শুধুমাত্র ভোটের সময় ঘুম ভাঙে এদেশের কুম্ভকর্ণদের

আমরা নড়ে বসি। আমরা শুধু ভাবতে পারি, আহা, আমাদের অভিভাবক। জনগণের কথা ভাবতে ভাবতে বেচারারা শুদ্ধ ঘুমের সময়টুকু পান না। জনসমক্ষে ঝিমিয়ে পড়েন

Updated By: Mar 14, 2020, 06:48 PM IST
শুধুমাত্র ভোটের সময় ঘুম ভাঙে এদেশের কুম্ভকর্ণদের

দিব্যেন্দু ঘোষ

হঠাৎ যদি ঘুম ভাঙায় কেউ

স্বপ্ন শেষের আগে

মুখখানা তুই এমনি করবি

যেন প্যাঁচা লাগে

নালিশ শেষে ঐ শালাকে

দিবি আমায় তুলে

ঘুম ভাঙানোর অপরাধে

চড়াবো তাকে শূলে

(ভাই কুম্ভকর্ণকে নাকি এমনি বলেছিল দাদা রাবণ)

কথায় বলে, রাবণের রাগ। ভাইকে প্রবল ভালবাসতেন। কুচুমুচু করে আদরে ভরিয়ে রাখতেন ভাই কুম্ভকর্ণকে। আর গাবদা পেট, ভক্ষণে সুপটু ব্যাটা কালো কুচকুচে কুম্ভকর্ণও নাকি দাদাকে পেল্লায় ভক্তিচ্ছেদ্দা করত। কথায় কথায় নাকি কাঁদত। নাকি কান্না। মানে, ওই ন্যাকা কান্না আর কী! চোখের সঙ্গে টসটস করে গড়াত নাকের জলও। সেই জলে নাকি আস্ত একটা সমুদ্রের জন্ম। কারা যে সব এসব ফুক্কুরি কাটে কে জানে! জোকার না জুকের কে একটা লোক আছে না, কী সব বানিয়েছে, সেখানে মুখ আর বুক সব সমান। ফ্রেরেসবুক না কী!

আরও পড়ুন-করোনার থাবা থেকে বাঁচতে মোদীর সঙ্গে 'হাতে হাত' মিলিয়ে লড়তে রাজি পাকিস্তান

বলিহারি ঢং। একটা জুতসই সাবজেক্ট পেলেই হল। ম্যাটারে আদিখ্যেতার বন্যা। নদী উপচে, সাগর উপচে যে বান আসে, তেমনই বান। আদিখ্যেতার বান। আদিঅন্ত কিস্যু নাই। শুধু চ্যাংড়ামো আর ফাজলামো। সেখানেই সব বিদঘুটে পাজি হতচ্ছাড়ারা কুম্ভকর্ণের ঘুম নিয়ে ধ্যাস্টাতে ধ্যাস্টাতে টঙে তুলেছে আঁতলামো। ব্যাটা কুম্ভকর্ণ কোন ছুন্দরীর স্বপ্ন দেখছিল কে জানে। তাকে নাকি ফ্লাইং কিস্সিও দিচ্ছিল। কেন রে বাপু, রাক্ষস বলে কি পেরেম করতেও নেই। তা, সেই স্বপ্ন-পেরেমে নাকি অ্যামন চাটা চেটেছিল ইন্দ্র, কুম্ভকর্ণের ঘুম নাকি ছমাস আগে ভাঙতই না। হেব্বি বীর ছিল সে। রাম-রাবণের যুদ্দে নাকি বেজায় বেগ দিয়েছিল দেবতাদের। পাজি হতচ্ছাড়ার মজা দেকাচ্চি বলে নাকি ভেংচি কেটেছিল লক্ষ্মণ। দেবতাকুলের মাতব্বর ইন্দ্র নাকি প্রবল ঈর্ষায় জ্বলেপুড়ে একসা হয়েছিল।

