ক্রাইসিসে ফেলে দিলেন 'ক্রাইসিস ম্যানেজার'!

কে জানে, এবার কে ম্যানেজ করবে!

Updated By: May 30, 2018, 03:12 PM IST
ক্রাইসিসে ফেলে দিলেন 'ক্রাইসিস ম্যানেজার'!

নির্ণয় ভট্টাচার্য্য

প্রণববাবু কী বলবেন? আপাতত এই প্রশ্নেই তোলপাড় ভারতের জাতীয় কংগ্রেস। রাজনীতি থেকে সন্ন্যাস নিয়ে তিনি যতই 'সিটিজেন মুখার্জি' (টুইটারে এই নামেই তিনি পরিচিত) হয়ে যাক, তবু প্রণববাবুই তো একদা এআইসিসি-র বুরারি অধিবেশনে দেশের প্রজাতান্ত্রিক কাঠামোয় আরএসএস-এর মতো মৌলবাদী সংগঠনের আঘাত হানার চেষ্টাকে তীব্র আক্রমণ করে খসড়া প্রস্তাব রচনার মূল কারিগর। সারা জীবন ধরেই কীর্ণাহারের এই ব্রাহ্মণ সন্তান আনখশির কংগ্রেসি, আর সেই তিনিই কি না রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সঙ্ঘের প্রচারকদের সমাবর্তনে প্রধান অতিথি! বিষয়টা কিছুতেই হজম হচ্ছে না কংগ্রেস নেতৃত্বের একটা বড় অংশের।

প্রায় অর্ধ শতবর্ষ জাতীয় রাজনীতির অলিন্দে প্রবলভাবে বিরাজ করেছেন প্রণব মুখোপাধ্যায়। ২০১২ সালে রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচিত হয়েছেন তিনি। আর সেই থেকেই নিজেকে দলীয় রাজনীতির মূল স্রোতের বাইরে রেখেছেন তিনি। প্রণববাবুর পুত্র ও কন্যা সরাসরি রাজনীতিতে যুক্ত থাকলেও, প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি দীর্ঘদিন দলীয় রাজনীতির ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে চলছেন সচেতনভাবে। তবু, ইন্দিরা গান্ধীর স্নেহধন্য এবং কেন্দ্রের প্রতিটি কংগ্রেস সরকারের মন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায় নাগপুরে আরএসএস-এর অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণ গ্রহণ করায় স্পষ্টতই দ্বিধা বিভক্ত এবং বিহ্বল কংগ্রেস।

প্রণবের এই সিদ্ধান্তে দল হিসাবে কংগ্রেস আপাতত মন্তব্য না করার রাস্তায় হাঁটলেও, এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে দলের মুখপাত্র টম ভাদাক্কন শুধু বলেছেন, "কংগ্রেস ও আরএসএস-এর আদর্শের মধ্যে আকাশ-পাতাল তফাত"। ভাদাক্কনের এই মন্তব্যকেই অত্যন্ত ইঙ্গিতপূর্ণ বলে মনে করছে রাজনৈতিক মহল। তাঁদের মতে, সরাসরি কোনও মন্তব্য না করে কেবল আদর্শগত ফারাকের কথা বলে কার্যত প্রণবের এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধেই কথা বলেছেন কংগ্রেস মুখপাত্র। আরও পড়ুন- নাগপুরে স্বয়ংসেবকদের উদ্দেশে ভাষণ দেবেন প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়?

টম ভাদাক্কন সরাসরি কিছু না বললেও, কংগ্রেসের আরেক মুখপাত্র তথা প্রখ্যাত আইনজীবী অভিষেক মনু সিংভি আবার আস্থা রেখেছেন 'চাণক্য'র রাজনৈতিক অতীত ও বিচারবুদ্ধির উপর। পশ্চিমবঙ্গ থেকে সদ্য নির্বাচিত রাজ্যসভার এই সাংসদ বলেন, "একটা সমাবর্তনে বক্তৃতা দেওয়া থেকে তাঁর বিশ্বাস সম্পর্কে কিছু আঁচ করা যায় না। বরং তাঁর অর্ধশতকের রাজনৈতিক জীবন থেকেই তাঁকে বিচার করা উচিত"। সিংভির কথার সারমর্মকে সমর্থন করে একাংশের কংগ্রেস নেতারা আবার মনে করছেন, আরএসএস-এর সমাবর্তন মঞ্চে দাঁড়িয়ে প্রণববাবু 'প্রকৃত জাতীয়তাবাদ' নিয়েই কথা বলবেন। আর প্রাক্তন রাষ্ট্রপতির সেই বক্তব্য রীতিমত অস্বস্তিতে ফেলবে মৌলবাদীদের, এমনটাই আশা করছেন তাঁরা। অনেকে আবার মনে করিয়ে দিচ্ছেন, খোদ মহাত্মা গান্ধীও ১৯৩৪ সালে আরএসস-এর শিবিরে গিয়েছিলেন। আরও পড়ুন- ‘আরএসএস তো আইএসআই নয়, প্রণববাবু গেলে এত কিসের হইচই’, সরব গডকরি

