দিল্লির সরকার বদলায়, ডেয়ার ডেভিলসরা নয়, নাইটরা একটু বেশিই ডাকাবুকো
স্বরূপ দত্ত
নবম আইপিএলে কেকেআরের প্রথম ম্যাচের পর যে নটা জিনিস মনে হল সেগুলোই জানিয়ে দিই একবার। তার আগে একবার বলে নেওয়া, হাসতে হাসতেই জিতলেন কলকাতার নাইটরা। প্রথমে ব্যাট করে ডেয়ারডেভিলসরা যেভাবে ৯৮ তুললেন, তাতে বিভিন্ন চ্যানেলগুলোর ওপিনিয়নেক জোটের পারফরম্যান্সের মতো মনে হল! এবার যে কথাগুলো বলার তার আগে ম্যাচের সংক্ষিপ্ত বিবরণ - এদিন টস জিতেছিলেন নাইট অধিনায়ক গৌতম গম্ভীর। টস জিতে ফিল্ডিং নেন তিনি। দিল্লি যেন ব্যাটিংটা শুরু করল, কালকের মুম্বই যেভাবে শুরু করেছিল সেভাবেই। তাই প্রথম ১০ ওভারে মাত্র ৫৫ রানে ৫ উইকেট! প্রথম উইকেট পড়তে যা ২৪টা রান দরকার হল। তারপর থেকে ধারাবাহিকভাবে বিজ্ঞাপন আসার মতো একটু পর পরই উইকেটের পতন। দুই অঙ্কের রান পেলেন কুইন্টন ডিকক (১০ বলে ১৭ রান), সঞ্জু স্যামসন (১৩ বলে ১৫ রান), পবন নেগি (১৯ বলে ১১ রান), ক্রিস মরিস (৯ বলে ১১ রান)। এছাড়া মায়াঙ্ক আগরওয়াল করলেন ১১ বলে ৯ রান। শ্রেয়শ আইয়ার তিন বল খেলে শূন্য রান করে ফেরেন। করুন নায়ারের অবদান ৮ বলে ৩ রান। আর বিশ্বকাপ ফাইনালের নায়ক ফিরলেন ৪ বলে ৬ রান করে। ওই ৬ রান অবশ্যই প্রিয় ইডেনে একটা বিশাল ছক্কা মেরেই। ফলে দিল্লি তোলে ১৭.৪ ওভারে মাত্র ৯৮! নাইটদের হয়ে এদিন ৩ টি করে উইকেট নিলেন ব্র্যাড হগ এবং আন্দ্রে রাসেল। দুটো উইকেট নিয়ে গেলেন পীযুষ চাওলা এবং হেস্টিংস। জবাবে ব্যাট করতে নেমে ১৪.১ ওভারে ১ উইকেটে ৯৯ তুলে দিলেন নাইটরা। গম্ভীর অপরাজিত থাকলেন ৪১ বলে ৩৮ রান করে আর মণীশ পাণ্ডে অপরাজিত থাকলেন ১২ বলে ১৫ রান করে। উথাপ্পা করেন ৩৩ বলে ৩৫ রান! নাইটরা প্রথম ম্যাচ জিতে গেলে ৯ উইকেটেই!
