বাংলা ছবির প্রথম সফল চন্দ্রাভিযান, সন্ধান নতুন জ্ঞানের
ছবির নাম : চাঁদের পাহাড় রেটিং: ****১/২
শর্মিলা মাইতি
ছবির নাম : চাঁদের পাহাড়
রেটিং: ****১/২
ছবি বানাতে কী কী লাগে? পরিচালক, অভিনেতা-অভিনেত্রী, ডিওপি, এডিটর? বাজেট, ক্যামেরা, লাইট ইকুইপমেন্ট, এডিট স্টুডিয়ো? অঙ্ক, ম্যান-ম্যানেজমেন্ট? এ ছবি বানানোর জন্য লেগেছিল সম্পূর্ণ অন্য একটি জিনিস আর সেটাই রিকোয়ারমেন্ট লিস্টে এক নম্বরে থাকবে। ষষ্ঠেন্দ্রিয়ের ওপর ভর করার সাহস। আবেগের সঙ্গে বাজেট মিলিয়ে দেওয়া। আর তার পর, কোনও অজানা খনির উদ্দেশ্যে চন্দ্রাভিযান। হয়ত শিখরের চূড়ায়, কিম্বা চূড়ান্ত অসাফল্যের অন্ধকারে। যেখানেই থেমে যাক রকেটের জ্বালানি, সেটাই বীরের মতো মাথা পেতে নেওয়া হবে।
এই প্রথম (সম্ভবত) বাজেটের ধমকানির ঊর্ধ্বে গিয়ে ডানা মেলল আবেগ। এত দিন এই মেলবন্ধনটুকু হয়নি বলেই তো বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই কাহিনি এত বছরেও স্পর্শ করার স্পর্ধা হয়নি কোনও পরিচালকেরই। শুধুমাত্র অনুমান আর ভৌগোলিক অবস্থানের উপর ভর করে যে-উপন্যাস লিখেছিলেন তিনি, উপযুক্ত টেকনোলজির অভাবই এত দিন ব্রাত্য রেখেছিল তাকে। সেই স্বপ্নপূরণের পাসওয়ার্ড পাওয়া গেল কমলেশ্বর + ভেঙ্কটেশ ফিল্মসের চাঁদের পাহাড় ছবিতে।
চোখ কপালে তোলার মতো প্রশ্ন ছিল, দেব কেন? দেব কীভাবে? দেব আর শঙ্কর দুই বিপরীত মেরু এমন জুড়ে গেল কীভাবে? মিডিয়ার সৌজন্যে এত দিনে সবাই সে প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গিয়েছেন। শঙ্করের শরীরে আর মননে যে দুর্লভ অ্যাডভেঞ্চারের উদ্দীপনা, সেটা দেবের স্ক্রিন-প্রেজেন্সের সঙ্গে খাপ খায়। বাস্তবে পনেরো কোটি টাকা বাজি ধরা যায় এমন একজন হিরো মেটিরিয়্যালের উপর, যার জনপ্রিয়তা ছবির ফ্লপ বা হিটের উপর নির্ভরশীল নয়। চাঁদের পাহাড়-এর শঙ্কর, দেবের কাছে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ! প্রত্যাশার পাহাড় পেরিয়ে চাঁদের পাহাড়ে পৌঁছনোর চ্যালেঞ্জ। আমবাঙালির সবার ঘরে এক সেট বিভূতি রচনাবলি আছে। সকলেরই পড়া আছে এই একাত্তর পাতার উপন্যাস...
