শরত্ স্মৃতি

Updated By: Sep 27, 2016, 08:22 PM IST
শরত্ স্মৃতি

সৌম্য সিংহ

আঁকা বাঁকা পথটা যেখানে শেষ হচ্ছে, সেখানে একটা মাটির ঢিপি। ওই ঢিপি দিয়ে উঠে গেলেই আমাদের বাড়ি। আমার পৈতৃক ভিটে। ক্ষয়ে যেতে যেতে বড়ই বিপন্ন সে। তবু অতি কষ্ট করে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে এ বাড়ি ফিস ফিস করে চলেছে আমার পিতৃ পুরুষের ইতিহাস। বড়ই বিবর্ণ সে। তবে রঙীন হয়ে ওঠে প্রতি শরতে। ঐতিহ্য বজায় রাখার দৌড়ে যে সেও সামিল। প্রতি বছর প্রতিযোগী হিসেবে পিছনের সারিতে দৌড়তে শুরু করে আমাদের বাড়ি। তাই তো শরতে সেজে ওঠা খুব স্বাভাবিকই।

উঠোনের শিউলি গাছের তলায় সাদা কমলা রঙের চাদর, পিছনের বাগানের গন্ধরাজের মিষ্টি সুবাস, লাল-কমলা-বেগুনি ফুলগুলোর রঙবাজি--সব মিলিয়ে ছোট্ট বাড়িটির পরিবেশেই অনন্যতা। তার সঙ্গে মিশে যায় এ বাড়ির সদস্যদের হাত--গোবর নিকানো উঠোন, উঠোন জুড়ে আল্পনা।

আমাদের বাড়িতে দুর্গাপুজো হয়। মূর্তি পুজোয় নিষেধাজ্ঞা, ঘট-নবপত্রিকাকে সামনে রেখেই মাতৃ বন্দনা। তাতেও কী ধূমধাম! প্রতি ভোরে ফুল তোলা, ফল কাটা, চন্দন বাঁটা-আরও কত কী! সবটাই মা কাকীদের দায়িত্বেই। আমাদের শুধু ছুটির সকাল-দুপুর-সন্ধ্যা-রাত। উত্সবের আলস্য দিন।

আমাদের বাড়িতে হয় না বলে গোটা গ্রামে কারও বাড়িতেই মূর্তি পুজোর চল নেই। পুজোর দিনে সকলেই কলাগাছে দেবী দর্শন করেন। বাবাদের আমলে গ্রামে কোনও বারোয়ারি ছিল না। হালে অবশ্য শুরু হয়েছে তিনটে সর্বজনীন-গোয়ালাপাড়া, পাঠশালা, মাঠের বারোয়ারি। সে পুজোকে ঘিরেই উচ্ছ্বাস, উন্মাদনা।   

ছোটবেলায় পুজোর একদিন পাশের গ্রামে যাওয়ার অনুমতি ছিল। আশপাশের গ্রাম মিলিয়ে সেখানে একটিই বারোয়ারি পুজো। তাই উপচে পড়া ভিড়। সকলেই দেখতেন, তবু হাঁ করে তাকিয়ে আশ মিটতো না কারও। আলোচনা চলত, গণেশ কলুর দোকানের ক্যালেন্ডারের মুখটা আর মৃন্ময়ী দুর্গার মধ্যে কে বেশি সুন্দর।

বেশ মনে আছে, আমাদের গ্রাম বা পাশের গ্রামে তখনও বিদ্যুত্ পৌঁছয়নি। উত্সবের দিনেও অন্ধকারে ঢেকে থাকত আঁকা বাঁকা পথ। শুক্লপক্ষই যা ভরসা। চাঁদের আলোয় পথ দেখেই কালো কালো মানুষগুলি ফিরে যেতেন পুজো দেখে। একবার লাইটিং করল বারোয়ারি কমিটি। লাইটিং বলতে রাস্তার ধার ঘেঁষে সবুজ টিউব লাইটের অস্থায়ী পোস্ট। আর তা নিয়ে কত ভিড়। কত আলোচনা।  

পুজো দেখে সেবার ফেরার পথে বাবুসোনাকে ল্যাং মেরে ফেলে দিয়েছিলাম নর্দমায়। নতুন জামা নষ্ট হওয়ায় বাবুসোনার সে কী কান্না। আসলে বোকাসোকা বাবুসোনাকে ছোটবেলায় কাঁদাতে বেশ লাগত আমাদের সকলের।

বাবুসোনা এখন অনেকটাই বড়। বিদেশে থাকে। এখন অনেক অনেক জামাকাপড় ওর। গ্রামের সারল্যকে দূরে সরিয়ে কর্পোরেটের বাবুয়ান বাবুসোনা। ওর কাছে তিনশো পঁয়ষট্টি দিন এক, সে দুর্গাপুজোই হোক আর লক্ষ্মীপুজোই হোক। আনন্দ, উত্সবের দিকে তাকানোর সময় কোথায় ওর?   

বাবুসোনার বাবা-মা অবশ্য বিদেশে যাননি। ভিটে আঁকড়ে তাঁরা পড়ে রয়েছেন গ্রামের বাড়িটাতেই। প্রতি মাসে বাবুসোনার টাকা আসে মনি অর্ডারে। খেয়ে পড়ে বুড়োবুড়ির অভাব নেই। অভাব একটাই। শূন্যতা। ছেলেটার জন্য বড় মন কেমন করে যে তাঁদের...

আমিও গ্রামের বাড়িতে নেই। পাকাপাকি ঘর বেঁধেছি শহরের অভিজাত আবাসনে। এখানে পঁচাত্তর শতাংশ সবুজ। তবু কংক্রিটের জঙ্গলে গড়ে ওঠা আবাসনটি শরতে সেজে উঠতে পারে না। শিউলি, গন্ধরাজের চড়া গন্ধ বাতাসে মৃদু হয়ে ভেসে বেড়ায়না আবাসনজুড়ে। শরতানুভূতি এখানে উধাও।    
 
এখন পুজো কাটে শহরে। আলোর রোশনাই, থিমের জোয়ারে। সময়ের অনেকটাই ব্যবধান। তাই সপ্তমী, অষ্টমী, নবমীতে হোল নাইটে ঝোঁক বেশি। কোনও মতে একবার ঢুঁ মারি পৈতৃকীতে। হয়ত শরতকে ছুঁয়ে দেখতেই। সাদরে তখন অতিথি বরণ করে শতাব্দী প্রাচীন বাড়িটি।

.