কাপুরুষ ব্রাত্যর অভিনয়টা বড় পাওনা
ছবির নাম: মহাপুরুষ ও কাপুরুষ রেটিং: ***1/2
শর্মিলা মাইতি
ছবির নাম: মহাপুরুষ ও কাপুরুষ
রেটিং: ***1/2
সত্যজিত্ রায়ের কাল্ট ছবি কাপুরুষ ও মহাপুরুষ-এর সঙ্গে সাদৃশ্য বা সাযুজ্য খুঁজতে গেলে প্রথমেই সাবধান। স্ট্রেস রিলিফ করতে এসে হতাশা নিয়ে ফিরতে পারেন। সম্ভবত, পরিচালকও কিংবদন্তি ফিল্মমেকারের সঙ্গে কোনও সম্মুখ সমরে যাননি। দেননি কোনও রিমেকের প্রতিশ্রুতিও। তবে পরশুরামের সেই বিখ্যাত উচ্চমাধ্যমিক-অন্তর্ভুক্ত গদ্যে তাঁর সবিশেষ অনুরাগ ধরা পড়েছে চরিত্রচিত্রণেই। শিক্ষামন্ত্রী অভিনেতা ব্রাত্য বসু দ্বৈত চরিত্রে অভিনয় করেছেন। বিরিঞ্চিবাবার আদলে তৈরি মডার্ন সাধুবাবা।
একটা কমেডি ছবি দেখার জন্য কী কী প্রত্যাশা নিয়ে যাবেন আপনারা? অল্প হাসি, মুচকি হাসি, অট্টহাসি, কাতুকুতু-হাসি, গুঁতো-মারা হাসি... রিয়্যালিটি শোয়ের দৌলতে এত পেট-সুড়সুড়ি হাসির হররা, যে লাফিং ক্লাবের মেম্বারশিপও কমতির দিকে। তবে কমেডি ছবি রিলিজ হলে এখনও দর্শক স্ট্রেসবাস্টার-এর বিকল্প হিসেবেই ব্যবহার করতে চায় ছবিটাকে। নির্ভেজাল হাসি হেসে হল থেকে বেরিয়ে আসা- এটুকুই আশা।
প্রোমো-লগ্নেই মহাপুরুষ ও কাপুরুষ ছবিটি হাসির প্রত্যাশার সঙ্গে আরও একটি ট্যাগ জু়ড়েছিল। ভণ্ড সাধুদের কীর্তিকলাপ চোখে আঙুল দিয়ে দেখানোর প্রক্রিয়া। পরিচালক অনিকেত চট্টোপাধ্যায় এই দ্বিতীয় বিষয়টির উপর একটু বেশিই জোর দিয়েছেন।
অত্যাশ্চর্য কিন্তু বহুল প্রচলিত কিছু ক্রিয়াকলাপ দিয়ে মানুষকে অপ্রতিভ করে তাদের বিশ্বাস আদায় করার চিরাচরিত ভন্ডামির ফর্মুলাটা এখানেও স্বমহিমায় বর্তমান। সময়ের তারতম্যে সেখানে শুধু এসেছে অত্যাধুনিক মোবাইলের ব্যবহার। তার স্যাঙাত্ (এই চরিত্রে অভিনয় করেছেন লামা) মোবাইলের মাধ্যমেই ইনফর্মেশন পাস করে। আর মহাপুরুষের কথার ঘায়ে ঘায়েল হন শহরের উচ্চবিত্ত ও উচ্চপ্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিবর্গ- মেয়র থেকে উঠতি নায়িকা, লেখক থেকে ব্যবসাদার, মধ্যবিত্ত থেকে হতদরিদ্র। যে-যে ধরনের হাসির কথা বললাম প্রথম প্যারাগ্রাফে, সারা ছবি সেই সব হাসির একটা অনসমবল কাস্ট বানাতে চেষ্টা করেছেন পরিচালক। কেতাবি ভাষায়, কমেডি বর্গের অ্যাবসার্ডিটি আর ননসেন্স এই দুধরনের হাস্যরসেই মন দিয়েছেন তিনি। কিন্তু শেষ দিকটা বড় তালগোল পাকিয়ে ফেললেন তিনি। বড় তাড়াহুড়ো করে লিখে খাতা জমা দিয়ে দিলেন মনে হল যেন!
