শুধু শরীরে নয়, আঘাত লাগে আত্মসম্মানে
হাসপাতালের কেবিনে একলা যন্ত্রণাবিদ্ধ ২৪ ঘণ্টার সাংবাদিক অঞ্জন রায়। সেদিন ঠিক কী ঘটেছিল? কলম ধরলেন সাংবাদিক।
অঞ্জন রায়
রাত ১১টা। ২১ নম্বর কেবিন। উডবার্ন ওয়ার্ড। কলকাতার পিজি হাসপাতাল। এক বিশাল ঘরে শুয়ে আছি আমি। ঘুম আসছে না। ঘরের বাইরে ৪ জন পুলিসকর্মী। ঘরের মধ্যে একজন হাসপাতালের কর্মী। ভাবছিলাম, কীসের জন্য এত আয়োজন?
১৪ ফেব্রুয়ারি ভালবাসার দিন। কিন্তু, এ কেমন ভালবাসা পেলাম? ধর্মের মোহে আচ্ছন্ন হিন্দু সংহতির কয়েকজন কর্মীর হাতে নিগৃহীত হয়ে ফাটল মাথা। রক্ত ঝরল। চশমা গুঁড়িয়ে দিল ওরা। অনেক চেষ্টায় দামি ক্যামেরাটা বাঁচাতে পেরেছি। আক্রান্ত আমার ক্যামেরাম্যান কমল জানা। আহত আরও বেশ কিছু সংবাদমাধ্যমের কর্মী। কিন্তু হিন্দু সংহতির আমন্ত্রণেই ওদের সভায় সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়েছিলাম। কিন্তু, এ কেমন ঔদ্ধত্য! এ কেমন ব্যবহার!
হয়তো হিন্দু সংহতির এই সভা খুব বড় খবর হত না। বড়জোর গুজরাট, উত্তরপ্রদেশের পর এই ধর্মনিরপেক্ষ কলকাতা শহরে প্রকাশ্যে ধর্মান্তরণের ঘটনা সংবাদমাধ্যমে একটা জায়গা করে নিত। তবে কি সাংবাদিক পিটিয়ে বড় খবর করার জন্যই এই ঘটনা ঘটানো হল? এটাই কি এখন এই সব উগ্র ধর্মীয় সংগঠনগুলির নতুন 'ট্রেন্ড'।
মঞ্চে থাকা তথাকথিত 'ধর্মান্তরিত' পরিবারের কাছে একটা কথাই জানতে গিয়েছিল সব সংবাদমাধ্যম। প্রশ্ন ছিল, এই ধর্মান্তরণ কি স্বেচ্ছায়? তাতেই এত আক্রমণাত্মক হলেন কেন হিন্দু সংহতির সদস্যরা? তবে কি অন্য কোনও নির্দেশ ছিল? কীসের এত রাগ? নাকি সবাই চায়, সংবাদমাধ্যম চলবে তাদের কথায়। সঠিক খবর নয়, মিথ্যার ফুলঝরি আর স্তুতি দিয়ে ভরিয়ে দেবে তারা। তা না হলেই মারো, মারো... সাংবাদিক পেটাও।
পেশার তাগিদে সাংবাদিকরা সংবাদ সংগ্রহে যান। খবর হতে নয়। এটাই আমাদের পেশার বৈশিষ্ট্য। একজন সাংবাদিক খবর করতে গিয়ে মার খেলে শুধু তাঁর শরীরে নয়, আত্মসম্মানেও আঘাত লাগে। মনে হয়, নিজের খবরটা নিজে লিখতে পারলাম না। হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে আমারও বারবার মনে হচ্ছিল সেকথাই।
ঘটনা ঘটার পর পুলিস, ডাক্তার, মন্ত্রী, এমনকি শত ব্যস্ততার মধ্যে স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীও ফোন করে খোঁজ নেওয়া শুরু করেন। ফোন করলেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা। একজন সাংবাদিকের কাছে এটা নিশ্চয়ই বড় পাওনা। কিন্তু যে যন্ত্রণা সাংবাদিককে আহত করল, এত বড় ঘটনার কপি ডেস্কে দিতে পারলাম না সেদিন। কেন? কার জন্য?
হঠাত্ দরজায় আওয়াজ। নার্স এসে বললেন,'এখনও ঘুম আসছে না। ঘুমান। মাথার ব্যাথাটা তা না হলে কমবে না।' ওষুধও দিলেন। কিন্তু সাংবাদিকের আত্মসম্মানের ব্যাথা কমবে কীভাবে? কপি লিখতে না পারার যন্ত্রণা কে কমাবে? এর তো কোনও ওষুধ নেই!
হয়তো ভবিষ্যতই এর উত্তর দেবে।