পয়লার প্রতিজ্ঞা হোক বাংলা ভাষাকে ভালবাসা
পয়লা বৈশাখ মানেই যে বেশি উৎসব হত, এমনটা নয় তবে ছুটি থাকত। আর যেহেতু গ্রীষ্মকাল এবং আম খাওয়ার একটা ব্যাপার থাকত, ফলে সেটা নিয়েই খুব এক্সাইটেড থাকতাম।
আবীর চট্টোপাধ্য়ায়: পয়লা বৈশাখ মানেই যে বেশি উৎসব হত, এমনটা নয়, তবে ছুটি থাকত। আর যেহেতু গ্রীষ্মকাল এবং আম খাওয়ার একটা ব্যাপার থাকত, ফলে সেটা নিয়েই খুব এক্সাইটেড থাকতাম। বাচ্চাদের নতুন জামাও দেওয়া হতো। একটা-দু'টো নতুন পাওনাও হতো। সুতির জামাই দিত। কারণ আমরা তো খুব শান্ত ছিলাম, তাই ঘেমে যেতাম। বিভিন্ন দোকানে হালখাতা খোলার ব্যাপার ছিল। বিশেষ করে গয়নার দোকানে, আমি দিদার সঙ্গে গয়নার দোকানে যেতাম আর সেখানে সবচেয়ে মজার ব্যাপার ছিল যে কোলড্রিঙ্ক। তখন কোল্ডড্রিঙ্কে চুমুক দিয়ে নিজেকে একটু বড় বড় মনে হত। কারণ শাসনের বাইরে বেরিয়ে একটু কোলড্রিঙ্কে চুমুক!
মামার বাড়ি থেকে দিদার হাত ধরে একটা দোকানে যেতাম। সেখানে কোলড্রিঙ্কের একটা অন্যরকম ভাললাগা ছিল। ঝাঁজালো কোল্ডড্রিংস আমি খাব আর একটু কম ঝাঁজ হলে সেটা মহিলারা খাবে। ছোটবেলায় আমার এই ধারনাটাই ছিল। তবে এখন আমার ভুল ভেঙে গিয়েছে, দিদার মতো স্মার্ট মহিলা আমি আমার জীবনে দেখিনি। আমার এখনও মনে আছে যে, আমরা একটা দোকানে গিয়েছিলাম এবং সেখানে আমাদের খুব আপ্যায়ন করা হয়েছিল। কোলড্রিঙ্ক দেওয়া হয়েছে তো আমি ভাবছি আমি যে কোল্ডড্রিঙ্ক নেব, সেটার ঝাঁঝ বেশিই হবে, কিন্তু দিদা একটা ঝাঁজালো কোল্ডড্রিঙ্ক নিলেন এবং আমি শেষ করার আগেই শেষ করে ফেললেন।
আরও পড়ুন: ১লা বৈশাখে বাবার দোকানের জন্য মিষ্টির বাক্স তৈরির মধ্যেই সৃষ্টির আনন্দ খুঁজেছি: Paoli
পয়লা বৈশাখ স্পেশাল করে আলাদা কিছু নাটক হতো না। বাবা সেটা করত না, তবে সামনে যেহেতু পঁচিশে বৈশাখ থাকত তার রিহার্সাল হত, সেটা এনজয় করতাম। কে কবিতা বলবে, কে গান করবে, কে নাটক করবে! এই নিয়ে মেতে থাকতাম। সেই সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানগুলো এখন আর দেখা যায় না। ততদিনে ইংরেজি নববর্ষটা বিশেষ করে পালন করা শুরু হয়ে গিয়েছে। তো সেই সেই দিক দিয়ে আমাদের খুব বলা হতো যে, বাংলা নববর্ষের দিকেই বেশি করে নজর দাও, সেটা মা বাবা বলতেন,আমাদের কাছে মা-বাবারা পয়েন্ট আউট করতেন যে, এটা কিন্তু বাংলা নববর্ষ আমাদের কাছে আলাদা করে বলতেন যে এটাকে উদযাপন করতে শেখ।
