নেহরু থেকে মোদী- গোড়াতেই গলদ! কাশ্মীরের বদলা তিব্বতে নিলে জব্দ হত চিন

অনির্বাণ সিনহা

Updated By: Sep 10, 2020, 04:34 PM IST
নেহরু থেকে মোদী- গোড়াতেই গলদ! কাশ্মীরের বদলা তিব্বতে নিলে জব্দ হত চিন

অনির্বাণ সিনহা

আধুনিক বিদেশনীতিতে নবকুমারের কোনও স্থান নেই। বরং, প্রয়োজনে অপরে অধম না হলেও জাতীয় স্বার্থে, কোনও রাষ্ট্রকে উত্তম থাকার আদর্শ ত্যাগ করতে হতে পারে। আর ঠিক এখানেই ভারতের তিব্বত নীতির ব্যর্থতা। চিনের মুখের সামনে আমরা আয়না ধরতে পারিনি। জম্মু-কাশ্মীরে পাকিস্তানকে অন্যায় সমর্থন করে দশকের পর দশক ধরে চিন আন্তর্জাতিকস্তরে যে ভারত বিরোধী ভূমিকা পালন করেছে,তার পাল্টা হিসেবে চিনকে ভারত কিছুই ফিরিয়ে দেয়নি। ভারতীয় শাসকরা স্বাধীনতা লাভের পর থেকেই চিন সম্পর্কে এমন এক রোম্যান্টিকতায় আচ্ছন্ন ছিলেন, যে তিব্বতের ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্বের দিকে তাঁরা নজরই দেননি।

১৯১১ সালটি বাঙালি মনে রাখে দু'টি কারণে।গোরাদের হারিয়ে মোহনবাগানের আইএফএ শিল্ড জয় ও আন্দোলনের চাপে ব্রিটিশদের বঙ্গভঙ্গ প্রত্যাহার। একই বছর অবশ্য কলকাতা থেকে রাজধানী নয়া দিল্লিতে সরিয়ে নিয়ে যায় ব্রিটিশরা। কিন্তু,এসব ছাড়াও,এই বছরটি ভারত-চিন-তিব্বত সম্পর্কের ক্ষেত্রেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও সুদূরপ্রসারী প্রভাব রেখে যায়।তিব্বত নিয়ে ভারতের ভুল কীভাবে ,কোথায় হল তা বুঝতে সংক্ষেপে হলেও সেই ইতিহাসে চোখ রাখা জরুরি।

খৃষ্টীয় ত্রয়োদশ শতক থেকে চিন মোঙ্গল কিং বংশের শাসনের অধীনে আসে। তার ৬০০ বছর আগে তিব্বতি সম্রাট স্রোৎ-সাঙ-গাম-পো সমগ্র চিন অধিকারে আনেন। চিনের ওপর তিব্বতের প্রভুত্ব চলে আরও প্রায় ৩০০ বছর। কিন্তু, আধুনিক চিনের শাসকরা ইচ্ছা করেই সেই ইতিহাসের কথা উল্লেখ পর্যন্ত করেন না। তাঁদের তিব্বতি ইতিহাসের পাঠ শুরু হয় ওই ত্রয়োদশ শতক থেকে। তবে মুশকিল হল, কিং বংশের আমলেও তিব্বতের সঙ্গে চিনা শাসকদের রাজা-প্রজার সম্পর্ক ছিল না। তিব্বতি ধর্মগুরু দলাই লামা ছিলেন কিং সম্রাটদের মেন্টর। প্রজা কল্যাণে তাঁদের বুদ্ধ নির্দেশিত পথে চলতে পরামর্শ ও প্রেরণা দিতেন দলাই লামা, বিনিময়ে তিব্বতের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে দলাই লামা ও তাঁর মনোনীত প্রশাসক মণ্ডলীর অধিকারে কোনও হস্তক্ষেপ করতেন না চিনা সম্রাট। কেবল বিদেশিদের যাতায়াত, বৈদেশিক বাণিজ্য থেকে পাওয়া রাজস্ব ,সম্ভাব্য বিদেশি চরবৃত্তিতে নজর রাখতে একজন চিনা প্রতিনিধি লাসায় থাকতেন। তিব্বতের সমস্ত কৃষিজমির মালিক ছিল বৌদ্ধ ভিক্ষু সংঘগুলি। জমির ফসল ও খাজনার সত্বাধিকারীও ছিল তাঁরা। সবটাই চলত দলাই লামার প্রশাসকমণ্ডলীর তত্ত্বাবধানে। এককথায় , চিনা সম্রাটদের সঙ্গে তিব্বত ও তাঁর সর্বময় আধ্যাত্মিক গুরুর সম্পর্ক ছিল পুরোহিত ও যজমানের। কার্যত, রাজপুরোহিতের মর্যাদা পেতেন দলাই লামা।