কুম্ভকর্ণের দৈত্যের মতো শক্তি। আর ইন্দ্রের টিংটিঙে শরীর। পাঞ্জায় কী আর এঁটে ওঠা চাড্ডিখানি কথা, বস। ব্যস, অমনি প্যাঁচ কষা স্টার্ট। দেবী সরস্বতীর কাছে হত্তে দিয়ে পড়ল ইন্দ্র। বিদ্যের দেবী সরস্বতীও কুম্ভকর্ণের জিভে এমন মোক্ষম ঠোকা ঠুকল যে, আলটাকরা, দাঁত, মাড়ি সবখানে জিভ আটকে একসা। কথা বলতে গেলেই তোতলানো শুরু। “ই’’-কে বলে “নি’’। দেবতাকুলের তো পোয়া সাড়ে বারো। প্রজাপতি ব্রহ্মাকে তুষ্ট করে কুম্ভকর্ণ যখন ইন্দ্রাসন বর চায়, ব্রহ্মা সেটাকে নিদ্রাসন ভেবে বসেন। তারপর থেকে কুম্ভকর্ণ টানা ছমাস ঘুমিয়ে থাকত। অল্প সময়ের জন্য ঘুম ভাঙত। তারপর আবার নিদ্রাদেবীর কোলে সটান শয়ন।

এমন বিশাল এক বীর, জীবনভর কাটিয়ে দিল ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে। ভাবা যায়! রামায়ণে নাকি লেকা আছে, রামের সঙ্গে রাবণের কুলিয়ে উঠতে না পারার অন্যতম কারণ কুম্ভকর্ণের ওই দুদ্দাড় ঘুম। কালের পরিক্রমায় বাংলা বাগধারাতেও ঢুকে পড়ে ওই ঘুম। কারও ঘুম ভাঙতে দেরি হলেই বলি, কুম্ভকর্ণের ঘুম। ব্যাটা রাবণের ভাই শুধু ঘুমিয়েই বিখ্যাত হয়ে গেল মাইরি। এ কালের বহু রাবণ আড়ালে-আবডালে অনেক আঁতেলামো মার্কা বুলি কপচায়, কী দারুণ পরিহাস। এমনতরো অজেয় বীর বাগধারায় পরিহাসের পাত্র হয়ে কাটিয়ে দিল আজন্মকাল।

কুম্ভকর্ণের ঘুম নিয়ে সামাজিক মাধ্যেমে যতই অসামাজিক আলোচনা তেড়েফুঁড়ে উঠুক, ঘুমের প্রয়োজন নিয়ে কিন্তু বিস্তর খিল্লি সোশ্যাল মিডিয়ার দেওয়ালে দেওয়ালে। পেঁচিয়ে পাঁচতারা করে কুম্ভকর্ণের ঘুমের যদি ব্যাখ্যা-বুলি আর ইংলিশ ঝাড়া যায়, তাহলে দাঁড়ায় সাউন্ড স্লিপ। এমন ঘুম, যার বিরতি নেই। গভীর ঘুম। প্রশান্তির ঘুম। দেহ-মন ঝরঝরে করে দেওয়া ঘুম। নিরবচ্ছিন্ন ঘুম। না-হলে দেহ-মনের ঘ্যাঁচাং ফু। আর এই ব্যাপারটাকে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিতে প্রতি বছর ১৩ মার্চ পালন করা হয় বিশ্ব ঘুম দিবস। বসন্তের যে সময়ে দিন-রাত সমান হয়ে যায়, তার ঠিক আগের শুক্কুরবার এই দিনটার জন্য নির্ধারিত। কী আদখেলেপনা রে বাবা। হাগ দে, জাপটে দে, কড়কে দে, কিস দে। এখন আবার ঘুম দে। মানে, এই দিনটা ঘুমোও আর বাকি ৩৬৪ দিন জেগে শত্তুরের শাপশাপান্ত করো।

