আর শোনা যাবে না বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বরে সেই চেনা প্রশ্ন, ‘ও গঙ্গা বইছো কেন?’
তাঁর নাম শুনলেই ক্যালকাটা ইয়ুথ কয়্যারের কথা মাথায় আসে।
সুদীপ দে: চলে গেলেন রুমা গুহ ঠাকুরতা। তিনি কালজয়ী সঙ্গীতশিল্পী কিশোর কুমারের প্রথম স্ত্রী। তবে তাঁর পরিচয় কিশোর কুমারের স্ত্রী হিসেবেই থেমে থাকেনি। ১৯৫১ সালে কিশোর কুমারের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। কিশোর কুমারের মতো তিনিও ছিলেন একাধারে অভিনেতা ও সঙ্গীতশিল্পী।
তাঁর নাম শুনলেই ক্যালকাটা ইয়ুথ কয়্যারের কথা মাথায় আসে। বাংলায় গণসঙ্গীত জনপ্রিয়তা লাভ করে ক্যালকাটা ইয়ুথ কয়্যারের হাত ধরেই। যে বছর কিশোর কুমারের সঙ্গে তাঁর বিবাহ বিচ্ছেদ হয়, সে বছরই ১৯৫৮ সালে সুরকার সলীল চৌধুরী ও চিত্র পরিচালক, সাহিত্যিক সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে একত্রে ক্যালকাটা ইয়ুথ কয়্যারের প্রতিষ্ঠা করেন রুমা। শিবদাস বন্দোপাধ্যায়ের লেখা ভি বালসরার সুরে ক্যালকাটা ইয়ুথ কয়্যারের ‘আজ যত যুদ্ধবাজ’ গানটি ব্যাপক জনপ্রিয় হয়। ১৯৭৪ সালে রুমা গুহ ঠাকুরতার পরিচালিত ২০ সদস্যের ক্যালকাটা ইয়ুথ কয়্যার কোপেনহেগেন ইউথ ফেস্টিভেল-এ সেখানকার হাজার হাজার শ্রোতা ও বিচারকদের মন জয় করে নেয়। জিতে নেয় প্রথম পুরস্কার।
বাংলা চলচ্চিত্রেও তাঁর অভিনয়ে মুগ্ধ হয়েছেন অসংখ্য দর্শক। ৮০তে আসিও না, অভিযান, গণশত্রুর মতো একাধিক জনপ্রিয় ছবিতে তাঁর অভিনয় বাঙালি দর্শকের মনে চিরস্থায়ী জায়গা করে নিয়েছে। সত্যজিৎ রায়, তপন সিংহ, তরুণ মজুমদারের মতো বাঘা বাঘা চিত্র পরিচালকদের থেকে অভিনয়ের জন্য প্রশংসাও কুড়িয়েছেন তিনি। দেবব্রত বিশ্বাসের ছাত্রী রুমা প্লে ব্যাক করেছেন একাধিক ছবিতে। ৮০তে আসিও না, বাঘিনী, অমৃত কুম্ভের সন্ধানে, পলাতক-এর মতো একাধিক ছবিতে প্লে ব্যাক করেছেন তিনি। শুধু বাংলাতেই নয়, আফসর, মশাল-এর মতো বেশ কয়েকটি হিন্দি ছবিতেও অভিনয়ের জন্য দর্শক, পরিচালক ও চিত্র সমালোচকদের থেকে যথেষ্ট প্রশংসাও কুড়িয়েছেন রুমা। তাঁর অভিনীত শেষ ছবি মীরা নায়ার পরিচালিত ‘দ্য নেমসেক’ মুক্তি পায় ২০০৬ সালে।
আরও পড়ুন: রুমা গুহ ঠাকুরতার জীবনাবসান
রুমার তিন সন্তান, তিন জনেই সঙ্গীতের জগতে প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিত্ব। তাঁর প্রথম সন্তান অমিত কুমার। ১৯৫৮ সালে কিশোরের সঙ্গে বিচ্ছেদের পর ১৯৬০ সালে রুমার বিয়ে হয় চিত্রনাট্যকার অরূপ গুহ ঠাকুরতার সঙ্গে। শ্রমণা চক্রবর্তী, অয়ন গুহ ঠাকুরতা রুমা এবং অরূপবাবুর সন্তান। তবে জীবনের বেশির ভাগ সময়টা অমিত কুমারের সঙ্গেই কাটিয়েছেন, তাঁর কাছেই থাকতেন। বার্ধক্যজনিত কারণে বিগত বেশ কয়েক বছর ধরেই সমস্ত রকম প্রচার মাধ্যমের থেকে অনেক দূরে, প্রায় সকলের চোখের আড়ালে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছিলেন রুমা। দীর্ঘদিন ধরেই ভুগছিলেন বার্ধক্যজনিত নানা সমস্যায়। অবশেষে থেমে গেল সব স্পন্দন। আর শোনা যাবে না বলিষ্ঠ কন্ঠস্বরে সেই চেনা সুরেলা প্রশ্ন, ‘ও গঙ্গা বইছো কেন?’ রুমা গুহ ঠাকুরতার মৃত্যুতে বাংলা সংস্কৃতি, সঙ্গীত ও চলচ্চিত্রের আকাশে এক অপূরণীয় শূন্যতার সৃষ্টি হল।