শতবর্ষে সত্যজিৎ: 'চারুলতা' যেমন সুন্দর, তেমনই রাজনৈতিক
কীভাবে এমন দেখার চোখ কারও থাকতে পারে?
ইমতিয়াজ আলি
বাংলা মানেই শিল্পের পীঠস্থান। আর সত্যজিৎ রায় সেই শিল্পের পীঠস্থানের অন্যতম শিল্পী। যিনি তাঁর ছবিতে কিছু বলতে চেয়েছেন বারবার। হয়তো একটা গল্প। সেটাকেই সিনেমার ভাষায় তুলে ধরতে চেয়েছেন। সত্যজিৎ তো শুধুমাত্র গল্প লেখেননি, উনি প্রকৃত শিল্পী। বিজ্ঞাপন, সিনেমা, গান, আঁকা, আবহ, লেখালেখি-- সব ক্ষেত্রে তাঁর বিচরণ। সেই সত্যজিৎকে আমি প্রথম দেখলাম 'চারুলতা' ছবিতে। সেই সময় আমি বেশ ছোটই বলা যায়। কিন্তু 'চারুলতা' সিনেমাটা মনে রয়ে গিয়েছে আজও। মনে থেকে যাবে আজীবন।
'চারুলতা' (charulata) দেখে প্রথমবার বুঝতে পেরেছিলাম, সিনেমার ভাষা আসলে কেমন হতে পারে। আমাদের বাড়িতে ছোটবেলা থেকেই সিনেমা দেখার একটা পরিবেশ ছিল। বাবা-মা সমান্তরাল ছবি দেখতেন। শাস্ত্রীয় সঙ্গীত (Classical music) শুনতেন। কবিতা (poetry) পড়তেন। সবমিলিয়ে গুপী গাইন বাঘা বাইন, ফেলুদা-- এইসব ছবির ভক্ত ছিলেন বাবা-মা। সেই ভাবেই আমারও অন্য ধারার ছবি 'চারুলতা' দেখা। আমি সত্যিই মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম এই ছবিটা দেখে। এখনও ভাবতে পারি না, এমন ছবি কীভাবে কেউ বানাতে পারেন? আমার বারবার মনে হয়, কীভাবে এমন দেখার চোখ কারও থাকতে পারে? চারপাশে তো আমরাও এমন অনেক কিছু দেখি। কিন্তু এই বোধ? ভাবা যায় না! যেমন সুন্দর, তেমনই রাজনৈতিক।
আরও পড়ুন: সত্যজিৎ আমাদের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে সূর্য ছিলেন, অন্যদের আলোকিত করেছিলেন তিনি
'চারুলতা' সিনেমার প্রতিটা চরিত্রের আলাদা ধরন, প্রত্যেকে আলাদা মানুষ। সত্যজিৎ (satyajit ray) কিন্তু কাউকে সেলুলয়েডে 'জাজ' করেননি। সবাই সবার মতো। কেউ ভুল, কেউ ঠিক-- এমনটা একবারও মনে হয়নি। 'চারুলতা' আমাকে এমনই আকর্ষণ করেছিল যে, ঠিক এর পর থেকেই আমি সত্যজিতের অন্য ছবিগুলোও দেখা শুরু করলাম। 'হাইওয়ে' তৈরির পর আমার মনে হয়েছিল চরিত্রগুলোকে নিয়ে আরও একটু ভাবার বিষয় রয়েছে। সমাজকে একটু অন্য ভাবেও দেখা উচিত। সত্যজিৎ কোনও ফিল্ম ইনস্টিটিউটে পড়েননি। রায়ের কলাকুশলীরাও কেউ ফিল্ম স্কুলের নয়। বলাটা হয়তো অন্যায় হচ্ছে, আমারও লেন্স নিয়ে শেখাটা সেটে এসেই। এভাবে নতুন কিছু শেখার আগ্রহটা তৈরি করে দিয়েছিলেন সত্যজিৎ। 'প্রতিদ্বন্দ্বী','আগন্তুক'-- এই ছবিগুলোই-বা কম কী!
