Subhash Bhowmick Died: পাঁচ গোলের গর্ব ও লজ্জা নিয়েও ‘টাইগার আজীবন জিন্দা হ্যায়’
৭৩-এ থামলেন বহু বিতর্কিত সুভাষ ভৌমিক।
সব্যসাচী বাগচী: সদ্য প্রয়াত সুভাষ ভৌমিকের জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে দুটি ডার্বি। একটা সুখের। ভারতীয় ফুটবলে সোনার অক্ষরে লেখা রয়েছে। অন্যটা লজ্জার। খুবই যন্ত্রণার।
১৯৭৫ সালে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী মোহনবাগানের বিরুদ্ধে ৫-০ গোলে জয়। সেই ঐতিহাসিক ম্যাচে গোল না করলেও, সতীর্থ রঞ্জিত মুখোপাধ্যায়কে দিয়ে একটা গোল করিয়েছিলেন। আর ডার্বি হারের লজ্জা জুটেছিল প্রিয় লাল-হলুদের কোচ হিসেবে। ২০০৯ সালের এক ডার্বি যুদ্ধে তাঁর কিছু ভুল সিদ্ধান্তের জন্য ৩-৫ গোলে হেরে গিয়েছিল লাল-হলুদ।
তাই তো ৪৬ বছর পরে মোহনবাগান তাঁবুতে সেই ৫-০ ব্যবধানে হারের হাহাকার রয়েছে। সঙ্গে একরাশ আফশোস। সেই হারের বদলা না নিতে পারার যন্ত্রণা। তবে সুভাষ বরাবরের মতোই নির্লিপ্ত। কারণ তিনি যে শেষ জীবন পর্যন্ত পাঁচ গোলে হারের জ্বালা বহন করেছিলেন।
তাই তো পাঁচ গোলের সেই দুটি ম্যাচের প্রসঙ্গ উঠলে এই প্রতিবেদককে একবার সদ্য প্রয়াত সটান বলে দিয়েছিলেন, “ওই সব পাঁচ-টাচ গোলের কথা ভুলে গেছি। মাদকতা নিয়ে বেঁচে থাকুন সমর্থক আর কর্তারা। ওদের মনে থাকতে পারে। আমার কিছুই নেই।“
ঠিকই তো! যে মানুষটা কম বয়সে নিজের প্রথম সন্তান হারিয়েছিলেন, যে মানুষটা হাঁটুর মারণ চোট নিয়ে সবুজ-মেরুনের হয়ে সর্বস্ব উজাড় করে দেওয়ার পরেও সেই ক্লাব থেকে প্রাপ্য সম্মান পাননি। খেলোয়াড় ও কোচ দুই জীবনেই সবুজ-মেরুন কর্তাদের থেকে জুটেছিল তীব্র অসম্মান। এমনকি প্রিয় লাল-হলুদকে আন্তর্জাতিক মঞ্চে তুলে ধরার পরেও তাঁকে অবহেলা করা হয়েছে। তাঁর তো এমন নির্লিপ্ত থাকা খুবই স্বাভাবিক।
ইস্টবেঙ্গলকে ২০০৩ সালে আশিয়ান কাপ, দুটি জাতীয় লিগ, একাধিক অন্য ট্রফি, চার্চিল ব্রাদার্সকে আই লিগ এনে দেওয়ার পরেও তাঁকে সাধের কোচিং ছেড়ে নিউ আলিপুরের বাড়িতে বসে থাকতে হয়েছিল। কারণ সুভাষের কাছে ছিল না কোচিং লাইসেন্স। তবে সেটা নিয়ে তাঁর বিন্দুমাত্র আফসোস ছিল না। বরং লাইসেন্স না থাকার খোঁটা দিলেই সামনের লোকজনকে তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলে দিতেন, “আমার লাইসেন্স সল্টলেকের বাড়িতে থাকা গুরুর কাছে রাখা আছে। ওঁর কাছেই যে নাড়া বেধেছিলাম!“
তবে ১৯৭৫-এর ৩০ সেপ্টেম্বরের ডার্বিতে ইস্টবেঙ্গলের সেই পাঁচ গোলের প্রসঙ্গ উঠলে এখনও শ্যাম থাপা ও রঞ্জিত মুখোপাধ্যায়ের চোখ চিকচিক করে ওঠে। সেই ম্যাচে জোড়া গোল করা শ্যাম থাপা বলছিলেন দুজনের বন্ধুত্বের কথা। বলছিলেন, “সুভাষের সঙ্গে আমার কত স্মৃতি জড়িয়ে। ১৯৭০ সালে যখন ও আর আমি একসঙ্গে জাতীয় দলে সুযোগ পাই, তখন বোম্বেতে আমার রুমে এসে চিৎকার করে জানিয়েছিল প্রথম সে কথা। সেই থেকে আমরা বন্ধু। কলকাতাতে আমি যখন আসি তখন ওই আমার বন্ধু ছিল। আমার মনে আছে রোভার্স কাপে ১৯৭১ সালে একবার জেসিটির বিরুদ্ধে ম্য়াচ ছিল। তখন আমরা ইস্টবেঙ্গলে। সেই ম্যাচে ২-১ গোলে পিছিয়ে ছিলাম আমরা। কিন্তু সুভাষই পুরো দলটাকে চাঙ্গা রাখার চেষ্টা করছিল। মাঠেই প্রতিপক্ষের প্লেয়ারের সঙ্গে হাতাহাতিতে জড়িয়ে পড়ে ও। আমাকেও সেই সময় ওঁর পাশে দাঁড়াতে লড়াইয়ে জড়াতে হয়েছিল। মনে আছে, রীতিমতো বক্সিং করেছিলাম যেন সে দিন।“
আরও পড়ুন: Exclusive: বিদায়বেলায় প্রিয় ‘ভোম্বল দা’কে নিয়ে আবেগপ্রবণ Bhaichung Bhutia
আরও পড়ুন: Subhash Bhowmick Died: ‘ইউ চাইম্যান, আই অ্যাম ষষ্ঠী দুলে’, সুভাষ স্মৃতিতে বিভোর লড়াকু ছাত্র
কিছুটা থেমে ফের যোগ করলেন, “আমার মনে হয় ওঁ একজন কমপ্লিট ফুটবলার ছিল। অনেকেই বলত যে আন্তর্জাতিক ম্যাচে খেলার জন্য সঠিক ফুটবলার নয় সুভাষ। কিন্তু আমার কোনওদিনই তেমন মনে হয়নি। যেমন ফুটবলার, তেমন চেহারা। ফরোয়ার্ড লাইনে অন্যতম সেরা ছিল সুভাষ। আমরা বাংলায় খেলেছি দীর্ঘদিন। দেশের হয়েও খেলেছি। ১৯৭০-এ এশিয়ান গেমসে একসঙ্গে খেলেছি। বিদেশে প্রচুর ম্যাচ একসঙ্গে খেলেছি। হোটেল আমার রুম পার্টনার ছিল। প্রচুর ঠাট্টা মজা করত। কত স্মৃতি মনে পড়ছে। কিন্তু সব কেমন যেন ওলোটপালট হয়ে গেল!”