১) দিল্লির সরকার পরিবর্তন হয়, কিন্তু দিল্লি আইপিএলে একইরকম - ছেলেবেলায় জোক শুনেছিলাম, একটা লোককে বয়স জিজ্ঞেস করলে, তিনি বছরের পর বছর একই উত্তর দিতেন। এতে প্রশ্নকর্তা একদিন জিজ্ঞেস করলেন, সে কি! ৫ বছর আগেও তো তোমার একই বয়স বলেছিলে! তখন উত্তরদাতা বলেছিলেন, আরে মশাই, আমি ভদ্রলোক। ভদ্রলোকের এক কথা। আইপিএলে দিল্লির ডাকাবুকো বা হোমড়া-চোমড়াদের ন'বছরের পারফরম্যান্স বিচার করলে এই কথাটাই বলা যায়, দেশের রাজধানী বলে কথা। সব বড় বড় ব্যাপার। তাই একই পারফরম্যান্স। চেষ্টা করেও কেউ এর বিন্দুমাত্র উন্নতি করতে পারবে না।
২) রাহুল দ্রাবিড় দুজনের মধ্যে দ্বিতীয় - কথাটা ভাবতেও ভালো লাগে না। লিখতেও না। অথচ, বাস্তব যে এটাই বলে। তিনি যখন যা করেছেন, দারুণ করেছেন। লা জবাব। কিন্তু সেরা তিনি নন। সেই শিরোপা অন্য কেউ নিয়ে গিয়েছে। রাহুল দ্রাবিড় ক্রিকেট ছেড়ে কোচিংয়ে এসেও একই পারফরম্যান্স করে যাচ্ছেন। অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপেও দ্বিতীয়ই হয়েছিলেন দল নিয়ে। নবম আইপিএলে যা শুরু করলেন, তাতে দ্বিতীয় হওয়া অনেক দূর দেখাচ্ছে। দিল্লিতে থেকেই বুঝবেন, দিল্লি আসলে কতটা দূর!
৩) ব্র্যাড হগের বয়স বাড়ে না - জন্ম ১৯৭১ সালে! সেই যেবার বাংলাদেশ স্বাধীন হল! এখন তাঁর বয়স মাত্র ৪৫ বছর। তিনিও সেই ভদ্রলোকের মতো একই বয়স না বলে, পারফরম্যান্সটা ভদ্রস্থ করে যাচ্ছেন। এদিনও বলে বলে ৪ ওভারে মাত্র ১৯ রানে ৩ উইকেট নিয়ে গেলেন! কে বলে টি২০ কম বয়সীদের খেলা! তাঁর থেকে ছোট রাহুল দ্রাবিড় বিপক্ষ দলের কোচ! হগের এই স্ফূর্তির রহস্য জানতে ইচ্ছে করে। কে জানে তাঁদের দেশে ওসব তেল বা ক্যাপসুল আছে কিনা!
৪) সাকিব আল হাসান বিদেশি হয়েই গণ্ডগোল - বেচারা সাকিব আল হাসান কলকাতা থেকে ক' কিলোমিচার দূরেই বা থাকেন! কিন্তু তিনি বিদেশি, ওই কাঁটাতারের বেড়াজালে পড়ে। তিনি তো আর শঙ্খচিল নন যে, যৌথ প্রযোজনায় মাঠে নেমে যেতে পারবেন! তাই দলে থাকেন। কিন্তু ম্যাচে থাকেন না। বুড়ো ব্রড এমন পারফরম্যান্স করছেন। এরপর আবার নারিন আছেন। সাকিব যাবেন কোথায়!
৫) রবীন উত্থাপ্পার চওড়া কাঁধ আর চওড়া ব্যাট - আপনি এ দেশের অনেক শরীর সর্বোস্ব নায়কদের দেখেছেন। তবু সলমন খান এ ব্যাপারে কেন অনেকটা এগিয়ে থাকেন, তার একটা আখোঁ দেখি প্রমাণ পেতে পারেন। আপনাকে আরও একবার 'বীর' সিনেমাটা দেখতে হবে। দেখবেন খালি গায়ে সলমন বসে আছেন আর ক্রেন থেকে একটা শটে সলমনের অনাবৃত শরীর দেখানো হচ্ছে। কাঁধটা কতটা চওড়া বোঝা যায় তখন। সলমনের কাঁধকে এ দেশে একটিই ছেলে চ্যালেঞ্জ জানাতে পারেন। রবীন উথাপ্পা। যেমন চওড়া তাঁর কাঁধ, ততটাই ব্যাট। কিন্তু জাতীয় দলে হয়তো নমন ওঝা বা ঋদ্ধিমান সাহারাই খেলে যাবেন। উথাপ্পা শুধু আইপিএলে কোন জন্মের দায়ভার নিয়ে কেকেআরকে জিতিয়ে যাবেন, তিনিই জানেন।
৬) পীযুষ চাওলা ইয়েস ম্যান - এই আইপিএলেই পীযুষ চাওলার একটি রেকর্ড রয়েছে। তিনি এই প্রতিযোগিতায় ৩৬০ ওভার বল করেও একটা নো বল করেননি। এই যার শৃঙ্খলা, তিনি এদিনও তেমনই বল করলেন, যেমনটা তাঁর কাছ থেকে আশা করা হয়েছিল। ৪ ওভারে ২১ রান দিয়ে ২ উইকেট। অথচ, জাদেজারা চিরকালীন সম্পদ হয়ে ভারতীয় দলের জার্সি গায়ে বিমান সফর করে বেড়াবেন! পীযুষই হন অথবা জুহি, নিজের গুণ অনুযায়ী চাওলারা যে কবে থেকে দাম পাবে কে জানে!
