"ফাদার ইল, কাম শার্প,"... আর শোনা যাবে না
ই-মেল, মোবাইলের যুগে অচল টেলিগ্রাম। ১৫ জুলাই থেকে তাই আর টরেটক্কার শব্দ শোনা যাবে না। এ দেশে বন্ধ করা হচ্ছে টেলিগ্রাম পরিষেবা।
ই-মেল, মোবাইলের যুগে অচল টেলিগ্রাম। ১৫ জুলাই থেকে তাই আর টরেটক্কার শব্দ শোনা যাবে না। এ দেশে বন্ধ করা হচ্ছে টেলিগ্রাম পরিষেবা।
টেলিগ্রাফ যন্ত্রের সামনে দাঁড়িয়ে আমেরিকার দাস বিদ্রোহের নায়ক গিডিয়ন জ্যাকসন। কৃষ্ণকায়। লেখাপড়া শেখেননি। পাঠাতে চান বিদ্রোহীদের জন্য বাহিনী পাঠানোর আর্জি। কিন্তু টেলিগ্রাফ মেশিনের শিক্ষিত অপারেটর শ্বেতাঙ্গ। কালো চামড়ার বিদ্রোহী যে খবর পাঠাতে চেয়েছিলেন, পাঠিয়ে দিলেন তার উল্টো খবর। দাস মালিকদের বাহিনী এসে দমন করল বিদ্রোহ। টেলিগ্রাফ যন্ত্র এভাবেই অমর হয়ে আছে দক্ষিণ আমেরিকার দাস বিদ্রোহের পটভূমিতে লেখা উপন্যাসে। সেই উপন্যাস এখন যেমন ইতিহাস, তেমনই একবিংশ শতাব্দীতে ইতিহাসের অধ্যায় হয়ে গেলে টেলিগ্রাফ।
দেড়শ বছরেরও বেশি সময়। আঠারোশ চুয়াল্লিস। বৈদ্যুতিক টেলিগ্রাফ ব্যবস্থা বদলে দিয়েছিল পৃথিবীটাকে। আঠারশো ছত্রিশ। মার্কিন বিজ্ঞানী স্যামুয়েল এফ বি মর্স, আলফ্রেড ভেল এবং জোসেফ হেনরি বুঝতে পারেন বৈদ্যুতিক তারের মাধ্যমে বার্তা পাঠানো সম্ভব। তবে তারে বার্তা বহনে নির্দিষ্ট হরফ বা ভাষার প্রথম জন্মদাতা স্যামুয়েল মর্স। তাঁর নামেই ইন্টারন্যাশনাল মর্স কোড। ব্রিটিশ বিজ্ঞানীরাও বৈদ্যুতিক টেলিগ্রাফকে আরও আধুনিক করতে সচেষ্ট ছিলেন। কিন্তু বাণিজ্যিকভাবে বেশি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে মার্কিনদের টরেটক্কাই। এরপর পাল্টে গেল দূরত্বের সংজ্ঞাটাই। বাণিজ্যিক বার্চা থেকে ব্যক্তিগত সংবাদ, সাত সমুদ্র তেরো নদী পেরিয়ে চলে গেল দুনিয়ার দূরতম প্রান্তে।
পল জুলিয়াস রয়টার্স। সংবাদ সংস্থার ব্যবসা বাড়াতে সাহায্য নিলেন বৈদ্যুতিক টেলিগ্রাফ প্রযুক্তির। দেশ-দেশান্তরেও দ্রুত পৌঁছে যেতে লাগল রয়টার্সের তারবার্তা। জাহাজের নাবিকদের বিপদসঙ্কেত পাঠাতে বিপ্লব এনে দেয় বৈদ্যুতিক টেলিগ্রাফ। তারবার্তা বদলে দিল যুদ্ধের চেহারাও। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় শত্রুপক্ষ সম্পর্কে তথ্য বা নির্দেশ পাঠাতে সামরিক কর্তারা বৈদ্যুতিক টেলিগ্রাফ ব্যবস্থা ব্যাপকভাবে ব্যবহার করেন।তৈরি হল সামরিক বাহিনীর নতুন বিভাগ। জন্ম, মৃত্যু, বিবাহ থেকে সন্তানের জন্ম, একটা সময়ে খবর পাঠানোর জন্য টেলিগ্রাফই ছিল সভ্যতার ভরসা। এ দেশে বৈদ্যুতিক টেলিগ্রাফ ব্যবস্থা প্রায় একশ ষাট বছরের পুরনো। তারবার্তা পাঠাতে সাধারণ মানুষকে শিক্ষিতও করে তুলতে চেয়েছিল সরকার। সিলেবাসে টেলিগ্রাফিক ইংলিশ লেখার বিশেষ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা ছিল এই তো কিছুদিন আগেও। কিন্তু তারপর এল মোবাইল, এসএমএস, ই মেল। নতুন প্রযুক্তি মৃত্যুঘণ্টা বাজিয়ে দিলে পুরনো প্রযুক্তির। অচল হয়ে পড়ল টেলিগ্রাফ। অলাভজনক হওয়ায় আগেই বিদেশে টেলিগ্রাম পাঠানোর ব্যবস্থা বন্ধ করেছে ভারত সঞ্চার নিগম লিমিটেড। এবার দেশের মধ্যেও বৈদ্যুতিক টেলিগ্রাফ বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএসএনএল কর্তৃপক্ষ। নিজেদের বিভিন্ন দফতরে সার্কুলার পাঠিয়ে বিএসএনএল কর্তৃপক্ষ নির্দেশ দিয়েছে পনেরই জুলাই থেকে আর এই পরিষেবার জন্য কোনও বুকিং নেওয়া যাবে না।
এখন থেকে আর শোনা যাবে না টরেটক্কার শব্দ। হৃদপিণ্ডের গতি বাড়িয়ে দিয়ে ডাকপিওন এসে সদরে হাঁক দিয়ে বলবে না, টেলিগ্রাম। তবে থেকে যাবে অষ্টাদশ শতকের এই প্রযুক্তির ইতিহাস বইয়ের পাতায়, পুরনো বাংলা গানের সুরে।