তবে, তা যে হচ্চে, তা ভাবাটা স্রেফ কল্পনা-বিলাস। কারণ, ইশকুলেই শুনেছি পণ্ডিতমশাইয়ের নাসিকা গর্জন। এ কালের শিক্ষকরাও অবশ্য সময় পেলেই ঘুমিয়ে পড়েন ক্লাসরুমে। আমার প্রাইমারি স্কুলের বৃন্দাবন স্যরকেও নাক ডাকতে দেখেছি। তাতে অবশ্য বিদ্যা আহরণে খুব একটা ঝক্কি হয়নি। দুটো তেলমাখানো আস্ত বেত রাখা থাকত টেবিলে। ঘুমন্ত বৃন্দাবন স্যরের বদলে ওই দুখানা বেত্রশলাকা আমাদের পাহারায় রাখত।

আরও পড়ুন-রাজারহাটে তৈরি হচ্ছে ২টি সেন্টার, জেলায় জেলায় আইসোলেশন ওয়ার্ড : মুখ্যমন্ত্রী

এ দেশের প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকরা প্রজাতন্ত্রের গরিব কর্মচারী। লবণ আনতে পান্তা ফুরনোর দশা। ফলে, স্কুলে পাঠদানের বাইরেও রোজগারের ফন্দি-ফিকির করতে হয়। তার মধ্যে সকালের হালকর্ষণ থেকে শুরু করে রাতভর ধান মাড়াই পর্যন্ত রয়েছে। সুতরাং ক্লাসরুমে তাঁদের একটু আধটু ঝিম ধরে যায়। কিন্তু দেশের কোনও কোনও জনপ্রতিনিধি যখন সংসদের কক্ষদ্বয়ে ঘুমিয়ে পড়েন এবং সশব্দ নাসিকা গর্জনে নিজেদের উপস্থিতির প্রমাণ দেন, তখন একটু নড়ে বসতে হয় বইকি!

আমরা নড়ে বসি। আমাদের দৌড় ওই ওইটুকুই। আমরা শুধু ভাবতে পারি, আহা, রাজনীতিক! আহা আমাদের অভিভাবক, দেশের মাঝিমাল্লা। দেশের কথা, জনগণের কথা ভাবতে ভাবতে বেচারারা শুদ্ধ ঘুমের সময়টুকু পান না। জনসমক্ষে ঝিমিয়ে পড়েন। এ দেশের নাগরিক হিসেবে আমরা কতই না ভাগ্যবান।

হে বীরপুঙ্গব, এ কালের কুম্ভকর্ণসকল, তাকান, জেগে উঠুন, কৃপাদৃষ্টি দিন। গনগনে আগুনেমার্কা ইস্যুগুলো ঝালিয়ে নিন। শুধু বাক্সপ্যাঁটরাভর্কি ভোট পেলেই তো হবে না। বিধায়ক, সাংসদ, মন্ত্রীফন্ত্রী হলেই তো হবে না। আমাদের দুঃখুদুদ্দশার করুণ কাহিনি তো আপনাদেরই শুনতে হবে। ইচ্ছে না থাকলেও শোনাবই। আমি কৃষক, আমি কুলি, আমি শ্রমিক, আমি মুচি, আমি মেথর, আমাদের নিশ্চিত ঘুমের দায়িত্ব তো আপনাদেরই নিতে হবে। দরকারে আপনাদের ঘুম কমান। আমরা ঘুমোচ্চি কি না, খোঁজ নিন। অনেক হয়েছে ঘুম, এবার জাগুন। না হলে পরের ভোটে লে ছক্কা!

বি. দ্র : কুম্ভকর্ণ সংক্রান্ত অংশ নেহাতই কল্পনা-বিলাস, হাস্যরসের জন্য বানানে কিছু রদবদল তাই ইচ্ছাকৃত

.