কো জাগর! কিন্তু কে জাগবে এই তুমুল অন্ধকারে!
এক অতলান্ত ঘুমের ভিতের সেঁধিয়ে গিয়েছে সমাজ
সৌমিত্র সেন
আগামীকাল কোজাগরী লক্ষ্মীপুজো। কোভিড-পরিস্থিতিতে নিশ্চিত ভাবেই ধাক্কা খাবে এই পুজোর আয়োজন। শ্রী ও সম্পদের দেবীর আরাধনা করতে গিয়ে মানুষ দেখবেন, তাঁর হাতে শ্রী-ও নেই, সম্পদও নেই! করোনা, লকডাউন, কোয়ারান্টিন তাকে ভীষণরকম বি'শ্রী' করে দিয়েছে।
কিন্তু, ধরা যাক, এই পরিস্থিতির মধ্যেও মানুষ পুজো করলেন মা লক্ষ্মীর। যথারীতিই করবেন বলে মনস্থির করলেন। ঠিকই, ছানাপোনা নিয়ে সংসারধর্ম করতে গেলে লক্ষ্মীকে তো তুষ্ট রাখতেই হবে!
কিন্তু এই লক্ষ্মীপুজোর সঙ্গে রাত জাগার একটা অনুষঙ্গ আছে। এই পৌর্ণমাসী রাত্রি জাগরণের পিছনে তত্ত্বটা হল: মা সেদিন ঘুরে ঘুরে দেখেন, কোথায় তাঁর উপযুক্ত আরাধনা চলছে; যেখানে তুষ্ট হন, সেখানেই অধিষ্ঠান করে তিনি কৃপা করেন ভক্তকে। ভক্তকে তাই এ পুজোয় রাত জেগে বসে থাকতে হয়।
তবে এ পুজোয় যে শুধু শরীরটাই জাগিয়ে রাখতে হয়, তা নয়; মনকেও জাগিয়ে রাখতে হয়। মন, বুদ্ধি, বিবেক, শ্রদ্ধা, অন্তরাত্মাকে উপচারের মতো প্রস্তুত করে অপেক্ষা করতে হয়।
অথচ, কী আশ্চর্য! এ দেশের সাম্প্রতিক গণবোধ থেকে সর্বতোভাবে এই 'জেগে থাকা'র সংস্কৃতিটাই ক্রমশ লুপ্ত হয়ে গিয়েছে। এক আমিষ তিমিরে ভরে উঠেছে রাজ্য-রাজনীতি, দেশ ও দশ। সেখানে বিরাজ করছে এক অশেষ অটল ঘুম। সেই ঘুমের দরজা ঠেলে বেরিয়ে আসছে না কোনও স্বর, কোনও সঙ্কল্প, কোনও প্রজ্ঞা।
সব ধরনের প্রতিবাদকে, প্রশ্নকে, চেপে দেওয়া, সরিয়ে রাখা, ঠেলে দেওয়ার যে অমিত আমোদিত পুরুষাকার তার সঙ্গে লক্ষ্মীশ্রীর সুদূরতম যোগাযোগও নেই!
