ফার্স্ট লোকাল

Updated By: Sep 27, 2016, 08:12 PM IST
ফার্স্ট লোকাল

প্রদীপ চক্রবর্ত্তী

পুজো নিয়ে বাড়তি প্রেম আমার কোনওকালেই নেই। ছোটবেলায় যে উত্‍সবের অছিলায় পুজোয় মাততাম, এখনও তাই। উত্‍সবেই তো অক্সিজেন। আচ্ছা! পুজোর উত্‍সব কেমন হয়? এ প্রশ্ন অবান্তর। তবে পুজো ফুরনোর পরে পুজোর উত্‍সব প্রত্যক্ষ করার একটা অভিজ্ঞতা আমার হয়েছিল। সেই গল্পই শোনাব।

কালীপুজো কেটেছে আগের রাতে। আকাশে তখন প্রতিপদের চাঁদ। অফিসে আমার কাজ ফুরলো মধ্যরাতে। পুজোর চারদিন বরাদ্দ ছুটি নিইনি। এবার বাড়ি যাব। আমার বাড়ি মেদিনীপুর শহরে। আমার বাহন, হাওড়া থেকে রাত আড়াইটের ফার্সট লোকাল। একটু দেরি করেই স্টেশনে গেলাম। রাত দেড়টা। কাউন্টারে ভিড় নেই। অলসভাবে টিকিট কেনা হল। হাতে অনেক সময়। হাওড়া স্টেশনের লাউঞ্জ সে'রাতে অস্বাভাবিক রকম খালি। চাদর  পেতে যাঁরা শুয়ে থাকেন তাঁদের সংখ্যা অনেক কম। কারও যেন কোথাও যাওয়ার নেই। উত্‍সব ফুরিয়েছে। একটু জিরোচ্ছে জীবন। ফার্সট লোকালের প্ল্যাটফর্ম নির্দিষ্ট। বারো অথবা তেরো। আমি একটি চিকেন প্যাটিস চিবোতে চিবোতে আলগোছে পা বাড়ালাম।

প্ল্যাটফর্মে পৌঁছে চক্ষু চড়কগাছ! এত ভিড়। এরা কারা? কোথা থেকে এল? বিষম ভিড়ের বিষম সামলে উঠতে নজরে এল আর একটা জিনিস। ঢাক। সারি, সারি। রাশি রাশি। এত ধরণের তালবাদ্য জীবনে দেখিনি। সবের নামও জানি না। বুঝলাম শুধু এগুলি বাজে। কাঠি পড়লেই বাজে। আরও বুঝলাম, এই ঢাক আর  ঢাকিরাই আমার সহযাত্রী।

হাল্কা শীত পড়ছে। জানালা নামিয়ে, ফ্যান অফ করে, চাদর মুড়ি দিয়ে, লোকালের বেঞ্চে ঘুমোতে ঘুমোতে বাড়ি যাই। চোখ খোলে মেদিনীপুরে। সেদিন এই উপায় নেই। ভিড়ে ঠাসা প্ল্যাটফর্ম। সঙ্গে ঢাকের সারি। বসার জায়গা পাওয়াই দুষ্কর। ট্রেন যখন প্ল্যাটফর্মে ঢুকছে লাফিয়ে উঠে পড়লাম। ট্রেন দাঁড়ালে কম্পিটিশনে নাও পারতে পারি। আমার কায়দা দেখে প্ল্যাটফর্মের ভিড়টা অবাক হোল। বছরে এক আধবারই ওঁরা ট্রেনে চড়েন। নিত্যযাত্রীর জিমন্যাস্টিক জানা নেই। জানলেও ঢাক নিয়ে সেই অ্যাডভেঞ্চারের উপায় নেই।

ট্রেনে উঠে জানালা খুলে দিলাম। ফ্যানও চালিয়ে দিলাম। এই ভিড়ে কামরা গরমই থাকবে। তারপর সকলে এলেন। একে একে। হুড়ো তাড়া নেই। ঠেলাঠেলি নেই। উপায়ও নেই। কারণ টানা দেড়মাস ওঁরা ঢাক বাজিয়েছেন। শরীর আর দিচ্ছে না। সকলে উঠে আগে ঢাকগুলি গুছিয়ে রাখলেন। মাটিতে চাদর বিছিয়ে এক একটি ঢাক রাখা হল। যত্ন করে। তারপর বয়স্করা বসলেন। তারপর মহিলারা। শেষে যুবকরা। এঁদের আমি ছোট থেকে চিনি। জঙ্গলমহলের অধিবাসী। রোমান্টিক সাহিত্যিকরা আদিবাসীদের দেহ সৌষ্ঠব নিয়ে বহু কথা লিখে গেছেন। আমি সেই স্পর্ধা করব না। ওঁদের সংস্কৃতির আর একটা দিক জানাব আপনাদের।