সৌমিক হালদার, ক্যামেরার চোখ দিয়ে প্রথম আবিষ্কার করলেন বিভূতিভূযণের এই উপন্যাস। দুর্ভাগ্য এ বঙ্গদেশে এই দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ক্যামেরাম্যানের কতখানি কদর হবে, এ ছবি তৈরির সত্তর ভাগ ক্রেডিট ওঁর। কী দুর্গম জঙ্গল, কী দুর্লঙ্ঘ্য পাহাড়, কী আলো-আঁধারির গ্রামের কুটীর...কিংবা চাঁদের পাহাড়ের গুহার ভিতরে ছড়িয়ে থাকা হিরের দানা, সব জায়গায় তাঁর তৃতীয় নয়ন অধিকার করে না বসলে এই বিরাট, বিপুল ভান্ডার আমাদের চোখ অবধি এসে পৌঁছত না।
চিত্রপরিচালকের পূর্ণ স্বাধীনতা আছে উপন্যাস থেকে ছবির প্রয়োজনে পরিবর্তন করার। পথের পাঁচালী উপন্যাস ও সত্যজিতের চলচ্চিত্রায়ণ অনেকটাই আলাদা। কমলেশ্বরও করেছেন। সিংহের সঙ্গে দেবের লড়াইটা একটা দুর্ধর্ষ মাত্রা পেয়েছে। আফ্রিকায় কর্মরত শঙ্কর রাত্রির গভীরে ব্ল্যাক মাম্বার সঙ্গে মৃত্যুর লড়াই লড়ছে একটি টর্চকে সম্বল করে। টর্চের আলোয় সম্মোহিত ফণাধারী সাপ, ভয় পেয়ে পালাচ্ছে। বাংলা ছবির ইতিহাসে এই সিকোয়েন্সটি লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট হিসেবে ধরা যেতে পারে। মনে পড়ে না এমন নিখুঁত এডিটিং। কখনও কখনও ভুলেই যাচ্ছিলাম কোনও বাংলা ছবি দেখছি। এ ছবির নায়িকা আফ্রিকার লাস্যময়তা মনের কোণে ছড়িয়ে যায় বাষ্পের মতো। দর্শককে সম্মোহিত করবেই করবে।
অসামান্য গ্রাফিক্সের ব্যবহার এ পর্যন্ত বাংলা ছবি তো দূর অস্ত, হলিউডি ছবিকেও টেক্কা দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। বিভূতিভূযণের কল্পনার বুনিপ, গ্রাফিক্সের গুণে এখানে চেহারা পেয়েছে। ভয়ঙ্কর সুন্দর! হয়ত বা বুনিপের সেই অশরীরী আকর্ষণটা রেখে দিলেই ভাল হত। বুনিপ নামক জন্তুর অ্যাবসেন্সের মধ্যে যে রহস্যময়তা, সেটাই ধরা পড়তে পারত। কী হত বলা মুশকিল। কিন্তু যা হয়েছে, সেটাও লোমহর্ষণের নিরিখে কোথাও কম যায় না। যে-হিংস্রতায় বুনিপ আলভারেজকে ফালা-ফালা করে শেষ করে দেয়, তা দেখে হাড় হিম হবে না, এমন মানুষ কমই আছেন। আর যে বুদ্ধির প্রয়োগে বুনিপের নিধনযজ্ঞ করে শঙ্কর, ভিশুয়াল এফেক্টে তাক লাগাবে সকলেরই। কে ভুলবে এমন নিখুঁত ভলক্যানো ইরাপশনের দৃশ্য। ভিসুভিয়াস জেগে উঠছে! মনে থাকবে প্রায় নিখুঁত সেট ডিজাইনিং।
চমত্কার আলভারেজ। ছবিতে যে চরিত্রে অভিনয় করলেন জেরার্ড রুডল্ফ। সবকিছুর মধ্যে আলাদা করে যে খটকাটা বড় বেশি লাগে, তা দেবের অভিনয়ের জড়তা নয়। তা হল কমলেশ্বরের ভয়েস-ওভার। সারা ছবি জুড়ে এমন ভাঙা গলার ভয়েস ওভার বড় বেমানান। বরং দেব যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন। তাঁর অশুদ্ধ বাঙালি টান আসলে অজ পাড়াগাঁয়ের শঙ্করকেই মনে পড়ায়, যে গ্রামগুলোয় আজও শুদ্ধ বাংলা ভাষায় কথা বলে না কেউ। আলভারেজের মারা যাওয়ার পর মৃত্যুকূপে ঘুরতে থাকা, অনাহারে মৃতপ্রায় শঙ্করের অভিনয় দারুণ লেগেছে। গা শির-শির করেছে কাঁকড়াবিছে চিবিয়ে খাওয়ার দৃশ্যটায়।
শহরতলি ও প্রত্যন্ত গ্রামে যে পোস্টার পড়েছে তাতে লেখা- দেব অভিনীত অন্য ধরণের রঙ্গীন বাংলা ছবি-চাঁদের পাহাড়। সঙ্গে- বাঘ, সিংহ, হাতি, সাপ ও জেব্রা!!! কথাটা নিতান্ত মন্দ না। শুধু, চাঁদের পাহাড় উপন্যাসের শেষেও যে যৌবনের জোশটা ধরে রাখতে পেরেছিলেন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, সেটা এখানে কেমন যেন উধাও হয়ে গেল। জাহাজ কেনার পরে শঙ্কর বলছে, ডেস্টিনেশন মুন মাউন্টেন... উপন্যাসের শঙ্কর কিন্তু একটা কোম্পানি তৈরি করে চাঁদের পাহাড় সন্ধানে আবার পাড়ি দেওয়ার স্বপ্ন দেখেছিল। এখানে আরও একটু কনস্ট্রাকটিভ হতে পারতেন পরিচালক।
পুনশ্চ: খুঁত ধরা বাঙালির চিরাচরিত বদভ্যেস। সেটুকু গ্রাহ্য না করে যা হয়েছে তাতে চাঁদের পাহাড় ছবিটিকে বাংলা ছবির বিবর্তনের ল্যান্ডমার্ক বললে, বিশেষ কিছুই বলা হবে না। বাংলা ছবির সফল চন্দ্রাভিযান বলাই যায়!