Netaji Subhash Chandra Bose: কলকাতা টু কোহিমার দীপ্তিমান পথরেখাকে প্রণাম

সৌমিত্র সেন

Updated By: Jan 23, 2021, 10:44 PM IST
Netaji Subhash Chandra Bose: কলকাতা টু কোহিমার দীপ্তিমান পথরেখাকে প্রণাম

সৌমিত্র সেন

সুভাষচন্দ্রের সমস্ত দেশ-ভাবনা মেনে নেওয়া তাঁর অতি বড় ভক্তের পক্ষেও হয়তো কঠিন হত। 

সুভাষচন্দ্র (Netaji Subhash Chandra Bose) নিয়ে বাঙালির দ্বিধা-দ্বন্দ্বের অন্ত নেই। তিনি বীর দেশনায়ক, তিনি অন্যতম শ্রেষ্ঠ স্বাধীনতাসংগ্রামী, আবার তিনি গান্ধীবিরোধী, তিনি যুদ্ধকামী, তিনি জাতীয়তাবাদী। কোন 'সুভাষ' বাঙালির দৈনন্দিনের ক্ষেত্রে নিরাপদ এবং স্মরণীয় তা নিয়ে প্রবল বৈচিত্ত্য বাঙালিচিত্তে। এক শ্রেণির বাঙালি বলেন, নেতাজি শুধু যুদ্ধ-যুদ্ধ করে গেলেন, দেশ ও জাতিগঠনে মনে রাখার মতো কোনও দিশা দিলেন না। আবার তাঁর জরুরি লেখাপত্র খুঁটিয়ে পড়ে এর বিপরীত কথাই বলে থাকেন অন্য পক্ষ। সুভাষকে 'নেতাজি' বলা নিয়েও দ্বিমত তৈরি হয়েছে বাঙালির সুশীলসমাজে। 

সুভাষচন্দ্র বসুর জন্মশতবর্ষে নীরদচন্দ্র চৌধুরী একটি লেখা লিখেছিলেন--'সুভাষচন্দ্র বসু (Netaji Subhash Chandra Bose) ছয়জন শ্রেষ্ঠ বাঙালির একজন'। সেখানে তিনি জানান, এই মূল্যায়ন 'বাঙালিত্বে'র স্কেলে। বলেছিলেন, জাতীয়তাবোধ ও ঐতিহাসিক সত্যের প্রতি নিষ্ঠা এই দুইয়ের মধ্যে সংঘাত ঘটলে তিনি সব সময়েই ঐতিহাসিক সত্যের পক্ষপাতী। সুভাষ-বিষয়েও তিনি ঐতিহাসিক সত্যপন্থী। 

সুভাষের (Netaji Subhash Chandra Bose) ক্ষেত্রে কী সেই 'ঐতিহাসিক সত্য'? নীরদচন্দ্র লিখছেন, তা হল 'নিজের বিশ্বাসের জন্য প্রাণ বিসর্জন করা'। বলছেন, 'আমি হিন্দুর ইতিহাস যতটুকু জানি তাহা হইতে দেখিয়াছি, কোনও হিন্দু কখনও নিজের বিশ্বাসের জন্য প্রাণ বিসর্জন করে নাই।' এই আলোচনাতেই সুভাষকে বাঙালির 'নেতাজি' বলাটার ঘোরতর সমালোচনা করেন নীরদচন্দ্র। তিনি বলেন, এই 'কয়েনেজ'টার কোনও অর্থই হয় না।

এবার এখান থেকে আমরা সুভাষ-জীবনের দিকে একটু তাকাব। এক্ষেত্রে তাঁর ভারতের স্বাধীনতাসংগ্রাম-পর্বই আলোচ্য। সেখানে একটা বড় সময় আবার গান্ধীর সঙ্গে সংঘাতের উপাখ্যান। কংগ্রেসে একটা সময়ে সুভাষের দিকে বামপন্থী সমর্থন বাড়ছিল। এতে কংগ্রেস শঙ্কিত হয়ে পড়ছিল। দেশের তরুণ জনগোষ্ঠীর কাছে সমাদৃত জনপ্রিয় সুভাষ ত্রিপুরী কংগ্রেসে সভাপতিপদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চাইলে বেঁকে বসেন গান্ধী। কংগ্রেসের মূল অংশটা সেসময় সুভাষের প্রতি বিরক্তই হয়। দেশে এবং কংগ্রেসে গান্ধী-রাজকে নীরবে নস্যাৎ করে সুভাষ তো বলেওছিলেন সে সময়ে-- দক্ষিণ ও  বামপন্থীদের ঐক্য একমাত্র আনতে পারেন তিনি নিজে এবং নেহরু। 