১৯১১-তে এই ব্যবস্থায় বড়সড় পরিবর্তন এল। কিং বংশের রাজত্বের অবসান হল চিনে। সান ইয়াত সেনের নেতৃত্বে সেই গণতান্ত্রিক বিপ্লবে চিনে সবরকমের ঔপনিবেশিক শাসনেরও অবসান হল। চিন থেকে হাত গোটাতে হলেও ব্রিটিশরা বুঝে যায়,দ্রুত ভারত সীমান্তে পট পরিবর্তন হচ্ছে। তিব্বতে এই সুযোগে একটি স্বাধীন সরকার প্রতিষ্ঠায় সম্পূর্ণ মদত দেয় ব্রিটিশ পার্লামেন্ট।  সঙ্গী হিসেবে পেয়ে যায় আমেরিকাকে। বিপ্লবের আগে দীর্ঘ দিন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক আশ্রয়ে থাকা সান ইয়াত সেন এক্ষেত্রে কোনও আপত্তি করেননি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ও কয়েক বছরের মধ্যে রাশিয়ায় কমিউনিস্ট বিপ্লবের পর তিব্বতকে ভারত ও সোভিয়েতের মাঝে বাফার জোন হিসেবে রক্ষা করার প্রয়োজন আরও বেড়ে যায় ব্রিটিশদের কাছে। কারণ,তখনও গণতান্ত্রিক চিনের সেনাবাহিনী অত্যন্ত দুর্বল। যে কোনও মুহুর্তে সামন্ত প্রভুরা চিনে ফের ক্ষমতা দখল করতে পারে এই ভয় ছিল। সেক্ষেত্রে, কমিউনিস্ট রাশিয়া অতি দ্রুত চিন দখল করে পুতুল সমাজতান্ত্রিক সরকার বসিয়ে দিয়ে সরাসরি ভারত-সহ গোটা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলবে, এই ছিল ব্রিটিশদের আশঙ্কা। তখনও পর্যন্ত গণতান্ত্রিক চিনের সরকারের দিক থেকে কোনও বিপদের আশঙ্কা ছিল না।

