মহিষাসুরমর্দিনী এবং এক ভাল অসুরের গল্প

Updated By: Sep 27, 2016, 10:40 PM IST
মহিষাসুরমর্দিনী এবং এক ভাল অসুরের গল্প

দিব্যেন্দু ঘোষ

ভাল অসুর

তিনি অসুর নন। মহিষাসুর তো ননই। তবে পেশির আস্তিনে মহিষের মতো আসুরিক শক্তি যে লুকিয়ে, সেটা সত্যি। তুলে আছাড় মারতে তিনি ওস্তাদ। তবে মনটা ততটাই নরম। অলিম্পিকের রুপোর মেডেল গলায় উঠবে জেনেও তিনি অবলীলায় তা প্রত্যাখ্যান করতে পারেন। পেটাই চেহারাটা সটান দাঁড়িয়ে পড়তে পারে দুর্ঘটনায় মৃত কুস্তিগিরের পরিবারের পাশে। তাই তো তিনি ঈশ্বর। যোগেশ্বর। নাহ্, যোগ সাধনায় বিশেষ মতি নেই। মুগুর ভাঁজাই দস্তুর। হরিয়ানার সোনিপতের আখড়ায় গিয়ে মুগ্ধ হতে হয় যোগী পালোয়ানকে দেখে। ৫ ফুট ৬ ইঞ্চির সুঠাম শরীরটা ঘামে চকচক করে ওঠে। "হার্ড ওয়ার্কের কোনও বিকল্প নেই।' বারবার বলেন তিনি। ধীর লয়ে বলে চলা কথায় ঝরে পড়তে দেখেছিলাম এক মস্তবড় মনের মণিমাণিক্য। পদ্মশ্রী যোগেশ্বরকে সেদিন দেখেই বুঝেছিলাম, তিনি প্রকৃত অর্থেই শ্রী। যখন ফিরে যাচ্ছিলেন ২০০৬-এর সেই দিনটায়, স্মৃতির আলপথে তখন টুপটাপ ঝরে পড়ছিল ভোরের শিশির। একটা চোখের পাতা অনেকটাই বোজা। সেই চোখই হয়ে উঠেছিল দুঃখে সজল। লোকাতে চেয়েছিলেন। পারেননি। দোহা এশিয়ান গেমসের বিমান ধরার ঠিক ৯ দিন আগে বাবাকে হারান। কান্নাভেজা জেদই ঈশ্বরের শরীরে ইনজেক্ট করেছিল আসুরিক শক্তি। তার মধ্যেই প্র্যাকটিসে হাঁটুতে চোট।

মন এবং শরীর তাঁকে ক্রমশই খাদের কিনারায় দাঁড় করিয়ে দিচ্ছিল।কিন্তু যোগী পালোয়ান যে হারতে জানেন না। বনসওয়াল কালনের আখড়ায় ধুলোবালি মাখতে মাখতে তিনি শিখে নিয়েছিলেন অসম্ভবকে জয় করার কৌশল। সেই কৌশলেই মাত। ৬০ কেজি ফ্রিস্টাইল কুস্তিতে ব্রোঞ্জ। কতটা মনের জোর থাকলে যে এটা সম্ভব, তা কিন্তু যোগেশ্বরের মুখের দিকে তাকালে বোঝার উপায় নেই। বাবার মৃত্যু ও হাঁটুর চোট, কিছুই দমাতে পারেনি ঈশ্বরকে। বনসওয়াল কালনের আখড়ার সামনে দাঁড়িয়ে এক অদ্ভুত কথা শুনিয়েছিলেন যোগেশ্বর। হাসতে হাসতে বলেছিলেন, "জানেন, এই একটা ব্যাপারে উজবেকিস্তানের মানুষগুলোকে উজবুক বলা যাবে না। ল্যাংট পরে ওরা আছাড় মারতে সিদ্ধহস্ত! কী যে খায়!' যোগেশ্বরের মতো সকালে ছোলা-গুড় নয় নিশ্চয়ই। কিন্তু সেই ছোলা-গুড়েই বহুবার উজবুকদের মাত করেছেন কুস্তির ঈশ্বর। এশিয়ান গেমসই হোক বা কমনওয়েলথ গেমস, এশিয়ান রেসলিং চ্যাম্পিয়নশিপ হোক বা কমওয়েলথ রেসলিং চ্যাম্পিয়নশিপ, ফ্রিস্টাইল হোক বা গ্রেকো রোমান, সোনিপতের আখড়া-সম্রাট আন্তর্জাতিক আঙিনায় ঝড় তুলেছেন বহুবার। কমনওয়েলথ ও এশিয়ান গেমসে ঠিক এভাবেই এসেছে একাধিক সোনা। সোনার টুকরো ছেলেকে চিনতে ভুল করেনি দেশ। ২০১২-র লন্ডন অলিম্পিকে ব্রোঞ্জ জেতার পর তাই রাজীব গান্ধী খেলরত্ন সম্মান দিতে ভুলে করেনি ভারত সরকার।

