অন্য পুজো
অন্য পুজো
সুচিক্কণ দাস
সপ্তমী। বেলা দেড়টা। রোদ, গুমোট। দূরে প্যান্ডেল থেকে ভেসে আসছে ঢাকের শব্দ। শান্তিনিকেতেনের সামনে দিয়ে চলে যাওয়া কালো পিচঢালা রাস্তার ভিড় কিছুটা হাল্কা। ফিরতে হবে লজে। গাড়িতে উঠতে গিয়ে নজর পড়ল উল্টোদিকের গাছতলায়। পথের ধূলোয় শুকনো মুখে বসে এক কিশোর। সামনে কি একটা পসরা। এগিয়ে গিয়ে দেখি, পসরা বলতে গোটা দশেক কয়েত বেল। মুখ দেখে মনে হল সকাল থেকে খাওয়া জোটেনি। এমুখ একবার দেখলে কী যেন এক অস্থিরতা পেয়ে বসে। বারো বছরের কিশোরের পরনে বহুদিনের বিবর্ণ জামা, প্যান্ট। মনেও নেই পুজোর দিনের কোনও হিল্লোল। মহাসপ্তমী ওকে ছুঁতে পারেনি। বাড়ি নানুরে। বাবা অসুস্থ। নগদ কিছু টাকার খুব দরকার। তাই সকাল সকাল গাছ থেকে কয়েত বেলগুলো গাছ থেকে পেড়ে এসে বসে পড়েছে বোলপুরে। সকাল থেকে বেলা দেড়টা, এখনও পর্যন্ত বিক্রি মাত্র দুটো। মিলেছে কুড়ি টাকা।
.....কতক্ষণ থাকবি?
....জানি না, বিকেল পর্যন্ত তো বটেই।
রিন রিন করে বেজে ওঠে মিহি সুরের গলাটা।
.....খাওয়া-দাওয়া?
....সেসব বাড়ি ফিরে...
....নতুন জামা পড়ে ঠাকুর দেখা?
উত্তরে ঝরে পড়ল শুধু ম্লান হাসি।
দরকার নেই। তবু তিনটে কয়েত বেল কিনলাম। আশ্চর্য ক্ষিপ্রতায় কয়েত বেল ফুটো করে তার মধ্যে লঙ্কার গুঁড়ো ভরে তৈরি করে দিল স্বাদু কয়েত বেলের আচার। আমাকে দেখে দাঁড়িয়ে গেলেন এক সাইকেল আরোহী। আরও একটা দশ টাকা। গোটা পঞ্চাশ টাকা হল। আরও পাঁচটা কয়েতবেল পড়ে। এখনও এই পথের ধারে শুকনো মুখে বসে থাকতে হবে এই কিশোরকে। হয়ত সন্ধে নামা পর্যন্ত।
রাস্তা পেরিয়ে গাড়িতে উঠলাম। গাড়ির চাকার ধূলোয় কিছুটা ঝাপসা হয়ে গেল পিছনের রাস্তাটা। আমার জন্য ভুরিভোজের ব্যবস্থা লজে। আর এখানে ম্লানমুখে বসে অভুক্ত এক কিশোর।
অনেক দিন আগে পুজোর দিনে এমন দৃশ্য দেখেছিলাম হুগলির খানাকুলে।
এত বছর পর ফের দেখলাম সেই ছবি।
তখন আমার বয়স ছিল বাইশ। আজ আমি ষাট ছুঁই ছুঁই।
একদা সুবুদ্ধির উদয় হলে আমরা গ্রাম থেকে শহরে ফিরে যাই সেই পরিচিত জগতের নিশ্চিন্ত আশ্রয়ে। আর বাংলার গ্রামের কিশোর পুজোর দিনে বসে থাকে ধুলোমাখা রাস্তার ধারে।
কিছুই কি বদলায়নি? কিছুই কি বদলায় না?