Durga Puja 2022: নিজেরে হারায়ে খুঁজি
বাড়িটা দাঁড়িয়ে আছে কালের সাক্ষী হয়ে। পুকুরের গাছগুলো আরও অন্ধকার করে তুলেছে জায়গাটা। সকালের স্নিগ্ধ বাতাস আর আলো আঁধারীতে পুকুরটা আগের মতোই রহস্যময়। ফিরে যাচ্ছে মাটি তার আপন সংসারে। এখন শুধু সামনে এগিয়ে যাওয়ার পালা। পিছনে পরে থাকল তাঁর মেয়েবেলা, তাঁর স্বপ্নের জগৎ।
নিজেরে হারায়ে খুঁজি
চন্দ্রা রায় বর্মণ
শেষ বিকেলের সোনা রঙ মুছে ধেয়ে আসছে কালবৈশাখী। আকাশ ছেয়ে গেছে কালো মেঘে। ঝড়ের দাপটে উথাল পাথাল প্রকৃতি। ছোট মেয়ে মাটি তার বন্ধুদের সঙ্গে খেলায় ব্যস্ত। কোনও দিকে খেয়াল নেই। যখন খেয়াল হল তখন ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টির সঙ্গে শুরু হয়েছে ঝড়ের তান্ডব। ঘটনার আকস্মিকতায় ভয় পেয়ে দিশাহারা হয়ে যায় সে আর তার বন্ধুরা।
এমন সময় দূর থেকে ভেসে আসে ঠাকুমার স্নেহমাখা ডাক – ‘মাটি… মাটিই…’। এক ছুটে ঠাকুমার কোলে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে ‘মৃত্তিকা’ – ঠাকুমার আদরের মাটি।
মাটি থাকে তাঁদের গ্রামের বাড়িতে। ঠাকুমা, পিসি আর কাকুর সঙ্গে। ভাইকে নিয়ে বাবা, মা থাকেন দুর প্রবাসে। গ্রামের বাড়িতে সবার স্নেহে, আদরে বড় হতে থাকে সে। প্রকৃতই মাটির মেয়ে সে, গাছপালা, পুকুর, গ্রামের লাল ধূলোর রাস্তা, পাখি, সবাই তাঁর বন্ধু। গ্রামের এক প্রান্তে গাছ গাছালি ঘেরা বাড়ি তাদের। পিছনে বিরাট পুকুর, খেজুর গাছের গুঁড়ি দিয়ে বাঁধানো ঘাট। আম, জাম, ছাতিম গাছ তাদের ছায়া ফেলে পুকুরের কালো জলকে আরও রহস্যময় করে তুলেছে। মাটির কল্পনায় আঁধার রাতে ওখানে দৈত্যরা আসে আর জ্যোৎস্না রাতে পরীরা। সন্ধ্যা হলে ঝিঁ ঝিঁ ডাকে। জোনাকি জ্বলে গাছের ফাঁকে। তখন ভীষণ ভয় করে তার।
পড়া শেষে উঠোনে বসে গান শোনে। পিসির গলার গান অপূর্ব মায়াময় পরিবেশ সৃষ্টি করে – নাম না জানা ফুলের গন্ধে বাতাস ভারী হয়। ছ্রচাঁদের আলো মাটির চোখে স্বপ্ন কাজল পরিয়ে দেয়।
কাকু অসাধারণ ছবি আঁকে। মাটি চুপ করে বসে দেখে। দিন যায় – এক সময় বাবা ফিরে আসেন কর্মসূত্রে, কাছাকাছি এক শহরে। বাবা-মায়ের সঙ্গে মাটি চলে যায় সেখানে। তার স্বপ্নের নীড় আর বন্ধুদের ছেড়ে। কালের নিয়মে দিন কাটে। পিসির বিয়ে হয়ে যায়, আর সে চলে যায় হোস্টেলে, উচ্চশিক্ষার জন্য। কিন্তু ছোটবেলার সেই মায়াঘেরা কল্পনার জগৎ তাকে আচ্ছন্ন করে রাখে। মনে পড়ে ফুলে ভরা ছাতিম গাছটার কথা।