কাপুরুষ, মানে এখানে ছিঁচকে চোরের ভূমিকায় যে ব্রাত্য বসু, তাঁর অভিনয় অনবদ্য। পঁচাত্তর ভাগই মৃত মানুষের অভিনয়। পায়ের তলায় লাগানো রোলার-স্কেটারে ভর করে একটি মৃতদেহ ঘুরে বেড়ায় সারা রাত। কী করে সম্ভব, সে প্রশ্নটাকে দূরে সরিয়ে দিলেই তুঙ্গ অ্যাবসার্ডিটি উপভোগ করতে পারবেন। এখানে কিন্তু পরিচালক অনিকেত চট্টোপাধ্যায় ওভারবাউন্ডারি হাঁকিয়েছেন। একটি বড়সড় মৃতদেহকে নিয়ে এমন স্ল্যাপস্টিক কমিক সিচুয়েশন তৈরি করতে করতে গল্প গেঁথে চলার কায়দাটা দারুণ। শুধু এই গল্পটা নিয়েই ছবিটা ভাবলে হতে পারত একটা অভিনব হাসির ছবি। ব্রাত্যও দুর্দান্ত! স্থির চোখের অভিনয় করা মুখের কথা নয়, সেটাই বেশ অনায়াসে করে দেখালেন। কিন্তু বাধ সাধল তার অন্য চরিত্র। মহাপুরুষ। মহাপুরুষের গল্পটা বলার ঢং-এ বেশ বড়সড় হোঁচট খেয়েছেন পরিচালক। মহাপুরুষের ইন্ট্রোডাকশন সিকোয়েন্স আসলে তাঁর এক অন্ধ ভক্ত বনেদি ব্যবসায়ী দীপঙ্করের বয়ানের মাধ্যমে। সেই বয়ানেই কেন এমন শট থাকল যে প্রথমেই দর্শক বুঝে গেলেন যে ইনি আদতে ভণ্ড সাধু? সূক্ষ্মতাটুকু একেবারেই নষ্ট হয়ে গেল এই দৃশ্যগুলোয়, যেগুলো সিনেমার প্রয়োজনেই নির্মমভাবে বাদ দেওয়া যেত। ফলে দর্শকের প্রেডিক্টেবল লাইনেই দিব্য চলতে থাকল
গল্পটা। অর্ধেক হাসি ছিনিয়ে নিল এই প্রেডিক্টেবিলিটি। মহাপুরুষের চরিত্র গ্রহ-নক্ষত্র-গ্যালাক্সি নিয়ে ইচ্ছেমতো গল্প বানিয়ে কথার তুবড়ি ছোটান। প্রচুর পরিমাণে চর্ব্য-চোষ্য ভক্ষণ করেন। এই কাহিনি আসলে আমাদের চেনা। চন্দ্র-সূর্যকে দম দিয়ে যিনি পৃথিবীকে বাগে রাখতেন, সেই বিরিঞ্চিবাবার বয়ানেরই প্রতিধ্বনি শোনা গেল যেন সদদজানন্দের চরিত্রে। উল্টে সদগজানন্দের ভণ্ডামির ওপরে অযথা বেশি স্ট্রেস দিতে গিয়ে শেষের দিকটা বড় বেশি ভারাক্রান্ত করে তুললেন পরিচালক।
হাতে রইল বাকি চরিত্ররা। কাপুরুষ-পর্বে ঋত্বিক, রিমঝিম, পার্থসারথি ও বিশ্বনাথের অভিনয় বেশ মজাদার। মহাপুরুষ পর্বে কনীনিকা, লকেট ও দীপঙ্করও বেশ স্বচ্ছন্দ। যদিও দুটো পর্ব আলাদা নয়, তবু ছবির মধ্যে সমান্তরালে চলতে থাকা দুটো গল্প হঠাত্ই ক্লাইম্যাক্সে মিলে যাচ্ছে। ব্রাত্য বসুর মহাপুরুষ সদগজানন্দের চরিত্রটা একটু চড়া। ব্রাত্যর অভিনয়গুণই তার থেকে একটা অতিনাটকীয়তা বের করে আনে। ম্যানারিজমটা এত ভাল মেনটেন করেছেন যে, স্ক্রিপ্টের একঘেয়েমিটা তেমন নজরে পড়বে না।