ধীরে ধীরে ট্রেন ভরে গেল। আমি ছিলাম সামনের দিকের এক কামরায়। উঠেই একজন বললেন(ওঁদের ভাষায়, আমি বুঝি, কিন্তু লিখতে পারব না) যাক পুজো শেষ। এবার আমাদের উত্‍সব। ভাবলাম এই রে। আমরা ছাত্রজীবনে পরীক্ষা শেষে বেঙ্গালুরু থেকে বাড়ি ফেরার সময় যা করতাম, এঁরাও কি তাই করবেন? আমাদের উত্‍পাতে যশবন্তপুর এক্সপ্রেসের বাকি যাত্রীরা তো ঘুমোতেই পারত না। ভয়ে ভয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম। ট্রেন চলতে শুরু করল।

সাঁতরাগাছি পেরনোর পর সবুজের সারি শুরু হয়। রাতে রঙ বোঝার উপায় নেই। তবে প্রতিপদের আবছা আলোয় সে দৃশ্যই মায়াবী। এমন সময় বেশ মিঠে সুরে বাঁশি বেজে উঠল। আমারই এক সহযাত্রী বাজাচ্ছেন। কে বাজাচ্ছে দেখা হয়নি। কারণ বাইরের দৃশ্য আর ভিতরের সুর আমাকে ডুবিয়ে নিয়ে গেছে কোন অতলে। মিঠে সুর ধীরে ধীরে আকুতিতে পরিণত হল। আমার আত্মাকে যেন টেনে বের করছে কেউ। বাইরের দৃশ্য আর ভিতরের সুর। উলুবেড়িয়া পেরিয়ে গেল। রূপনারায়ণ পেরোল। কোলাঘাট পেরিয়ে মেচেদা। আমি তখন বাঁশির সুরে নেশাতুর। ধীরে ধীরে সুর মিলিয়ে গেল। বাঁশি থামল। আমি আবার কামরার ভিতরে চোখ রাখলাম।

ভেতরেও তখন নেশার প্রস্তুতি। নিয়মিত সুরাপান করেন যিনি তাঁর চোখে সামান্য আয়োজন। সস্তা দেশি ভদকার একটি পাঁইট। দশটি প্লাস্টিকের গ্লাস। চাটের বালাই নেই। পারিশ্রমিক থেকে বাঁচিয়ে চাঁদা তুলে এই ব্যবস্থাই হয়েছে। নিয়মিত হ্যাঁড়া(হাঁড়িয়া) খাওয়া মানুষগুলির কাছে এটাই খাঁটি 'বিলাতি'। মদ্যপান কোনওকালেই আমি ভাল চোখে দেখি না। কিন্তু, সে'রাতে ওঁদের মদ খাওয়ার দেখে ভালবাসা জন্মে গেল। পরম মমতায় এক একটি গ্লাস হাতে ধরে তাকিয়ে তাকা। যেন প্রেমিকার সঙ্গে নিঃশব্দে, গভীর অনুরাগে ভাব বিনিময়। তারপর ঠোঁটে ঠেকিয়ে চুম্বন। হ্যাঁ চুম্বন। এটাই সঠিক শব্দ। স্পষ্ট যেন দেখলাম পাশে বসা ব্যক্তির ঠোঁট চুইঁয়ে অন্তরে মিশে গেল সেই সুরা। কে বলে নেশা করা খারাপ! দেখতে দেখতে বালিচক পেরিয়ে গেল।

আলো ফুটেছে। পূর্ব দিগন্তে নৈসর্গিক উজ্জ্বলতা। সহযাত্রীদের অনেকেই ঘুমিয়ে পড়েছেন। অবশেষে চা এল। আমি খেলাও। ওঁরাও নিলেন। কথাবার্তায় বুঝলাম এবার উত্‍সব শুরু হবে। পুজোর টাকা হাতে এসেছে। এবার গ্রামে আসবে যাত্রাপার্টি। হুল্লোড় হবে।

ট্রেন খড়গপুর পেরোল। একটা ভাবনা মাথায় চেপে বসল। আমি মেদিনীপুরের ছেলে। ওঁরাও। পাশাপাশি বাস। সেই কোনকাল থেকে। তবু এখনও এত অমিল কেন? আমার চামড়া সাদা। ওঁদের চামড়া কালো। ওঁদের মনে সাদা। আমার মন কালো। আমি মারামারি করে প্রতিদিন ট্রেনে জানলা দখল করি। কিন্তু, যাত্রাপথে ওঁদের কারও আচরণে একটুও বিশৃঙ্খলা দেখলাম না। সমান্তরাল দুই সংস্কৃতি। এত অমিল? কোনও যোগসূত্রই কি নেই?

আছে। উত্‍সবই সেই উপলক্ষ্য। ওঁদের ঢাকের বাদ্যি ছাড়া আমার উত্‍সব অসম্পূর্ণ। আবার আমার উত্‍সবেই ওঁদের উপার্জন। সেই উপার্জনে ওঁদের উত্‍সবের উপলক্ষ্য। পুজোয় মিলে গেছে দুই সংস্কৃতি। আমরা-ওরা আর নেই। পুরোটাই আমরা। ট্রেন মেদিনীপুর পৌঁছল।

.