এই কথাটা স্বাভাবিক ভাবেই সেসময়ে আগুনে ঘৃতাহুতি দিয়েছিল। গান্ধী অপমানিত বোধ করেন। তিনি পট্টভি সীতারামাইয়াকে তাঁর প্রার্থী হিসেবে সুভাষের (Netaji Subhash Chandra Bose) বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে দেন। যদিও সুভাষের জয়ের পরে গান্ধী লেখেন-- 'after all, subhasbabu is not an enemy of his country', তবে এ-ও লিখতে ভোলেন না 'the minority can only wish it all success'। ফলে গান্ধী-সুভাষ বিচ্ছেদের পরিস্থিতি আরও জোরালো হল। 

কিন্তু কোনও অবস্থাতেই যে গান্ধীর সঙ্গে বিচ্ছিন্নতা ঠিক হবে না, সুভাষকে তা অনেকেই মনে করিয়ে দিলেন। নেহরু তো বললেনই।  এমনকি রাজনীতির বাইরের মানুষ সুভাষের অভিন্নহৃদয় বন্ধু দিলীপকুমার রায়ও বিষয়টিকে ভাল ভাবে নেননি। সুভাষকে নেহরুর বোঝানোর প্রসঙ্গ টেনে দিলীপকুমার বন্ধুকে লেখেন, 'Nehru was surely right when he wrote to you that you hardly needed to cling to the president's chair in order to make your great influence felt in the country'। নিজের গৌরবান্বিত বন্ধু সম্পর্কে খুবই গুরুতর অভিযোগ তুলেছেন দিলীপ। সুভাষ যেন যেনতেনপ্রকারেণ দেশের মানুষকে বোঝাতে চাইছিলেন যে, তিনি সারা দেশে কতটা জনপ্রিয়!

আরও পড়ুন- পরাক্রম দিবস হল, ২৩ জানুয়ারি 'জাতীয় ছুটি' ঘোষণা করলেন না PM Modi

এখানে সুভাষ হয়তো একটু অনর্থক ভাবে নিজের সিদ্ধান্তেই অটল রইলেন। ভোটে দাঁড়ানোর সময় থেকেই তো গান্ধীর সঙ্গে মনোমালিন্য, কিন্তু জেতার পরে সুভাষ সৌজন্য দেখিয়ে সেটা মিটিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলেন না। ওয়ার্কিং কমিটির গঠন নিয়েও গান্ধীর কোনও পরামর্শ চাইলেন না। 

আবার এ-ও ঠিক, গান্ধীও তাঁর অবস্থান থেকে সরেননি। এগিয়ে আসেননি সুভাষের দিকে। গান্ধীও হয়তো একটু নরম হতে পারতেন।

এদিকে, একদিকে নিজের অম্লান ক্যারিশমা আর একদিকে বামপন্থীদের গাঢ় সমর্থন-- এই দু'টির উপর নির্ভর করতে গিয়ে সুভাষ ক্রমশ নিজের বিপদ বাড়ালেন। নানা দিক থেকেই ক্রমশ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লেন। গান্ধীর সঙ্গে দূরত্বও আরও বাড়ল। দেশের ভাগ্য এই দুই মহান নেতার ব্যক্তিগত টানাপড়েনের জেরে অনুজ্জ্বলই হয়ে রইল। 

আরও পড়ুন- CM Mamata-কে পাশে বসিয়ে BJP-র ভোট-স্লোগান 'সোনার বাংলা' শোনালেন PM Modi

আর কংগ্রেসে ক্রমশ কোনঠাসা বিরক্ত সুভাষ ধীরে ধীরে দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রত্যক্ষ সুর থেকে যেন দূরে সরে যেতে থাকলেন। খুলে নিতে চাইলেন নিজের জন্য অন্য দিগন্ত। ঠিক এই সময়-পর্বের মূল্যায়ন-প্রসঙ্গেই গান্ধী-সুভাষ বিরোধ নিয়ে বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ অমলেশ ত্রিপাঠী লিখছেন, 'একদিক দিয়ে তাঁরা (কংগ্রেস নেতারা) সুভাষের উপকারই করলেন। যিনি ছিলেন নেতা, তিনি হলেন নেতাজি। এবার আর হলওয়েল মনুমেন্ট নিয়ে ঘোলাজলের রাজনীতি নয়। কলকাতা থেকে কাবুল, কাবুল থেকে বার্লিন, বার্লিন থেকে সিঙ্গাপুর, সিঙ্গাপুর থেকে কোহিমা-- দুর্গম তাঁর চরণচিহ্ন সগৌরবে ধারণ করল।' 