এই পরিস্থিতির আমূল পরিবর্তন ঘটে গেল ১৯৫০-এ। মাও সে তুং-এর নেতৃত্বে চিনে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সফল করে কমিউনিস্টরা ক্ষমতায় এল। সদ্য স্বাধীন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নেহরু সেই সরকারকে স্বীকৃতি দিলেন অতি দ্রুত। সোভিয়েত ঘনিষ্ঠ জওহরলাল নেহেরু হয়ত মনে করলেন প্রতিবেশী দেশে কমিউনিস্ট সরকার,তাঁর হাত শক্ত করল। তিনি এক তরফা চিনকে গুরুত্ব দিতে শুরু করলেন। প্রথম দিকে মাও-এর নেতৃত্বে চিনা সরকার ও কমিউনিস্ট পার্টি তিব্বত নিয়ে যথেষ্ট সংবেদনশীল মনোভাবই দেখাচ্ছিল। দুর্বল তিব্বতি সেনাবাহিনীকে হারিয়ে তাদের তিব্বত দখল করতে কয়েকদিন মাত্র সময় লাগলেও দলাই লামা ও তাঁর প্রশাসক পরিষদকে তাঁরা প্রভূত সম্মান দিলেন। তৈরি হল তিব্বত স্বশাসিত পরিষদ বা TAC (TIBET AUTONOMOUS COUNCIL)। চিনের সর্বোচ্চ প্রশাসকমণ্ডলীতে দলাই লামাকে তিব্বতের প্রতিনিধি হিসেবে গ্রহণ করা হল। দলাই লামা ও পাঞ্চেন লামাও নতুন চিনা শাসকদের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমেও সাক্ষাৎকার দিতে শুরু করলেন।১ ৯৫৫ পর্যন্ত এভাবেই চলল। চিনা শাসক ও তিব্বতিদের মধ্যে এই দহরম-মহরম দেখে নেহরু একটি পর্বত প্রমাণ ভুল করে বসলেন। ১৯৫৪-য় পঞ্চশীল চুক্তি স্বাক্ষর করতে গিয়ে নেহরু তিব্বতকে চিনের অংশ বলে বলে স্বীকার করে নেন।তিব্বতকে চিনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে মেনে নিয়ে ভারত তিব্বতের ধর্মীয় স্বাধীনতা ও ঐতিহ্য রক্ষায় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ থাকার কথা ঘোষণা করল বটে, কিন্তু,৪৩ বছর ধরে অস্তিত্ববান স্বাধীন গণতান্ত্রিক তিব্বতের বিলুপ্তির কাগজও নিজের হাতে স্বাক্ষর করে দিল। ফলে বাফার জোন তিব্বতের আর অস্তিত্ব রইল না। নেহরুর যুক্তি ছিল, তিনি ঔপনিবেশিক সীমানা ও ভূ-রাজনীতির বাইরে বেরিয়ে দুটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের মধ্যে সুস্থ সম্পর্ক তৈরি করতে চাইছেন। বিনিময়ে ভারত কী পেল? ততদিনে প্রথম কাশ্মীর যুদ্ধ হয়ে গেছে। চিন কিন্তু, জম্মু-কাশ্মীরকে ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ বলে কোনও ঘোষণা করল না। উল্টে, ঔপনিবেশিক কারণে ম্যাকমোহন লাইনের অসাড়তার কথা বলে ভারত-চিন সীমানা পুনর্নিধারণের দাবি জানিয়ে রাখল।পরবর্তী সময়ে ওই ছিদ্রপথেই অরুণাচল ও আকসাই চিন নিজেদের ভূখণ্ড বলে দাবি করে চিন।১৯৬২-র যুদ্ধে অরুণাচল আক্রমণ ও পাক অধিকৃত কাশ্মীর থেকে আকসাই চিন কেটে বের করে নেওয়া চিনের সেই পঞ্চশীল চুক্তির সফল ব্যবহার।

১৯৫৮-য় দেশের ভিতর মাও সে তুং-এর গ্রেট লিপ ফরোয়ার্ড-এর ডাক মুখ থুবড়ে পড়ে। পার্টি আর আমলাতন্ত্রের অপদার্থতা আর মিথ্যাচারে দু’কোটি চিনা নাগরিক দুর্ভিক্ষে প্রাণ হারান। দেশের ভিতর সেই বিরাট বিপর্যয় ধামা-চাপা দিতে শুরু হয় চিনা সেনা ও পার্টি ক্যাডারদের তিব্বত অভিযান। এরপর দলাই লামা ও তাঁর সঙ্গে ৩০ লক্ষ তিব্বতির পালিয়ে আসা ও ভারতে আশ্রয় পাওয়ার ইতিহাস সবাই জানেন। কিন্তু,অনেকেই জানেন না , ১৯৫৬ থেকেই চিনা সরকারের ভাবগতিক সুবিধার না ঠেকায় দলাই লামা নয়াদিল্লি এসে তখনই ভারতে রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়েছিলেন।‘বন্ধু’ চৌ-এন-লাইকে নেহরু সেবার তাঁকে তিব্বত ফিরে যেতে বলেন। ১৯৫৯-এ আশ্রয় দিয়ে সে ভুলের প্রায়শ্চিত্ত সম্ভব হয়নি। কারণ, ভারতের নিস্ক্রিয়তার সুযোগে ততদিনে তিব্বতে জাঁকিয়ে বসেছে চিন।

’৬২-র যুদ্ধে চিনের চূড়ান্ত বিশ্বাসঘাতকার পরও ভারতের সামনে সুযোগ ছিল। রাষ্ট্রসংঘে প্যালেস্তাইনের মত করে তিব্বতকেও পর্যবেক্ষক রাষ্ট্র করার জন্য ভারত সক্রিয় হলে অনায়াসে পশ্চিমি দেশগুলি-সহ আন্তর্জাতিক দুনিয়ার সমর্থন মিলত। অথচ, প্রথম ক্ষেত্রে ভারতের অতি সক্রিয়তা থাকলেও দ্বিতীয় ক্ষেত্রে ছিল হিরণ্ময় নীরবতা। ভারতে ধর্মশালায় প্রতিষ্ঠিত দেশান্তরী তিব্বতি সরকারকে(GOVERNMENT-IN-EXILE) ব্যবহার করে চিনকে অস্বস্তিতে ফেলার জন্য বিন্দুমাত্র চেষ্টাও করেনি নয়াদিল্লি।

