আত্মবিস্মৃত বাঙালি এবং বঙ্গ-রাজনীতির সংস্কৃতিযুদ্ধ!
আত্মবিস্মৃত বঙ্গরাজনীতির ফাঁক দিয়েই কি ঢুকে পড়তে চাইছে সর্বভারতীয় রাজনীতি!
নিজস্ব প্রতিবেদন: রাজনীতির ভরা আসরে এখন বাঙালি-সংস্কৃতি নিয়ে তীব্র টানাপড়েন। রাজনীতির আকাশ জুড়ে যেন শুধুই বেজে চলেছে, বঙ্গসংস্কৃতি তুমি কার--বিজেপি'র না তৃণমূলে'র?
নিশ্চয়ই বঙ্গসংস্কৃতি আছে বঙ্গসংস্কৃতিতেই। রাজনীতির নিজের জিনিস তা নয়। কিন্তু তার অস্তিত্ব ইদানীং যেন কিছু নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে সক্রিয় অংশগ্রহণ বা সাংস্কৃতিক বিষয়ে করা মন্তব্যের উপরই নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে।
হয়তো, সেটাও পড়ত না, যদি না, সংস্কৃতির খুঁটিনাটিকে মনে রাখা, তার ঘনিষ্ঠ চর্চার সূত্রে বাঙালির 'বাঙালিত্ব'ই নতুন করে অস্বস্তিকর প্রশ্নের মুখে পড়ত! কী ভাবে, তার সূত্রপাতটাই আসলে রাজনৈতিক।
সম্প্রতি রবীন্দ্রনাথের জন্মস্থান নিয়ে ভুল বলেছে বিজেপি। জোড়াসাঁকোর পরিবর্তে বলেছে শান্তিনিকেতনের কথা। এর তীব্র প্রতিবাদ করেছে তৃণমূল। আজ, রবিবার বোলপুরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর আগমনের আগে এই উপলক্ষে একটি পোস্টার তৈরি হয়েছিল। সেখানে দেখা গিয়েছিল, অমিত শাহের পোস্টারে রবীন্দ্রনাথের ওপরে অমিত শাহের ছবি! এ নিয়েও আপত্তি জানিয়েছে তৃণমূল। আজ জোড়াসাঁকোয় এ নিয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছে তৃণমূলের ছাত্রশাখা। এবং এই সমস্ত আপত্তিই আসলে সংস্কৃতির মোড়কে। তৃণমূল বলছে, বিজেপি বাংলাকে চেনে না, বাঙালিকে চেনে না, রবীন্দ্রনাথকে না জেনেই বাংলা দখলের চেষ্টায় নেমে পড়েছে তারা।
বিজেপি এসব বিতর্কের কখনও সরাসরি উত্তর দিয়েছে, কখনও দেয়নি। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, সম্ভবত তারাও নিজেদের মতো একটা প্রক্রিয়া তৈরি করে নিয়েছে। তা আর কিছু নয়, বারবার বাঙালি সংস্কৃতিকেই আঁকড়ে ধরা। নিজেদের কথাবার্তায় বাঙালি সংস্কৃতির, বাঙালি মনীষীর কথা উল্লেখ করা। এটা করতে গিয়ে বিজেপি প্রাথমিক ভাবে বঙ্কিম, বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথকে বেছে নিয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী তাঁর কথায় একাধিকবার রবীন্দ্রনাথের কবিতা উল্লেখ করেছেন।
কিন্তু ইদানীং বিজেপি শুধু এই ত্রয়ীর মধ্যেই আবদ্ধ থাকেনি। তারা ইদানীং খুঁজে খুঁজে এমন ব্যক্তিত্বকে নিয়ে এখন কথা বলছে, যাঁরা এখন আর বাঙালির চর্চায় খুব একটা নেই। যেমন কলকাতার ইজেডসিসি'তে আয়োজিত এক ভিডিয়ো কনফারেন্সে মোদী তাঁর বক্তব্যে মনমোহন বসুর কবিতার কথা বলেছিলেন। কে এই মনমোহন? সাড়া পড়ে গিয়েছিল। মোদী শ্রীঅরবিন্দ ও ক্ষুদিরামের কথা বলেছিলেন।
বিজেপির আর একটা তাত্ত্বিক অবলম্বন স্বয়ং শ্যামাপ্রসাদ। তিনি বাঙালি। অতএব বিজেপি বলতে চেয়েছে, বিজেপির সঙ্গে বাঙালির যোগ নেই, এই কথা কেন বারবার উঠছে? কেন বিরোধীদল বারবার এই কথা তুলছে? বিজেপি যেন তৃণমূলকে বলতে চায়, তুমি যে সংস্কৃতির দোহাই দিয়ে বারবার আমাকে আক্রমণ করছ, তুমি নিজেও কি তোমার একান্ত নিজস্ব সেই সংস্কৃতিকে খুঁটিয়ে জানো?
এ কথা সত্যি যে, হিন্দুমেলার সমর্থক মনমোহন বসু কে জানতে গিয়ে রীতিমতো চুল ছিঁড়তে হয়েছিল বাঙালিকে, বঙ্গরাজনীতিকেও। খুব বিখ্যাত কবি নন। কিন্তু স্বাদেশিকতার ভাবনাপ্রধান মনমোহনের ওই রচনা সেই সময়ে যথেষ্ট আলোচিত ছিল। শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় এবং অরুণকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের সংকলিত-সম্পাদিত 'উনবিংশ শতকের গীতিকবিতা সংকলন'-এ প্রকাশিত 'দিনের দিন্ সবে দীন' কবিতার অংশ উচ্চারণ করেছিলেন মোদী। বিদেশি দ্রব্য বর্জনের সপক্ষে সওয়াল করতে গিয়ে "ছুঁই সূতো পর্যন্ত আসে তুঙ্গ হ'তে, দীয়াশলাই কাটি, তাও আসে পোতে/ প্রদীপটি জ্বালিতে, খেতে, শুতে, যেতে, কিছুতেই লোক নয় স্বাধীন!' ছত্রগুলি লিখেছিলেন কবি, সাংবাদিক, নাট্যকার, গীতিকার মনমোহন বসু।
কিন্তু সংস্কৃতির দোহাই দিতে গিয়ে কেন এ রাজ্যের রাজনীতির বারবার নিজের সাংস্কৃতিক অভিজ্ঞানগুলিকেই চিনে নিতে ভুল হয়? এর শিকড় আসলে অনেক গভীরে।
সেই কতদিন আগে বাঙালির নিজস্ব ইতিহাস নেই বলে দুঃখ করেছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী বাঙালিকে আত্মবিস্মৃত জাতি বলেও উল্লেখ করেছিলেন। তাঁরা জানতেন, বাঙালির অতীত আছে, ইতিহাস নেই। বঙ্কিমচন্দ্র এবং হরপ্রসাদ দু'জনেই বাঙালির আত্মপরিচয়ের বিস্তার এবং তার বিশ্বজনীনতা চাইতেন।
সেই দায়িত্ব কি গ্রহণ করতে পেরেছে বঙ্গরাজনীতি?
ঠিক এই খামতিগুলিকেই চিহ্নিত করে এবং তার মধ্যে দিয়েই সম্ভবত বাঙালির মধ্যে ঢুকে পড়তে চাইছে বিজেপি।
also read: এটা ট্র্যাডিশন ছিল না; কিন্তু অশিষ্ট কোন্দলই এখন বাংলার রাজনৈতিক বিতণ্ডার ট্যাগমার্ক