অর্থাৎ, সুভাষের 'নেতাজিত্ব'কেই ব্যাখ্যা ও প্রশংসা করলেন ইতিহাসবিদ। কিন্তু মজার কথা, যে-নেতাজিত্ব অর্জনের প্রশংসায় মুখর অমলেশ, ঠিক সেই-নেতাজিত্বকেই নস্যাৎ করেছেন নীরদচন্দ্র। এ লেখার শুরুতেই সে প্রসঙ্গ আছে। 

আসলে এই দুই মননশীল বাঙালি দুই ভিন্ন যুগের প্রতিনিধি। তাঁদের সুভাষ-মূল্যায়নও তাই আলাদা। এবং বৃহত্তর বাঙালিও এই বিভাজনের শিকার। 

কিন্তু এই সব মত ও পার্থক্য সরিয়ে দিয়ে আজ অনেকটা দূর থেকে সুভাষচন্দ্রকে দেখলে ঠিক কী দেখি আমরা? হ্যাঁ, সব মনীষীর মতোই সুভাষের মধ্যেও চিন্তার বৈপরীত্য ছিল বইকী। একসময় তিনি খুব বিপজ্জনক এক মিশ্রণে বিশ্বাসী হয়ে পড়েছিলেন; মেলাতে চেয়েছিলেন কমিউনিজম ও ফ্যাসিজমকে। আবার কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট রূপে তিনি সমাজতন্ত্র ও ন্যাশনাল প্ল্যানিংয়ের কথা ভেবেছিলেন। কেন তিনি কমিউনিজম-ফ্যাসিজম মেলাতে চেয়েছিলেন? সুভাষের যুক্তি ছিল, ভারতীয় কমিউনিস্টরা ভারতীয় জাতীয়তাবাদকে অগ্রাধিকার দিতে তৈরি নয়, তাই তিনি এর সঙ্গে ফ্যাসিজম মিলিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। পরে তিনি মত বদলান। 

আবার ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী উদারনৈতিক রাষ্ট্রব্যবস্থার পরিবর্তে একটা শক্তিশালী সমাজতন্ত্রী রাষ্ট্রের প্রতিই তাঁর পক্ষপাতিত্ব বেশি ছিল। সুভাষ এমন এক 'সেন্ট্রালাইজড' ও 'অথরিটারিয়ান' রাষ্ট্রের পরিকল্পনা করেছিলেন যেখানে সেনাবাহিনীর এক বিশেষ ভূমিকা থাকবে। এ বিষয়ে কিন্তু সে সময়ে অনেক নেতারই আপত্তি ছিল। 

আজও আমরা কতজন ঠিক এইরকম একটা শাসনব্যবস্থাকে সানন্দে হৃষ্টচিত্তে মেনে নেব, সেটা ভেবে দেখার। 

তবে আজ, সব দ্বন্দ্ব-তর্ক সরিয়ে শুধুই শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের দিন। নেতাজির (Netaji Subhash Chandra Bose) ১২৫তম জন্মজয়ন্তীতে আমরা অবশ্যই তাঁকে প্রণাম জানাব। মৃত্যুহীন এই বীর তো আমাদের দেশকালসমাজের কঠিন নিগড়ের মধ্যে স্বপ্নসম্ভব এক শাশ্বত অস্তিত্ব। যিনি আমাদের মুক্তির সাধনায় জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। যিনি ব্যষ্টিকে ক্ষণে-ক্ষণে সমষ্টিতে মিলিয়ে দিয়ে উত্তরণ ঘটিয়েছেন আমাদের বেঁচে থাকার সামগ্রিক বোধে ও আদর্শে। তিনি অমর। তিনি প্রকৃত অর্থে 'নেতাজি' কিনা, বা তাঁর চিন্তা আজ কতটা প্রাসঙ্গিক, তার তুল্যমূল্য বিচার না করে আমরা বরং ওই কলকাতা টু কোহিমার দীপ্তিমান পথরেখার দিকে খানিক বিস্ময়বিমুগ্ধ ভাবে চেয়ে থাকি!

আরও পড়ুন- নেতাজির স্বপ্নের শক্তিশালী ভারত আজ দেখছে দুনিয়া, গর্ব করতেন উনি: PM Modi

.