দাদরি হত্যাকাণ্ড: ছয় অভিযুক্তের নিশর্ত মুক্তির দাবি স্থানীয় বিজেপির

সোমবার রাতে গরুর মাংস খেয়েছেন সন্দেহে উন্মত্ত ধর্মান্ধ কিছু ব্যক্তি পিটিয়ে খুন করেছিল মহম্মদ ইকলাখকে। শুধুমাত্র গুজবের বলি হতে হয়েছে দাদরির এই প্রৌঢ়কে।

Updated By: Oct 2, 2015, 09:48 AM IST
 দাদরি হত্যাকাণ্ড: ছয় অভিযুক্তের নিশর্ত মুক্তির দাবি স্থানীয় বিজেপির

ওয়েব ডেস্ক: সোমবার রাতে গরুর মাংস খেয়েছেন সন্দেহে উন্মত্ত ধর্মান্ধ কিছু ব্যক্তি পিটিয়ে খুন করেছিল মহম্মদ ইকলাখকে। শুধুমাত্র গুজবের বলি হতে হয়েছে দাদরির এই প্রৌঢ়কে। ঘোষিত হিন্দুত্ববাদীদের এই নৃশংসতায় এই মুহূর্তে বিতর্ক দেশজুড়েই। উঠে আসছে অমোঘ এক প্রশ্ন। কে, কী খাবেন, কার মেনুতে মুরগী থাকবে নাকি গরু, সে বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার অধিকার কীভাবে অন্য কারোর থাকে? পরিস্থিতির ভয়াবহতা টের পাওয়া যায়, যখন ইকলাখদের ফ্রিজে থাকা মাংসের ডিনএনএ টেস্ট করতে পাঠায় স্বয়ং পুলিস প্রশাসন। সেই টেস্টের রিপোর্টও মিলেছে। রিপোর্ট অনুযায়ী, গরু নয়, ইকলাখদের বাড়িতে খাওয়ার জন্য রাখা ছিল পাঁঠার মাংস। আর এখানেই আরও একবার জোরদার হচ্ছে সেই বিতর্ক। যদি, পাঁঠার মাংসের পরিবর্তে গরুর মাংসই পাওয়া যেত মহম্মদ ইকলাখের বাড়ি থেকে, তাহলেও কি কোনওভাবে বিন্দুমাত্র সমর্থনযোগ্য হত ইকলাখকে হত্যা? একটুও কম হত কি তাঁর খুনীদের অপরাধ? অপরাধীদের শাস্তিদানের সঙ্গে মাংসের ডিনএনএ টেস্টের সম্পর্ক কী, সেই প্রসঙ্গে মুখে খুলুপ এঁটেছে স্থানীয় প্রশাসন। তবে, এই ঘটনার পর শুধু দাদরি নয়, গোটা দেশ জুড়েই যে চরম ক্ষোভ তৈরি হয়েছে সাধারণ মানুষের মনে, তার সামাল দিতে মাঠে নামতে বাধ্য হয়েছেন উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী অখিলেশ যাদব। মৃতের পরিবারের জন্য ১০ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ ঘোষণা করেছেন তিনি। গ্রেফতার করা হ্যেছে অভিযুক্ত কয়েকজনকেও। কিন্তু সত্যিই কী শুধুমাত্র ক্ষতিপূরণ দিয়ে এই সমস্যার সমাধান সম্ভব? সত্যিই কি সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ, ধর্মান্ধতার জেরে খুন হয়ে যাওয়া একটা মানুষের জীবনের মূল্য এভাবে টাকার অঙ্কে বেঁধে দেওয়া সম্ভব? সাংবিধানিক ভাবে ধর্ম নিরপেক্ষ একটা দেশে এই সামাজিক অসুখ সারাতে সরকারি স্তরে কী উদ্দ্যোগ নেওয়া হয়েছে, সেই প্রশ্নের উত্তর মেলেনি রাজ্য বা কেন্দ্র সরকারের তরফ থেকে। 

এই মুহূর্তে গোটা উত্তরপ্রদেশ জুড়েই সাম্প্রদায়িক ইস্যুতে তীব্র চাপানউতোর চলছে। অনঅভিপ্রেত কোনও রকম ঘটনা, বিতর্ক এড়াতে এই মুহূর্তে কড়া নিরাপত্তা বলয়ে ঢেকে ফেলা হয়েছে গোটা দাদরি। বুধবার সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা আরও খানিকটা উস্কে দিল স্থানীয় বিজেপি। বুধবার দাদরির ধুম মানিকপুর গ্রামের একটি স্কুলে বৈঠকে বসেছিল বিজেপির নেতৃত্বাধীন মহাপঞ্চায়েত। সেই মিটিংয়ে রীতিমত রেসোলুশ্যন পাস করানো হয়েছে। ইকলাখের খুনিদের শাস্তিতো দূরাস্ত, তারা অভিযুক্ত ৬ বিজেপি সমর্থকের মুক্তির দাবি জানিয়েছে। উল্টে 'গোহত্যাকারীদের' কঠিন শাস্তির দাবি তুলেছে। 

স্থানীয় বিজেপি নেতা বিচিত্র তোমার জানিইয়েছে স্থানীয় বিজেপি ইউনিটের পক্ষ থেকে রাজ্যে ক্ষমতাসীন এসপি সরকারের তীব্র সমালোচনা করা হয়েছে। সরকারের বিরুদ্ধে গোহত্যা প্রতিরোধে নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগ আনা হয়েছে। 

