Surajit Sengupta Passed Away: ৭৫-এর ডার্বিতে কোন অপমানের বদলা নিয়েছিলেন 'শিল্পী' সুরজিৎ? স্মৃতিচারণে শ্যাম থাপা, রঞ্জিত মুখোপাধ্যায়
১৯৭৫ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর মোহনবাগান মাঠে আইএফএ শিল্ড ফাইনালের সেই ঐতিহাসিক ডার্বিতে নামার আগে টগবগ করে ফুটছিলেন সুরজিৎ।
সব্যসাচী বাগচী: প্রতিটা জয়ের প্রেক্ষাপটে থাকে একটা লড়াইয়ের গল্প। তবে সেই গল্প যদি শুধু লড়াইয়ে আটকে না থেকে, সেই গল্প তীব্র অপমানের হলে যোদ্ধার শরীরে রক্তক্ষরণ একটু বেশি মাত্রায় হয় বৈকি!
সদ্য প্রয়াত 'শিল্পী' ফুটবলার সুরজিৎ সেনগুপ্তের ক্ষেত্রেও তেমনটাই হয়েছিল। ১৯৭৫ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর মোহনবাগান মাঠে আইএফএ শিল্ড ফাইনালের সেই ঐতিহাসিক ডার্বিতে নামার আগে টগবগ করে ফুটছিলেন লাল-হলুদের সদ্য প্রয়াত যোদ্ধা সুরজিৎ। কারণ এর ঠিক দুই বছর আগে ১৯৭৩ সালের শেষ দিকে মোহনবাগান কর্তারা তাঁকে 'হাইজ্যাক' করেছিলেন! সেই অপমান ভুলতে পারেননি সুরজিৎ। তাই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীর বিরুদ্ধে বদলা নেওয়ার জন্য মাঠে নেমেছিলেন তিনি। সেই গল্প শোনালেন '৭৫-এর ৫-০ ব্যবধানে জয়ের দুই কারিগর শ্যাম থাপা ও রঞ্জিত মুখোপাধ্যায়।
খরদহের রঞ্জিত বলছিলেন, "সেই ফাইনাল খেলতে নামার আগে সুরজিতের মধ্যে অদ্ভুত এক তাগিদ দেখেছিলাম। ১৯৭৩ সালের শেষ দিকে দলবদলের সময় মোহনবাগান সুরজিৎকে 'হাইজ্যাক' করে ডায়মন্ড হারবারের একটি হোটেলে নিয়ে চলে যায়। পুরো ঘটনার নেপথ্যে ছিলেন প্রবাদপ্রতিম শৈলেন মান্না। বিষয়টা লাল-হলুদ কর্তাদের কানে যেতেই ওরা সুরজিতের ব্যান্ডেলের বাড়িতে পৌঁছে যায়। সেই কর্তাদের নির্দেশে 'মান্না দা-র' বিরুদ্ধে চুঁচুড়া থানায় ডায়েরি করেছিলেন সুরজিতের বাবা। ব্যাপারটা সেই সময় ধামাচাপা পড়ে গেলেও সুরজিৎ কিন্তু অপমান ভুলে যায়নি।"
আরও পড়ুন: Surajit Sengupta Passed Away: কিংবদন্তির প্রয়াণে শোকস্তব্ধ মুখ্যমন্ত্রী করলেন আবেগি টুইট
১৯৭৫-এর সেই ডার্বির আগে সবুজ-মেরুন বেশ কোণঠাসা ছিল। ১৯৬৯ সালে আইএফএ শিল্ডের পর সবুজ-মেরুন তাঁবুতে কোনও ট্রফি ঢোকেনি। অন্যদিকে ১৯৭০ থেকে ১৯৭৫ – টানা ছয় বছর কলকাতা লিগ জিতে উজ্জীবিত ছিল। সঙ্গে যোগ হয়েছিল টানা চার বার আইএফএ শিল্ড জয়ের রেকর্ড।
ম্যাচের প্রথমার্ধেই ইস্টবেঙ্গল ৩-০ গোলে এগিয়ে যায়। পেনাল্টি মিস না করলে প্রথমার্ধে ব্যবধান হয়তো ৪-০ হয়ে যেত। প্রথম গোলটি এসেছিল সুরজিতের পা থেকে। গোল করা ছাড়াও আর কি ভূমিকা পালন করেছিলেন সদ্য প্রয়াত?
