করোনা-মোকাবিলায় বাবা-মায়েদের আরও দায়ীত্বশীল হতে হবে
আসুন জেনে নেওযা াক এ বিষয়ে কী বলছেন মনরোগ বিশেষজ্ঞ ডঃ রিমা মুখোপাধ্যায়...
সুদীপ দে: গত মাসে যখন চিনের ইউহান থেকে ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ছে করোনাভাইরাস, তখন একটা ভিডিয়ো সোশ্যাল মিডিয়ায় খুব ভাইরাল হয়েছিল। মা চিনের একটি হাসপাতালের নার্স। করোনাভাইরাস আক্রান্তে তখন হাসপাতালে তিল ধারণের জায়গা নেই। তাই দিনের পর দিন বাড়ি ফিরছে না মা। একরত্তি শিশু তাই খাবার নিয়ে হাসপাতালে পৌঁছে গিয়েছে মায়ের সঙ্গে দেখা করতে। মা কিন্তু সন্তানের কাছেও এল না। দূর থেকেই তাকে জড়িয়ে ধরার ভঙ্গিতে দুহাত মেলে দাঁড়ালেন। শিশুটিও তাই করল। অঝোরে কাঁদতে কাঁদতে সে তার মাকে জানাল, ‘মা তোমায় খুব মিস করি!’ এর উত্তরে মা বলল, ‘আমি রাক্ষসের সঙ্গে লড়াই করছি। ভাইরাসকে হারিয়ে দিয়েই আমি বাড়ি ফিরে আসবো।’ সে-ও তখন কাঁদছে। কিন্তু কোনও ভাবেই তবু সন্তানের কাছে যাওয়া যাবে না। তাই দূরে সন্তানের রেখে যাওয়া টিফিন বক্স হাত বাড়িয়ে তুলে নিয়ে ফের হাসপাতালে চলে গেল সে।
চিনে এখন অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে করোনাভাইরাস। কিন্তু ভারতে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে আক্রান্তের সংখ্যা। কলকাতায় আপাতত এই ভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা মাত্র ১। কিন্তু আক্রান্ত ও তাঁর পরিবারের গাফিলতি আর দায়িত্বজ্ঞানহীনতায় শহরে আকঙ্ক ছড়িয়েছে বহুগুণ। আক্রান্তের মা সরকারি আমলা, বাবা চিকিত্সক। কিন্তু তা সত্ত্বেও এম আর বাঙ্গুর হাসপাতালের চিকিৎসকদের পরামর্শ মেনে বেলেঘাটা আইডি-তে না গিয়ে সোজা বাড়ি চলে যান কলকাতার প্রথম করোনা আক্রান্ত তরুণ।
বেলেঘাটা আইডির তরফেও স্বাস্থ্য ভবন মারফত যোগাযোগ করা হয়েছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও ওই তরুণ নিজে বা তাঁকে নিয়ে তাঁর পরিবার বেলেঘাটা আইডিতে দেখাতে আসেননি বা ভর্তি করেননি বলে অভিযোগ। বর্তমানে ওই তরুণ বেলেঘাটা আইডি হাসপাতালে চিকিত্সাধীন। তাঁর সরকারি আমলা মা, চিকিত্সর বাবা আর গাড়ির চালককে রাজারহাটে কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয়েছে। এই আমলা ও তাঁর পরিবারের সামগ্রিক গাফিলতি আর দায়িত্বজ্ঞানহীনতায় বেজায় চটেছেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। করোনা আতঙ্কে নবান্নের পাশাপাশি রাইটার্সেও সিল করা হয়েছে ওই আমলার অফিস-ঘর। কিন্তু তাতেও কাটছে না আতঙ্কের রেশ।
কিন্তু কেন এমনটা করলেন ওই আমলা? ১৮ বছরের তরুণের পক্ষে হয়তো পরিস্থিতির ভয়াবহতা আন্দাজ করা কঠিন। কিন্তু তরুণের চিকিত্সক বাবা বা মা কেন প্রথম দিনেই স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য বেলেঘাটা আইডিতে পাঠালেন না! উত্তর খোঁজার চেষ্টা করল Zee ২৪ ঘণ্টা (ওয়েব) পথ দেখালেন মনরোগ বিশেষজ্ঞ ডঃ রিমা মুখোপাধ্যায়...
মনরোগ বিশেষজ্ঞ রিমা মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘এই ঘটনায় কোথাও হয়তো মাতৃত্বের কাছে হার মেনেছে সামাজিক কর্তব্যবোধ। হয়তো এই মা আইসোলেশনের থেকে ছেলেকে আগলে রাখতে চেয়েছেন। তাই সামাজিক দায়িত্ব এবং প্রশাসনিক কর্তব্য পালনে ব্যর্থ হয়েছেন ওই আমলা।’’
আরও পড়ুন: করোনা সারিয়ে বাড়ি ফিরেছেন ৮৩ হাজার মানুষ! উপযুক্ত সচেতনতায় চিকিৎসাতে মিলবে সাড়া
কিন্তু আক্রান্তের বাবা, ওই আমলার স্বামী তো চিকিত্সক! সেখানে এই পরিস্থিতিতে ওই তরুণের স্বাস্থ্য পরীক্ষায় গাফিলতি হল কী করে?
এ প্রসঙ্গে ডঃ মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘বর্তমানে প্রায় সব দম্পতির একটিই সন্তান। তাই একমাত্র সন্তানকে আঁকড়ে, আগলে রাখার প্রবনতা বাবা-মা উভয়ের মধ্যেই বেড়েছে। ফলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বাবা-মা সন্তানের অনেক বায়না, আবদার মেনে নিতে বাধ্য হন। এ ক্ষেত্রেও হয়তো সন্তানের আবদার মানতে গিয়েই এই বিপত্তি!’’
তাহলে এই পরিস্থিতির মোকাবিলায় বাবা-মায়েদের কী করণীয়?
ডঃ মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘করোনাভাইরাসের সংক্রমণের ফলে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে তাকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা WHO ‘মহামারির চেয়েও ভয়ঙ্কর’ বলে ব্যাখ্যা করেছে। এই পরিস্থিতির মোকাবিলায় বাবা-মায়েদের আরও কঠোর হওয়া জরুরি। বাবা-মায়ে দায়িত্ব পালনের চেয়েও তাঁদের সামাজিক দায়িত্ব, কর্তব্যের বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে। সন্তানের সুরক্ষার পাশাপাশি অগনিত মানুষের জীবনের ঝুঁকি যাতে না বাড়ে, সে বিষয়টিও গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করা উচিত। আমরা আমাদের সামাজিক দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন না হলে এই ভাইরাসের সংক্রমণ কিছুতেই ঠেকানো যাবে না।’’
কলকতার প্রথম করোনা-আক্রান্ত ও তাঁর পরিবারের গাফিলতির ঘটনা চিনের ওই ভিডিয়োটিকে আরও প্রাসঙ্গিক করে তুলল। চিনের ওই মায়ের মতো করে আমরাও যদি সকলে ভাবতে পারি, তাহলে হয়তো সচেতন ভাবে রুখে দেওয়া যাবে এই ভাইরাসের সংক্রমণ।