমরা তো কোন বাজারে বসতে পারব না। তাই সকাল বিকেল বিভিন্ন পাড়ায় পাড়ায় সবজি করছি। দিনের শেষে যা আয় হচ্ছে দু’জনে ভাগ করে নিচ্ছি। লকডাইন বাড়ায় আরও অনেক পেশার মানুষ এই ব্যবসা করছে। সবাই এই ব্যবসায় চলে আসায় প্রথমে যে পয়সা আয় করতাম তা এখন আর হয় না । তবে চলে যাচ্ছে। না খেতে পেয়ে মরছি না।"
লকডাউনে যাদেরই রুজি রোজগার টান পড়েছে তাঁরা সবাই সবজি বিক্রেতা হয়ে যাওয়ার ফলে প্রকৃত যারা সবজি ব্যবসায়ী তাদের মাথায় হাত। বাসু, শ্যামল, বাপি এরা প্রত্যেকেই সবজি বিক্রেতা। তাঁরা জানাচ্ছেন, যারা দু’দিনের জন্য এই ব্যবসা করছে তারা পাড়ায় পাড়ায় মানুষের বাড়ি চলে যাচ্ছে। লকডাউনে ঘরের সামনে বাজার পেয়ে মানুষের বাজারে আসার স্রোত আগের থেকে অনেক কম। যার ফলে বাসু-শ্যামলদের পুরনো ব্যবসা মার খাচ্ছে । প্রচুর লোক এই ব্যবসায় চলে আসায় চাষিদের ঘরে মাল থাকছে না। জোগানের চেয়ে চাহিদা বেশি। ফলে জিনিসের দাম উল্টোপাল্টা নিচ্ছে বলে অভিযোগ তাঁদের। বাড়ি সামনে সবজি পাচ্ছেন এমন মানুষের বক্তব্য, "যাক দিন আনে দিন খায় মানুষগুলো কিছু করে তো এই পরিস্থিতিতে খেয়ে বেঁচে আছে। না-হলে চুরির পরিমাণ বেড়ে যেত।"