সেই ১৯৭৫ সালের পাঁচ গোলে ম্যাচ যেন রঞ্জিতের চোখের সামনে এখনও ভেসে ওঠে। তিনি বেশ আবগের সঙ্গে বলছিলেন, “আসলে ১৯৭৩ সালে মোহনবাগান থেকে বিদায় নেওয়ার ব্যাপারটা সুভাষ দা একদম মেনে নিতে পারেনি। হাঁটুর মারাত্মক চোটের জন্য ওঁর কেরিয়ার শেষ হয়ে যেতে পারত। কিন্তু জীবনের পরোয়া না করেও মহনবাগানের জন্য দারুণ পারফরম্যান্স করেছিল। কিন্তু সেই ভাল খেলার প্রতিদান ও পায়নি। তাই পাঁচ গোলের সেই ম্যাচের আগে সুভাষ দা উত্তেজনায় ফুটছিল। সেই ম্যাচে গোল না করলেও, সুভাষ দা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত অনবদ্য ছিল। আমার গোলটা তো সুভাষ দা করে দিতে পারত। কিন্তু ওঁ স্বার্থপ্পর ছিল না। তাই ভাস্কর স্পট করে উঠতেই আমাকে বল বাড়িয়ে দিয়েছিল। আজ সেই মুহূর্তগুলো খুব মনে পড়ছে।“
দেশের অন্যতম সফল কোচের কথাগুলো আরোপিত মনে হয়। ফুটবলার জীবনের প্রতিটি ঘটনা যাঁর মস্তিষ্কের কোটরে মজুত। বলে যেতে পারতেন নিরন্তর। ম্যাচ রিডিং ও ফুটবলবোধ ছিল অন্যদের কাছে শিক্ষার বিষয়। তাই ৫-০ ব্যবধানে জয় কিংবা ৩-৫ ব্যবধানে হার নিয়ে তিনি ভাবতেই নারাজ ছিলেন।
৫-০-র বদলা কি ৩-৫? সেটা নিয়ে একটা সময় ময়দানে,পাড়ার চায়ের ঠেকে তর্কের তুফান উঠে যেত। সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে সেটা এখন টুইটারে, ফেসবুকে দুই প্রধানের ফ্যান ক্লাবগুলো বহন করে চলে। বেঁচে থাকার সময় সুভাষ সেগুলো শুনতেন। একইসঙ্গে হজম করতেন ভালবাসা ও কটাক্ষ। তবে গায়ে মাখতেন না। বরং তাচ্ছিল্যের হাসি ঠোঁটের কোণায় নিয়ে এগিয়ে যেতেন।
বলতেন, “ধুস যে কম বয়সে খেলা ছেড়ে দিয়েছে, যে মানুষটা বড় ছেলে চলে যাওয়ার পরেও আত্মহত্যা করেনি, তার কাছে এই সব হার-জিত ম্যাটার করে না। এখন বিশ্ব ফুটবল দেখার পর ওসব পাঁচ-ছয় গোলের কোনও মূল্য নেই। ওটা একটা দিনের ব্যাপার। বরং ইস্টবেঙ্গলের টানা ছয় বার কলকাতা লিগ জেতাটা বড় ব্যাপার। যত্তোসব বস্তাপচা জিনিস নিয়ে নাড়াচাড়া।’’
সদ্য প্রয়াত মানুষটা ওঁর ফেসবুক প্রোফাইলের স্ট্যাটাসে লিখেছিলেন, ‘টাইগার জিন্দা হ্যায়’। কালের নিয়মে মানুষকে তাঁর শরীর ছেড়ে দিতে হয়। শনিবার থেকে তাঁর নামের পাশে ‘প্রয়াত’ শব্দটা জুড়ে গেল। তবে থেকে গেল কীর্তি ও বিজ্ঞানমনস্ক ফুটবলবোধ। সে গুলো নিয়েই চলে বছরের পর বছর ধরে আলোচনা। তাই এই ‘টাইগার’ আজীবন ভারতীয় ও বিশেষ করে বঙ্গ ফুটবলপ্রেমীদের কাছে জিন্দা থাকবেন।