অসুরের দরাজ মন

সেই ব্রোঞ্জ যখন চার বছর পর রুপোয় বদলে গেল, ঠিক তখনই পেশিবহুল বুকের ভিতরে এক ভাল অসুরের দরাজ মনের সন্ধান পেল বিশ্ব।

"আপনার শরীরে তো আসুরিক শক্তি? আপনাকে কি অসুর বলা যায়?' তখন অলিম্পিক ব্রোঞ্জ জিতে ফেলেছেন। সোনিপতে তাঁর আখড়ার সিঁড়িতে বসে প্রশ্নটা করতে বাচ্চাদের মতো খিলখিল করে হেসে উঠেছিলেন। মোষের দুধের চা খাইছিলেন ইয়াব্বড় ভাঁড়ে। বাড়িতে থাকলে বিকেলে মোষের দুধের চা কিন্তু মাস্ট যোগেশ্বরের। চা খেতে খেতে বলছিলেন সুশীল কুমার, নরসিংহ যাদবের কথা। বলছিলেন, সুশীল বা নরসিংহ তাঁর থেকে অনেক এগিয়ে। এতটা বিনয়ী, অসম্ভব ভদ্র এক সেলিব্রিটির সামনে দাঁড়িয়ে সেদিন বুঝেছিলাম, যোগেশ্বরের ক্যারিশমাটা ঠিক কোথায়। যোগী পালোয়ানের কাছ থেকে আমাদের আরও অনেক চমক পাওয়া বাকি। লন্ডন অলিম্পিকের চার বছর পর, রিও অলিম্পিকে যখন ভঙ্গুর মনে ম্যাট ছেড়েছেন, তখনও বুঝিনি, কতবড় চমক দিতে তৈরি যোগেশ্বর। হাঁটুর অস্ত্রোপচারের পর যখন সবাই ভেবেছিলেন, যোগী পালোয়ানের কেরিয়ার বোধহয় শেষ, ঠিক তখনই সবাইকে ভুল প্রমাণ করে রিও অলিম্পিকে কোয়ালিফাই করেছেন। কোনও পদক হয়তো পাননি, কিন্তু জিতে নিয়েছেন হৃদয়।

"মানবিকতার চেয়ে বড় কিছু নেই'

২০১২-য় রাশিয়ার বেসিক কুদুকভের কাছে হেরেছিলেন যোগেশ্বর। কুদুকভ রুপো। যোগেশ্বর ব্রোঞ্জ। চারবারের ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়ন এবং দু-দুবার অলিম্পিক পদকজয়ী কুদুকভ ২০১৩-য় গাড়ি দুর্ঘটনায় মারা যান। সম্প্রতি ফের তাঁর নমুনা পরীক্ষা করা হয়। এবং প্রমাণিত হয়, কুদুকভ নিষিদ্ধ ওষুধ খেয়েছিলেন। ডোপিংয়ের অপরাধে আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটি তাঁর পদক কেড়ে নেয়।

১০ বছর পর্যন্ত কোনও খেলোয়াড়ের নমুনা রেখে দেয় আইওসি। আধুনিক ডোপ পরীক্ষায় সেই নমুনা বারবার পরীক্ষা করতে পারে তারা। এরকমই ১০০০ নমুনা ফের পরীক্ষা করে আইওসি। তার মধ্যে লন্ডন ও বেজিং অলিম্পিকের ৯৮জন অ্যাথলিট ডোপ টেস্টে ধরা পড়েন। তার মধ্যেই রয়েছেন কুদুকভ। ফলে কুদুকভের রুপোর ভাগীদার হয়ে যান যোগেশ্বর। খবরটা শোনার পর গোটা দেশকে পদক উত্সর্গ করেন ঈশ্বর। কিন্তু তার পরেই বলে দেন, মৃত কুদুকভের পরিবারের কাছেই থাকুক ওই রুপোর পদক। তিনি নিতে চান না। আসলে তিনি তো ঈশ্বর। তা না হলে কি তিনি বলতে পারেন, মানবিকতা তাঁর কাছে শেষ কথা? অন্য সব কিছুর থেকে এটা তাঁর কাছে অনেক বড়। মনে পড়ে যাচ্ছিল ২০১২-র সেই দিনটার কথা। সেদিন তিনি বলেছিলেন, "আমার মায়ের সম্মান, মাতৃভূমির সম্মানের চেয়ে আর কিছু বড় হতে পারে না।' সেদিন তো ছিল অলিম্পিক পদক জয়ের আনন্দ। এদিনও আনন্দ। সেই ব্রোঞ্জ রুপোয় বদলে যাওয়ার আনন্দ। কিন্তু ২০১৬ অলিম্পিকে হেরে যাওয়ার হতাশাও ছিল। তবুও তিনি জয়ী। কুদুকভের পরিবারের প্রতি যে মহানুভবতা দেখাতে পারলেন যোগী পালোয়ান, তা কি অন্য কেউ পারতেন! আমি বিশ্বাস করি না। কারণ, সামনে থেকে মানুষটাকে দেখে, মানুষটার মন পড়তে অসুবিধে হয়নি। তিনি প্রকৃত অর্থেই ঈশ্বর। আমার কাছে ভাল অসুর। আন্তর্জাতিক কুস্তিকে বিদায় জানিয়েছেন। কিন্তু ঈশ্বর বিদায় নিতে পারেন না।