৭) ব্রেথওয়েট ব্যাটিং - তিনি মারলে শুধু ছক্কা মারেন। মানে, কেউ যদি জিজ্ঞেস করেন, তোমার প্রিয় শট কী? কেউ বলবেন, কভার ড্রাইভ। কেউ বলবেন পুল। কেউ বলবেন স্কোয়ার কাট। ব্রেথওয়েট বলতে পারেন 'ছক্কা'! ২৪ রান করলেও চারটে ছক্কা মারেন। ছ' রান করলেও ছক্কাই মারেন! ক্রিকেট খেলাটায় ছক্কা ছাড়াও এক, দুই, তিন, চার রান হয়, ব্রেথওয়েট বোধহয় শেখেননি। লাগলে ভালো। কিন্তু রোজ লাগবে না। আর যখন লাগবে না, তখন ০ তে কটা ছক্কা হয়, জিজ্ঞাসা করেও উত্তর পাবেন না! রাহুল দ্রাবিড় কী বোঝাবেন ব্রেথওয়েটকে! কেে জানে, আইপিএলের পর রাহুল দ্রাবিড়ও না ব্রেথওয়েটের মতো ব্যাটিং শিখে যান!
৮) ট্যুইটারে ফলো করতে করতে ধোনিকেও ফলো করো - আজকের যুগে সমাজে নিজের স্টেটাস বাড়ানোর সেরা উায় ট্যুইটার। আপনি কতভালো ট্যুইটার হাণ্ডেল করতে পারেন, সেটাই বলে দেয় আপনি কতটা বড় মাপের মানুষ। তবে না, আপনাকে সবাই ফলো করবে! কালকে ধোনিরা যেমন খেললেন, আজ কেকেআর তেমনই খেলল যেন। মুম্বই ১২১, দিল্লি একটু পিছিয়ে ৯৮-তে অল আউট! মুম্বই যা করে তা ফলো করছে দিল্লি আর ধোনির পুনে যা করছে, তা ফলো করছে গম্ভীরের কেকেআর! যেন ট্যুইটারে টি২০ হচ্ছে!
৯) মালিক থেকে ফ্যান, কলকাতা আসলে দুটোই - কিং খান মালিকও। আবার ফ্যানও। কলকাতার ক্রিকেটপ্রেমীরাও তেমনই। মনের মালিক। আর কিংয়ের ফ্যান। রোজ এত ক্রিকেট। ক্রিকেটাররা খেলে ক্লান্ত। আম্পায়াররা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ক্নান্ত। আয়োজকরা আয়োজন করতে করতে ক্লান্ত। পুলিশ পাহাড়া দিয়ে ক্লান্ত। টিভি চলে চলে বন্ধ। কিন্তু কলকাতার ক্রিকেটপ্রেম একইরকম। কোনও ক্লান্তি নেই। আমি কেকেআর। এই গর্জন তো সবে শুরু। চলবে অনেক দিন পর্যন্ত। শুরুটা গম্ভীর মুখে ভালোই হল। শেষটায় শুধু একটা হাসি চাই।