পড়ুন, বাঙালির প্রাণের উৎসবে আমার 'e' উৎসব। Zee ২৪ ঘণ্টা ডিজিটাল শারদসংখ্যা
ছাতিম ফুলের গন্ধ আর হোস্টেলের রুদ্রপলাশ, নাগকেশর, অশোক সব একাকার হয়ে যায়। মাঝে মাঝে গ্রামের বাড়িতে আসে মাটি। ঠাকুমা এখন একা। কাকুও চাকরি করে বাইরে। ঠাকুমার কোলে মাথা রেখে ফিরে পেতে চায় তাঁর স্বপ্নগুলোকে। কিন্তু কোথাও একটা না পাওয়ার হতাশা ওকে কষ্ট দেয়।
পড়া শেষে বিয়ে হয়ে সে চলে আসে রাজধানীতে। সংসার, চাকরী সামলে ফেলে আসা দিনের কথা ভুলতে বসেছে। সে ভাবে, কিন্তু আর যাওয়া হয়না গ্রামের বাড়িতে।
কেটে গিয়েছে বেশ কিছুদিন। হঠাৎ খবর আসে, তার প্রাণপ্রিয় ঠাকুমা আর নেই। কাঁদতেও ভুলে যায় সে। তীব্র এক অভিমানে বার বার ভাবে এমন তো কথা ছিল না। সে তো কখনও ভাবেনি ঠাকুমা তাকে ছেড়ে চলে যাবে। ওখানেই তো রাখা আছে তার স্বপ্নের জগৎ। যত্নে ঠাকুমার আঁচলের তলায় আর কে আগলে রাখবে তাকে আদরে সোহাগে।
হঠাৎ একটা ঝাঁকুনি লেগে চিন্তার জগৎ থেকে ফেরে সে। গাড়িটা অজয় নদী পেরিয়ে যাচ্ছে। নদীর চড়ায় সাদা কাশফুলের মেলা। আকাশে মেঘের ভেলা। অনেকদিন পড়ে এসেছে বাবা-মায়ের কাছে পুজোতে। বেশ কয়েকটা দিন কেটে গেল আনন্দে। এবার উৎসবের শেষে বাড়ি ফেরার পালা।
ফিরে যাবার আগে হঠাৎ কি ভেবে সে গেল গ্রামের বাড়িতে। হয়তো শেষ বারের মতো। ঢুকতে গিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে গেল। কি নিস্তব্ধ নির্জন ভেঙে পড়া বাড়িটার চারপাশ! চারদিকে আগাছা আর জঙ্গলে ভরে গিয়েছে। ঠাকুমার সাধের তুলসী মন্দিরের ভগ্নপ্রায় অবস্থা।
বাড়িটা দাঁড়িয়ে আছে কালের সাক্ষী হয়ে। পুকুরের গাছগুলো আরও অন্ধকার করে তুলেছে জায়গাটা। সকালের স্নিগ্ধ বাতাস আর আলো আঁধারীতে পুকুরটা আগের মতোই রহস্যময়।
কী ভেবে সে এগিয়ে গেলো পুকুরের দিকে। হঠাৎ হিস-হিস শব্দে থমকে যায় সে। তার সামনে গাছের আলো আঁধারীতে ফণা তুলে দাঁড়িয়ে আছে মস্ত এক উদয়নাগ। যেন বলতে চাইছে এটা আমাদের সাম্রাজ্য, এখানে এসো না। এক পা এক পা করে পিছিয়ে যায় মাটি। গেটটা ধরে শেষবারের মতো তাকিয়ে থাকে অপলকে। এক ঝলক ঠাণ্ডা বাতাস তাকে ছুঁয়ে যায়।
ফিরে যাচ্ছে মাটি তার আপন সংসারে। এখন শুধু সামনে এগিয়ে যাওয়ার পালা। পিছনে পরে থাকল তার মেয়েবেলা, তার স্বপ্নের জগৎ। গাড়ির সিটে মাথাটা এলিয়ে দিল সে। ভিতর থেকে একটা বিষাদমাখা সুর গুনগুনিয়ে উঠছিল – ‘যা হারিয়ে যায় তা আগলে বসে রইব কত আর’।