একালের মহিষাসুরমর্দিনী

পুরাণ মতে,অসুররাজ মহিষাসুর এবং মহিষাসুরমর্দিনী দেবী কাত্যায়নী। বিষ্ণু যখন যোগনিদ্রায় বিভোর ছিলেন, তখন তাঁর নাভিকমল থেকে ব্রহ্মা এবং কর্ণমল থেকে মধু ও কৈটভ নামে দুই অসুরের জন্ম হয়। ব্রহ্মা যখন তাঁর সৃষ্টির কাজ শুরু করতে যাবেন, তখন অসুরদ্বয় তাঁকে আক্রমণে উদ্যত হয়। এমন সময় ব্রহ্মার স্তবে বিষ্ণুর আঁখিপল্লব থেকে মহামায়া দুর্গা আবির্ভূত হয়ে বিষ্ণুকে জাগ্রত করেন এবং মধু-কৈটভকে বধ করে সৃষ্টির বিনাশ রোধ করেন। অন্যদিকে মহিষাসুর স্বর্গরাজ্য দখল করে দেবতাদের তাড়িয়ে দিলে দেবতারা মহামায়ার আরাধনা শুরু করেন। তাঁদের আরাধনায় তুষ্ট হয়ে মহামায়া শুম্ভ-নিশুম্ভকে নিধন করে দেবতাদের অধিকার ফিরিয়ে দেন।

মহাদেবের তেজ থেকে দেবীর মুখ, অগ্নির তেজে নয়নযুগল, যমের তেজে কেশকলাপ, বরুণের তেজে উরু, জঙ্ঘা ও নিতম্ব, সূর্যের তেজে পদদ্বয়, যক্ষগণের তেজে নাসিকা, বায়ুর তেজে কর্ণদ্বয় নির্মিত হয়। দেবতাদের কাছ থেকে বিবিধ শক্তি দ্বারা সুসজ্জিত হন তিনি। মহাদেব দিলেন ত্রিশূল, বিষ্ণু দিলেন চক্র, বরুণ দিলেন শঙ্খ, অগ্নি দিলেন শক্তি, বায়ু দিলেন ধনু, সূর্য দিলেন তূণ ও শর, ইন্দ্র দিলেন বজ্র, যম দিলেন দণ্ড, কুবের দিলেন গদা, ব্রহ্মা দিলেন অক্ষমালা ও কমণ্ডলু, মহাকাল দিলেন বর্ম ও অসি, চন্দ্র দিলেন হার, সমুদ্র দিলেন মালা, হিমালয় দিলেন সিংহ। এই দেবীর হাতে মহিষাসুর নিহত হয়। দেবতাদের তেজ ও অস্ত্রে ঠিক যেমন শক্তিশালী হয়ে ওঠেন মহামায়া, ঠিক তেমনই একালের মহিষাসুরমর্দিনীরাও তাঁদের গুরুর বলে বলীয়ান। পুলেল্লা গোপীচাঁদ হোক বা কুলদীপ সিং বা বিশ্বেশ্বর নন্দী।