অত্যন্ত দুর্বল ও দিশাহীন চিন নীতি সত্ত্বেও ২০১৪ পর্যন্ত ভারতের কেন্দ্র সরকারগুলি কখনও দলাই লামাকে সেন্সর বা কম গুরুত্বপূর্ণ করে তোলার চেষ্টা করেনি। অথচ,আত্মনির্ভর ও বাস্তববোধ সম্পন্ন বিদেশনীতির প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় আসা নরেন্দ্র মোদী সরকার ঠিক সেটাই করল। চিনের শাসককূলকে সন্তুষ্ট করতে দলাই লামার ‘মিডিয়া প্রেজেন্স’ কমানো হল পরিকল্পনা মাফিক। চিনা প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সাক্ষাতের অনুমতি চাইলেও দলাই লামাকে সেই অনুমতি দেওয়া হল না। তিব্বতিদের স্বাধীনতা তো দূর অস্ত,তাঁদের স্বায়ত্ত্বশাসন নিয়ে সরকারি স্তরে এতদিনকার নিয়মমাফিক বিবৃতিও বন্ধ হল। উল্টে, চিনের তৈরি করা সপ্তদশ কর্মাপা লামার বিরোধিতা করে একটি বিবৃতিও ভারতে থাকা প্রকৃত সপ্তদশ কর্মাপা লামার পক্ষে ভারত সরকার দেয়নি। চিন এখন পরবর্তী দলাই লামা ‘উৎপাদন’ করছে। অরুণাচল প্রদেশে দলাই লামাকে দীর্ঘ পাঁচ বছর যেতে না দিয়ে ভারত সরকার কাকে তুষ্ট করতে চেয়েছে তা একটি শিশুও বোঝে। কিন্তু, এসবের বিনিময়ে ভারত কী পেল? মাসুদ আজহারকে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদী ঘোষণার চেষ্টায় রাষ্ট্রসংঘে চিনের ধারাবাহিক আপত্তি ও বাধাদান।অরুণাচল প্রদেশকে আজও চিনের অংশ বলে নিজেদের ম্যাপে চিনের দাবি করা। সবশেষে লাদাখে চিনা আগ্রাসন,গালওয়ানে ২০ জন সেনা জওয়ানের প্রাণের বিনিময়ে যা প্রতিহত হল।তারপরেও চিন তার দাবি থেকে একচুল নড়েনি।

এখন ভারতের বিদেশমন্ত্রী বলছেন, পরিস্থিতি এতটাই গুরুতর যে ভারত-চিন সীমান্ত সমস্যা নিয়ে রাজনৈতিক স্তরে আলোচনা চাই। তবু ভারত স্বাধীন তিব্বতের দাবিতে নিজের সমর্থন ঘোষণা করছে না। সেটা ঘোষণা করলে, চিন কতখানি কূটনৈতিক সমস্যায় পড়বে তার জন্য একটা উদাহরণই যথেষ্ট। লাদাখের সীমান্ত তখন ভারত-চিন নয়, ভারত-তিব্বত সীমান্ত হিসেবে চিহ্নিত হবে। ভারত সীমান্ত নিয়ে আলোচনা করবে ভারতে থাকা দেশান্তরী তিব্বতি সরকারের সঙ্গে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে এই সময় প্রচারের অভিমুখ, তিব্বত। কারণ, আধুনিক বিশ্বের জ্যেষ্ঠতম গণতন্ত্র জানে অ্যাকিলিসকে গোড়ালিতেই মারতে হয়। অথচ, বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র মনে রাখেনি তার শ্রেষ্ঠ কূটনীতিক সন্তানের দুটি পরামর্শ, শঠের সঙ্গে শঠের মতই আচরণ করতে হয়, আর প্রতিপক্ষকে তার ঘরে ব্যতিব্যস্ত রাখতে হয়।

আরও পড়ুন- সংখ্যালঘু ইন্দিরার ‘ব্যাকবোন’! ৩ সাংসদ নিয়েও ‘ক্রাইসিস ম্যানেজার’ প্রণব

.