আরও পড়ুন: Surajit Sengupta Passed Away: ৭০-এ থামল লড়াই, বন্ধু সুভাষের কাছে চলে গেলেন সুরজিৎ সেনগুপ্ত
রঞ্জিত যোগ করলেন, "আমাদের কোচ প্রদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশে সে দিন সুভাষ ভৌমিক ও সুরজিৎ দুটি উইং থেকে সুইচ করে খেলছিল। কারণ ছিল বিপক্ষের দিলীপ পালিত। ময়দানে কথিত ছিল যে ডিফেন্ডার দিলীপ পালিতকে নাকি ভয় পেত সুরজিৎ। তবে প্রদীপ দা ক্ষুরধার মস্তিস্ক দিয়ে সেই মিথ ভেঙে দিয়েছিলেন। সেই সুবাদেই সুরজিৎ গোল করে দলকে এগিয়ে দেয়।"
কীভাবে হয়েছিল প্রথম গোল? রঞ্জিত যেন ধারাবিবরণী দিলেন। জুড়লেন, "ম্যাচের পাঁচ মিনিটেই এগিয়ে যায় ইস্টবেঙ্গল। সমরেশ চৌধুরীর একটা ফ্রি কিক সুব্রত ভট্টাচার্য ও নিমাই গোস্বামীর ঠিক মাঝ থেকে বুকে রিসিভ করে পায়ে নামাই। সেই বলকে নাগালে পেতেই জোরালো ভলি করেছিল সুরজিৎ। এমনকি খেলার তৃতীয় ও চতুর্থ গোলেও ছিল সুরজিতের পায়ের ছোঁয়া।"
দ্বিতীয়ার্ধেও ইস্টবেঙ্গল সেই একই ভাবে আক্রমণাত্মক খেলা চালিয়ে যেতে থাকে। সেই সুবাদে এসেছিল আরও দু’টো গোল। শ্যাম থাপা দ্বিতীয়ার্ধের ৫১ মিনিটে নিজের দ্বিতীয় গোল করেছিলেন। ঘরের মাঠে কাঁধ ঝুলে যাওয়া বাগানকে আরও তছনছ করে দিয়েছিলেন শ্যাম থাপার বদলি হিসেবে নামা শুভঙ্কর সান্যাল। ৮৪ মিনিটে বাগানের কফিনে শেষ পেরেকটি পুঁতে দিয়েছিলেন।
সদ্য প্রয়াত তাঁর কেরিয়ারে একাধিক ডার্বি খেলেছেন। তাই সেই ম্যাচের জোড়া গোলদাতা শ্যাম তাঁর কাছের বন্ধুকে স্রেফ একটি ম্যাচের জন্য বিচার করতে রাজি নন।
তাঁর মতে, "সেই সময় আমরা চার স্ট্রাইকার নিয়ে খেলতাম। সুরজিৎ সেই লাইন অপে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। একজন স্ট্রাইকারের পাশাপাশি সুরজিৎ দক্ষ রাইট উইঙ্গার ছিল। সঙ্গে ছিল দারুণ স্কিল, সেন্টার মারার দক্ষতা ড্রিবিল করা ও চোখের নিমেষে বল পায়ে নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা। আমার মতে ও ভারতের সেরা শিল্পী ফুটবলার। "
খেলার ফল ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছিল জনমনে। এক দিকে চরম লজ্জা আর বিষাদ, অন্য দিকে আনন্দের তুফান। সে দিন নিজের প্রিয় দলের ৫ গোলে হারের লজ্জা সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করেছিলেন কট্টর মোহনবাগান সমর্থক উমাকান্ত পালোধি। সুইসাইড নোটে তিনি লিখে যান, “পরের জন্মে মোহনবাগানের ফুটবলার হয়ে আমি এর প্রতিশোধ নেব।”
৪৬ বছর পরেও মোহনবাগান তাঁবুতে সেই হারের হাহাকার রয়েছে। সঙ্গে রয়েছে আফশোস। তবে সদ্য প্রয়াত সুরজিতের তো আফশোসের কোনও বালাই নেই। কারণ অপমানের বদলা তাঁর আগেই নেওয়া হয়ে গিয়েছিল।
'৭৫-এর সেই ঐতিহাসিক ম্যাচে জয়ী দলের কোচ পিকে আগেই চলে গিয়েছিলেন। এ বার তাঁর সঙ্গে যোগ দিলেন দুই ছাত্র সুভাষ ও সুরজিৎ। রয়ে গেলেন শ্যাম থাপা, রঞ্জিত মুখোপাধ্যায় ও শুভঙ্কর সান্যাল।
ক্ষুরধার মস্তিষ্কের কোচের সঙ্গে ইতিমধ্যেই আড্ডা জুড়ে দিয়েছেন তাঁর দুই ছাত্র। একজন 'বুলডোজার', অন্যজন 'শিল্পী'। ভবিষ্যতে একদিন এই আড্ডায় শ্যাম এবং রঞ্জিতও যোগ দেবেন। যোগ দিতেই হবে।
কারণ, মৃত্যু সবচেয়ে বড় সত্য।