প্রথম অঙ্ক

ঈশ্বর কি সাক্ষী ছিলেন? নিশ্চয়ই ছিলেন। কারণ, ঈশ্বরের ম্যাচ ছিল রিও অলিম্পিকের একদম শেষদিনে। তাই তাঁকে থাকতেই হয়েছিল। তাঁর আখড়ার মেয়ে না হোক, দুজনের লড়াই তো এক। গায়ের জোরে প্রতিপক্ষকে তুলে আছাড় মারো। ঈশ্বর কি কোনওদিন সাক্ষীকে কোচিং করাবেন? হয়তো না। তবে ইতিহাসের সাক্ষী হতে বাধা কোথায়? কুলদীপও সাক্ষী ছিলেন। শেষ ১০ সেকেন্ডের ইতিহাস। সাক্ষীর সঙ্গে তিনিও যেন লড়ছিলেন। চিত্কার করে নির্দেশ দিচ্ছিলেন। সাক্ষীর সাফল্য উদযাপনের ছবিটা বড়ই প্রাণময়। কুলদীপের কাঁধে সাক্ষী। সাক্ষীর দুহাতে ধরা তেরঙা। সাক্ষীর মেডেল আর কুলদীপের মতো শিক্ষকের চেষ্টা ভারতীয় কুস্তিতে ইতিহাস গড়ে দিয়েছে। কে ডি যাদবের দেখানো সাফল্যের রাস্তাটা বড় মসৃণ ছিল না। মহিলা কুস্তিকে এতদিন পর সসম্মানের পথে পৌছে দেওয়াটা বড় সোজা কথা নয়। কঠিন। ভীষণই কঠিন। কুলদীপের হাত ধরে সেই অসম্ভবকে বাস্তবের রুক্ষ মাটিতে এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন সাক্ষী মালিক। একালের মহিষাসুরমর্দিনী।

কুস্তির ফ্লোরে "ধোবি কা পাট' প্যাঁচের বিশেষজ্ঞ, শক্তিময়ী সাক্ষী তো নতুন স্লোগান তুলে দিয়েছেন, "বেটি খিলাও'। সামাজিক-সাংস্কৃতিক-পারিবারিক অভ্যেস-ঐতিহ্যে পুরুষের চেয়ে বরাবর কম পুষ্টি পেয়ে আসা সনাতনী ভারতীয় নারী তাতে প্রাণিত হয়ে নিজেদের শরীর-স্বাস্থ্যের দিকে একটু বেশি নজর দেবেন কি না, তা আমাদের জানা নেই। তবে হরিয়ানার রোহতকের কাছে মোখরা গ্রামের মেয়েটি যে দিনে ৫০০ সিট-আপস দেওয়া ছাড়বেন না, তা স্পষ্ট। দিনে নিয়ম করে ২ লিটার গরুর দুধও খাবেন। মা সুদেশ মালিকের হাতের আলু-পরোটাও ছাড়তে পারবেন না। সেই মা যখন জিজ্ঞেস করেন, "বেটি, তুম থাক গহি হ্যায় না?' তখন মেয়ে সটান উত্তর দেবেন, "নেহি মা, দেশ কে লিয়ে অলিম্পিক মেডেল জিতনে কে বাদ কোই থাক নেহি যাতি।'

দ্বিতীয় অঙ্ক

সাক্ষী মালিকের আখড়া তো এখন রীতিমতো দ্রষ্টব্যস্থান। হামলে পড়ছে ভিড়। ভারতের প্রথম মহিলা কুস্তিগির, যিনি অলিম্পিকে পদক জিতেছেন। চাট্টিখানি কথা নয়। পুরুষশাসিত খেলায় তেইশের এক তরুণীর হার না মানা জেদ যে কতটা অসাধ্য সাধন করতে পারে, তা রিও অলিম্পিকে যাঁরা সাক্ষীকে দেখেননি, তাঁরা বিশ্বাস করতে পারবেন না। সাক্ষীর অখড়া সামলান অন্য এক ঈশ্বর।  ঈশ্বর দাহিয়া। দীর্ঘদিন সাক্ষীকে কোচিং করিয়েছেন, অবসরের পরেও নিজেকে জুড়ে রেখেছেন অ্যাকাডেমির সঙ্গে। কারণ, সাক্ষীর চোখে আগুনের ফুলকি দেখেছিলেন। মহিষাসুরকে যখন বধ করেন মহামায়া, তখন তাঁর চোখ দিয়ে যেমন তেজ ঠিকরে বেরোয়, ঠিক তেমনই সাক্ষীর দুচোখে লড়াইয়ের স্ফুলিঙ্গ দেখেছিলেন ঈশ্বর।