এই মুহূর্তে কেন্দ্রে সাংখ্যযোগমগ্ন এমন এক সরকার আত্মযাপনে মুগ্ধদিন কাটাচ্ছে, যাদের কাছে সংখ্যাই শক্তি। সেই শক্তিতে বলীয়ান হয়ে তারা যা-ইচ্ছে-তাই করে চলেছে। অথচ, দেখাচ্ছে, সবই যেন সাধারণ পদ্ধতিতে স্বাভাবিক মর্যাদায় সম্পাদিত হচ্ছে। আপাত ভাবে হয়তো তাই-ই। কিন্তু নিভৃত শক্তির এক নিবিড় উপস্থিতি সেখানে সদা সর্বদা নিশ্বাস ফেলছে। ভার্চুয়াল পেশিশক্তির মধ্যে সম্ভবত মুখোমুখি গা-জোয়ারির চেয়েও বেশি নগ্নতা, বেশি অবমাননা কাজ করে।
এমন এক বেলা-অবেলা-কালবেলায় কে জাগবে? কাকেই-বা জাগাবে? যেখানে-যেখানে মানুষ সত্যের বিচার পেতে পারে বলে মনে করা হয়, সেখানেই তো বোবা ব্যারিকেড! সেখানেই তো বিপরীত দিকের মানুষগুলির মগজে কারফিউ। যে গণশক্তিকে কাগজে-কলমে সর্বথা প্রশংসা করা হয়, সেই গণকণ্ঠরোধেরই কত রকম বিশুদ্ধ আয়োজন যে দেশ জুড়ে! নাগরিকত্ব সংশোধন নিয়ে তা হলে কারও কিছু বলার থাকতে পারে না? রাতারাতি কারেন্সি পালটে ফেলার সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়া যায় দেশবাসীর ঘাড়ে? অতিমারী নিয়ন্ত্রণে সমাজের সব স্তরের কথা না ভেবেই লাগু করা যায় দেশজোড়া নিয়মের শাসন? হাঁটতে-হাঁটতে মরে যাওয়া শ্রমিকদের জন্য কোনও অশ্রু থাকতে নেই! অবলীলায় পাস করিয়ে নেওয়া যায় কৃষকদের বিপন্ন করে-তোলা কোনও বিল? 'কোনও প্রশ্ন নয়'?
কারও মৃত্যু কীভাবে হল, তা নিয়ে কোনও জিজ্ঞাসা জাগবে না? ধর্ষণ হবে, অথচ তা নিয়ে অভিযোগ জানানো যাবে না? মাদকের অন্ধকারে ডুবে-যাওয়া মানবসমাজ নিয়ে কোনও দ্বিরুক্তি করা যাবে না! স-ব স-ব কিছু একদিন-না-একদিন ঠিক রাজনীতির কুমিরের পেটের ভেতর ঢুকে অম্লানমুখে বেগুন বেচবে! কেউ বলবে না কোনও কথা, কেউ তুলে আনবে না কোনও ঝরাপালক, কেউ খুলবে না কোনও ধূসর পাণ্ডুলিপি, জীবনের সমস্ত প্রভাতসঙ্গীত-সন্ধ্যাসঙ্গীত বন্ধ থাকবে, কথাহীন বলাকারা সমস্ত পাখা অন্ধ-বন্ধ করে পড়ে থাকবে নিস্পৃহ, নিশ্চেষ্ট? কেউ বাজাবে না অগ্নিবীণা?
না, শ্মশানের শান্তিই বরং ভবিতব্য এ দেশে। রাজনৈতিক খুন, গার্হস্থ্য হিংসা, সামাজিক দূষণ-- সবই এখানে নিয়মবদ্ধ নিয়মানুবর্তিতায় জেগে থাকবে। জেগে থাকবে না শুধু বিবেক, জেগে থাকবে না শুধু প্রশ্ন, জেগে থাকবে না শুধু প্রতিবাদ!
কোজাগরীতে তাই পুজোর নৈবেদ্য থাকবে, থাকবে না কর্কশ চিৎকার করা ওই পেঁচাটি। কোজাগরীতে তাই আকাশভরা চাঁদের আলো থাকবে, থাকবে না শুধু মননের জ্যোৎস্না! কোজাগরীতে তাই লক্ষ্মীর আসন পাতা থাকবে কিন্তু থাকবে না সেই পদ্মটি! আর ঠাঁই-না-পাওয়া লক্ষ্মীশ্রী ঘুরে ঘুরে বেড়াবেন। হেমন্তের হিমের ভিতরে জমে থাকবে শুধু মসৃণ অন্ধকার।
আরও পড়ুন: বর্ষার বিদায়, হিমেল হাওয়া ভোরের কাঁপুনি! বঙ্গে কবে ঢুকছে শীত?