তবে একাংশের কংগ্রেস নেতারা যতই প্রণবের কংগ্রেসি সংস্কৃতির উপর ভরসা রাখুক, সামগ্রিকভাবে বিষয়টি কংগ্রেসের বিড়ম্বনা বাড়াবে বলেই মনে করছে দলের একটা বড় অংশ। এমনিতে ঘনিষ্ঠ বৃত্তে প্রণববাবু বারবার তাঁর সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী মোদীর 'সুসম্পর্কে'র কথা বলেছেন। এমনকী প্রণব রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন মোদী যে তাঁকে 'যথাযোগ্য সম্মান' দিতেন সে কথাও স্বীকার করেছেন তিনি। এছাড়া, রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন প্রণব রাইসিনা হিলসে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন আরএসএস প্রধান মোহন বাগবতকেও। সামগ্রিকভাবে এসবই সৌজন্যমূলক হলেও, তা রাজনৈতিকভাবে কংগ্রেসকে কিছুটা হলেও অস্বস্তিতে ফেলেছে। পাশাপাশি, লোকসভা ভোটের প্রাক্কালে যখন বিজেপি বিরোধী একটা ধর্মনিরপেক্ষ জোটের সলতে পাকানোর কাজ চলছে, সে সময় নাগপুরে প্রণবের উপস্থিতিকে গৈরিক শিবির নিজেদের ভাবমূর্তি উদ্ধারে কাজে লাগাতে চাইবে বলে মনে করছেন তাঁরা। উল্লেখ্য, প্রণব মুখোপাধ্যায়ের আরএসএস-এর আমন্ত্রণ গ্রহণ করা নিয়ে তৈরি হওয়া বিতর্কে ইতিমধ্যে মুখ খুলেছেন সঙ্ঘ ঘনিষ্ট বিজেপি নেতা তথা কেন্দ্রীয় মন্ত্রী নীতীন গড়কড়ি। তাঁর তির্যক প্রশ্ন, আরএসএস তো আর আইএসআই নয়, তাহলে এত বিতর্কের কারণ কী? আরও পড়ুন- শিকাগোয় বিশ্ব হিন্দু সম্মেলনে রঘুরাম রাজনকে আমন্ত্রণ জানাল সংঘ পরিবার

এমতাবস্থায় প্রণবের এই আমন্ত্রণ গ্রহণকে ঘিরে কংগ্রেসের একাংশের নেতারা যে কতটা ভেঙে পড়েছে তার প্রমাণ মেলে প্রবীণ নেতা সিকে জাফেরের প্রতিক্রিয়ায়। এই খবর কানে যাওয়ার পরই প্রাক্তন সহকর্মী প্রণববাবুকে ইতিমধ্যে একটি চিঠি লিখেছেন তিনি। সেই চিঠিতে তিনি প্রণবকে সরাসরি নিমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করার অনুরোধ জানিয়েছেন। এই মুহূর্তে দেশের বাইরে রয়েছেন রাহুল ও সনিয়া। ফলে এ বিষয়ে তাঁদের মন্তব্য এখনও জানা যায়নি। তবে দেশে থাকলেও আপাতত চুই থেকে জল মাপতেন মাতা-পুত্র, এমনটাই মনে করছেন পর্যবেক্ষকরা। তবে, বর্তমানে প্রায় প্রতিটি বক্তৃতায় বা টুইটে আরএসএস-কে আক্রমণ করা কংগ্রেস সভাপতি রাহুলের জন্য এই খবর যে মোটেই সুখের নয়, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। ফলে, বেশ কয়েক বছর পর কংগ্রেস ফের প্রণবময়। অনেকে আবার বলছেন, আজীবন কংগ্রেসের 'ক্রাইসিস ম্যানেজার' হিসাবে কাজ করা প্রণববাবু, প্রত্যক্ষ রাজনীতি ও দল ছেড়ে দিয়ে শেষ বেলায় কংগ্রেসকে ক্রাইসিসেই ফেলে দিলেন। কে জানে, এবার কে ম্যানেজ করবে!

.