সত্যজিতের ছবি দেখলেই ছবির ট্রিটমেন্ট নিয়ে আরও অনেক কিছু ভাবতে ইচ্ছে করে। নতুন কিছু করতে ইচ্ছে করে। জামশেদপুরে বাবা মায়ের সঙ্গে হলে যেতাম বারবার। ফিল্মে রিল ভরা, প্রজেক্টর ইত্যাদি সেই সময় খুব টানত। শট যদিও বুঝতাম না। তবে 'চারুলতা' বা অন্য ছবি দেখে পরবর্তীতে এটা বুঝতে পেরেছি, শটের আগে পুরোটাই মাথার মধ্যে থাকত সত্যজিতের।
সিনেমায় কতটা দরকার, কী কী দরকার নয়, নিপুণ হাতে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। সেলুলয়েডে সত্যজিতের ছবি দেখলেই সেটা বোঝা যায়। তাই সত্যজিতের ছবির অন্য একটা মূল্য রয়েছে। মনের মধ্যে বেশ কিছু ছবি ধরা ছিল সত্যজিতের। মনের মধ্যে থাকা সেই ছবিগুলোরই অনুবাদ করলেন তিনি সিনেমা বানিয়ে। অন্য ভিশন বলতে আসলে কী বোঝায় তা বুঝিয়ে দিলেন।
সত্যজিৎ অসম্ভব স্পেসিফিক। সত্যজিৎ বড্ড সুন্দর। সত্যজিতের শব্দগুলো পর্যন্ত নির্দিষ্ট। সত্যজিতের ফ্রেমিং, তাঁর ছবির মিউজিক, নোট, আবহ-- সবটাই কী নিখুঁত! শুধু তাই নয়, সত্যজিতের ছবিগুলো দেখলে বোঝা যায়, কোন অভিনেতাদের তিনি নেবেন সেটাও মনের মধ্যে ছবির মতো গেঁথে রাখতেন তিনি। আর সত্যজিতের কণ্ঠশিল্পীর নির্বাচন। উফফ ! কিশোরকুমারের (kishore kumar) কণ্ঠে 'চারুলতা'-র অমলের গলায় সেই রবীন্দ্রসঙ্গীত। বারবার মনে পড়ে ওই কণ্ঠ। একেবারে চরিত্রের সঙ্গে মিশে গিয়েছিল সত্যি।
সত্যজিৎ আসলে সিনেমার ভাষায় কিছু বলতে চেয়েছেন। তবে তা শুধু কিছু শব্দ নয়। অন্য কিছু। কিছু একটা বোধ। সত্যজিতের যে কোনও ছবি যেন জানা অনেক কিছুর বাইরের বস্তু। তা যেন অন্য কিছু। নতুন কিছু। তিনি কী শট নেবেন, সেটা শুরু থেকেই জানতেন। এর জন্য ফিল্ম স্কুলের দরকার হয়নি। আমার তো মনে হয়, অভিনেতাদের সঙ্গে চরিত্রের মুখের অভিব্যক্তিগুলোও ভেবে রাখতেন তিনি।
তেমনই ছিল তাঁর ছবির আবহ সঙ্গীত। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ব্যবহার যেন আসলে সত্যজিতের ছবির একটা জার্নি। আমাদের ডিজিটাল যুগে তো ক্যামেরা দিয়ে কভারেজ করা হয়। পরিস্থিতিকে বিভিন্ন দিক থেকে দেখে বেশ কিছু শট তুলে নিলেই হয়ে গেল। কিন্তু সত্যজিতের মতো দূরদর্শী পরিচালক ঠিক করে নেন, কোন শট নেবেন। তা-ও সেলুলয়েডে। এটা পরিচালক হিসেবে সত্যিই অনুসরণযোগ্য।
আরও পড়ুন: সত্যজিৎ শতবর্ষ: সত্যজিতের কাজের সব চেয়ে বড় কথা হল ওঁর টোটাল ডিসিপ্লিন