তৃতীয় অঙ্ক

সাক্ষীর চোখে বারবার কৌতূহলের ইশারা খুঁজে পেয়েছেন বাবা সুখবীর মালিক। খেতে ভীষণ ভালবাসেন মেয়ে। সবকিছু খান। মাছ, মাংস, কিচ্ছু ছাড়েন না। এমনকী ঘোড়ার মাংস। সেই মাংস খাওয়ার গল্প বাবার কাছে চেপে রাখতে পারেননি। ঘোড়ার মাংস! একচোট বকে দিয়েছিলেন সুখবীর। তারপর আর কোনওদিন খাননি সাক্ষী। কিন্তু চিকেন বা মাটন ছাড়তে পারেননি। ছাড়তে চানও না। না খেলে শরীরে শক্তি আসবে কী করে? খাওয়া নিয়ে কেউ কিছু বললেই ফোঁস করে ওঠেন শক্তিময়ী। উফ, যদি টুঁটিটা একবার চেপে ধরেন, ব্যস, নড়বার শক্তি থাকবে না। সেই বদ ছোকরাগুলো এখনও গালে হাত বোলায়। যেদিন রিওয় ব্রোঞ্জ পদকটা গলায় উঠল সাক্ষীর, তখন পচাশ পচাশ ক্রোশ দূর রোহতকের আখড়ার চারপাশে চরে বেড়ানো কিছু যুবকের হাত আচমকাই চলে যায় গালে। উফ, কী চড়টাই না মেরেছিল মেয়েটা! আখড়ায় যাওয়ার পথে মাঝে মধ্যেই উড়ে আসত কটূক্তি। একদিন দাঁতে দাঁত চেপে এগিয়ে গিয়েছিল মেয়েটা। মেরেছিল ঠাটিয়ে একটা চড়। যাওয়ার সময় পিছন ফিরে বলে গিয়েছিল, "ফির কভি দেখা তো উঠাকে পটাক দুঙ্গি।' যে সাহসের ডানায় চড়ে বিশ্বজয় সাক্ষীর। কেন ভারতের আর পাঁচটা মেয়ে এভাবেই রুখে দাঁড়াতে পারেন না? সমাজের কুনজরের গালে কেন সপাটে হাতের চিহ্ন এঁকে দিতে পারেন না? সাহসটা কুলিয়ে উঠতে পারেন না? কিন্তু সাক্ষী তো সাহস জোগাচ্ছেন। নতুন যুগের সূর্যোদয় ঘটাচ্ছেন। ভয়কে জয় করতে শেখাচ্ছেন। কিন্তু যখন খিল খিল করে হাসছেন, একবারও কি পুরুষ-হৃদয়ে দোলা দিচ্ছে না?

চতুর্থ অঙ্ক

হৃদয় তো চুরি হয়ে গিয়েছে। ৫৮ কেজি ফ্রিস্টাইলে ব্রোঞ্জটা যখন গলায় ঝুলছিল, তখন গর্বে বুকটা আরও ফুলে উঠেছিল এক কুস্তিগিরের। একসঙ্গেই আখড়ায় ঘাম ঝরান দুজনে। বুকে আসুরিক বল আছে। আবার ভালবাসাও আছে।

তবু মনে রেখো

ভারতের জনগণ, রাজনৈতিক নেতা, মিডিয়া-লর্ড, বিপণন-ব্যারন, কারও কিচ্ছু যায়-আসে কি, গভীর ভালবাসা ঝরে পড়ে কি যোগেশ্বর দত্ত বা সাক্ষী মালিকের ওপর? সত্যি করে বলুন তো! আসল ঘটনা হল, ভারতের মানুষ এখন পিত্জা-বার্গারের  মতো ক্রিকেট চিবোয়। ঘুমের ঘোরেও কোনও বলিউড-ফ্যান্টাসির দৃশ্যায়নের মতো ক্রিকেটের সুখ-স্বপ্নে বিভোর থাকে। এই উপমহাদেশের ক্রিকেট মাঝে মাঝে ধর্মের চেয়েও বড় আফিম। যে নেশা আমাদের জাতীয়তাবাদ, সাম্প্রদায়িক সংহতির বুনোট, এমনকী কূটনৈতিক সম্পর্কের মজ্জায় অবধি ছড়িয়ে যেতে পারে। অদ্ভুতভাবে এই গণ-হিস্টিরিয়া, জাতীয়তাবোধের এই উন্মাদনা, ক্রিকেট মাঠের বাইরে একটু চুঁইয়েও পড়ে না। তারপর বলতে হয়, যোগেশ্বর-সাক্ষীরা আমাদের রাজনীতি-সরকার-রাষ্ট্রের অনন্ত ব্যর্থতার লজ্জা ঢাকার আপাত-আড়াল। সেই আড়ালের বুক চিরে উঁকি দেবে একালের মহিষাসুরমর্দিনী ও এক ভাল অসুর। তবুও ভুলে যাব আমরা। কেন? 

.