''বিসাদার ঘটনায় অভিযুক্ত প্রত্যেকের অবিলম্বে মুক্তির দাবি জানাচ্ছি আমরা। অভিযুক্ত প্রত্যেকেই নিরাপরাধ। আমরা গোহত্যার সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থার গ্রহণের দাবি জানাচ্ছি। এই ধরণের ঘটনা হিন্দুদের ধর্মীয়ভাবাবেগে আঘাত করেছে।'' মন্তব্য তোমারের। বিজেপির তরফ থেকে এই ঘটনার দায় রাজ্য সরকারের উপর চাপানোর প্রাণপন চেষ্টা চলছে। তাদের অভিযোগ, অখিলেশ সরকারের প্রশাসনিক দূর্বলতার ফলাফলই এই ঘটনা। 

বিজেপির তরফ থেকে জানানো হয়েছে এই বিষয়ে 'ন্যায়' না মিললে, আরও প্রবল হবে তাদের 'প্রতিবাদ'। 

যদিও, ইকলাখের মৃত্যুর ঘটনাকে বেদনাদায়ক ব্লে ব্যাখা করেছেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী মহেশ শর্মা। নয়ডার এই বিজেপির সাংসদের মতে এই ঘটনা নাকি ভুল বোঝাবুঝির ফসল মাত্র। অন্যদিকে, বিতর্কের পারদ বেশ কয়েক ধাপ চড়িয়েছেন প্রাক্তন বিজেপি বিধায়ক। নবাব সিং নাগর। তাঁর মতে গোমাংস ভক্ষণ অপরাধ। তাই সেই 'অপরাধে' যারা সামিল, ঘটনার দায় তাদের উপরই বর্তায়। 

বিজেপি কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসার পর থেকেই এদেশে আরও বিপন্ন হয়েছেন সংখ্যালঘুরা। এই অভিযোগ গত এক বছরে সমাজের বিভিন্নস্তর থেকেই উঠে এসেছে। গোরুকে 'রাষ্ট্রমাতা' ঘোষণা করার জন্য সঙ্ঘপরিবার সহ অনান্য গেরুয়াবাহিনী বহুবার দাবি জানিয়েছে। সেই দাবিতে প্রকাশ্যেই গলা মিলিয়েছেন বিজেপির বহু নেতা, মন্ত্রীরা। বিজেপি শাসিত গুজরাত, মুম্বইয়ে ইতিমধ্যেই নিষিদ্ধ হয়েছে গোমাংস বিক্রি। একই পথে হাঁটার ইঙ্গিত মিলেছে আরও কয়েকটি বিজেপি শাসনাধীন রাজ্যেও।

মানুষের খাদ্যাভাস, খাদ্যের যোগান, লভ্যতা, আঞ্চলিকতার সঙ্গেই সামাজিক অবস্থানের উপরও নির্ভরশীল। বহুক্ষেত্রে নিজস্ব রুচি এমনকি ধর্মীয় ভাবাবেগও নির্দিষ্ট খাদ্যাভাস তৈরি করে। সেখানে নিজ ধর্ম রক্ষার নামে অন্যকারোর খাদ্যাভাসে হস্তক্ষেপ মানবাধিকার লঙ্ঘনের পর্যায়েই পরে বলে দাবি বিশেষজ্ঞ মহলের। গোরুকে পুজো করা যদি কোনও নির্দিষ্ট ধর্মাবলম্বীদের অধিকার এবং ভাবাবেগের মধ্যে পরে, সেক্ষেত্রে গোরুকে খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করা বা না করাও কিন্তু অন্য ধর্মের মানুষের অধিকারের মধ্যেই পরে। 

যখন পৃথিবীর বৃহত্তম গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ দেশে যখন খাদ্যাভাসের জন্য ধর্মান্ধদের হাতে খুন হতে হয় কাউকে, প্রতিনিয়ত পিছু করে প্রাণনাশের হুমকি, অসহায় বোধ করেন সংখ্যালঘুরা, সেখানে কিন্তু দেশের 'ধর্মনিরপেক্ষতার' দিকে অবসম্ভাবিভাবেই আঙুল ওঠেই। দাদরি ঘটনা আরও একবার প্রমাণ করে গেল এদেশে বর্তমানে ধর্মীয়মেরুকরণের চোরাস্রোত কী প্রবল ভাবে বইছে। 

প্রসঙ্গত, প্রতিবেশী নেপাল সম্প্রতি সাংবিধানিকভাবে নিজেদের ধর্মনিরপেক্ষ বলে ঘোষণা করেছে। সেদেশে প্রশাসনিক্সত্রেই সমানুধিকার পেয়েছেন সমপ্রেমীরা। তরাই অঞ্চলে সংখ্যাগুরু হিন্দুরা অবশ্য এখনও হিন্দুরাষ্ট্রের দাবি জানাচ্ছেন। কোনও কোনও ক্ষেত্রে হিংস্ররূপও নিয়েছে তাদের প্রতিবাদ। অদ্ভুতভাবে, এর পরেই কিন্তু, ভারত সরকারের তরফে নেপালের সঙ্গে প্রশাসনিক অসহযোগিতার অভিযোগ উঠেছে। এই অভিযোগ কি শুধুই কাকতালীয়, ভিত্তিহীন, নাকি অন্য কোনও সমীকরণ কাজ করছে এর পিছনে? উত্তর বোধহয় একমাত্র সময়ের কাছেই... 
 

.