গত পাঁচ-ছয় বছরের অভিজ্ঞতা থেকে আমি বলতে পারি যে আমাদের মধ্যে বড্ড 'অকেশন স্পেসিফিক সেলিব্রেশন' শুরু হয়ে গিয়েছে মানে একটা দিন আসলে সেই দিনটা নিয়ে ভাবব, আর বছরের বাকি সময়টা অন্য বিষয়ে ব্যস্ত! উৎসবগুলো আসলে বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন সকলের সঙ্গে এক সঙ্গে বসে সময় কাটানো। কারণ বাকি সময় আমরা প্রচুর ব্যস্ত। এর একটা বাণিজ্যিক দিকও আছে যদিও যেটাকে আমরা উপেক্ষা করি। গত কয়েক বছরে নববর্ষের একটা ব্র্যান্ডিং হচ্ছে আগে যেমন বাংলা সিনেমা দেখার একটা চল ছিল। রেস্তোরাঁয় বাঙালি খাবার তার সঙ্গে বাংলা সিনেমা দেখার একটা রীতি ছিল, গত কয়েক বছরে দেখছি সেটা আবার ফেরত এসেছে। আমার ছবিও পয়লা বৈশাখে মুক্তি পেয়েছে। সেটা ছিল বিসর্জন আর ঠিক তার সাতদিন আগেই জাতীয় পুরস্কার পেয়েছিল এই ছবি। আবার ধারাও বদলাচ্ছে, আগে শুধু ছোটদের গিফট দেওয়া হতো এখন কিন্তু সবাইকে দেওয়া হয়। তাই কোথাও গিয়ে আমি এটাকে সাধুবাদ জানাই।
আরও পড়ুন: ছোট থেকে শিখে আসা বাঙালির ১লা বৈশাখের সংস্কৃতি এখন ছেলেমেয়েদের শেখাই : Rituparna
একটা জিনিস বলতে চাই যেহেতু এটা বাংলা নববর্ষ। আমার মনে হয়, বাংলা ভাষাকে যে, আমরা ভালবাসি সেটা সোচ্চারে না বললেও হবে। সেটা বরং আমাদের মধ্যে থাক। আমাদের আচার-ব্যবহারে যদি প্রকাশ পাক, সেটাই কাম্য। যে আমার মাতৃভাষাকে আমি ভালোবাসি। আর একটা বিষয় বলতে চাই। আমার মাতৃভাষাকে আমি ভালোবাসি বলে যে, অন্যের মাতৃভাষা বা অন্য ভাষাকে আমরা অসম্মান করব তা কিন্তু একেবারেই নয়। একুশে ফেব্রুয়ারি বাংলা ভাষার জন্য ভাষা শহীদরা প্রাণ দিয়েছিলেন, তারপর ওটাকে ভাষা দিবস হিসাবে গোটা বিশ্বে পালন করা হয় এবং প্রতিটি দেশে তার নিজের মাতৃভাষাকে উদযাপন করা হয়, কোথাও গিয়ে এই যে ভাষার প্রতি সম্মান এবং মাতৃভাষা যে কোথাও গিয়ে বাঙালির শিকড়, সেটাকে সেলিব্রেট করা আরকি। সে ক্ষেত্রে আমি এটুকুই বলতে চাই যে, আমরা বাঙালিরা আমরা যদি আমাদের অ্যাকশনে সেটা বেশি করে প্রমাণ করি যে, আমরা বাংলা ভাষা বেশি ভালোবাসি, তাহলে বরং বেশি ভাল হয়।
একদিনের জন্য বাংলাভাষাকে সেলিব্রেট করে লাভ নেই। আমরা যদি অহঙ্কারটা বাদ দিয়ে গৌরবটা রাখি, আমার বাংলা ভাষা বিশ্বের সেরা পাঁচটি ভাষার মধ্যে একটা, এদিকে বাংলা সিনেমা দেখার সময় আমি প্রচণ্ড জটিল হয়ে যাচ্ছি। এইটা হয়েছে মুশকিল। বাংলা যদি সত্যিই সেরা পাঁচটি ভাষার মধ্যে পড়ে তাহলে প্রতিনিয়ত আমাদের কেন শুনতে হয় আমাদের ইন্ডাস্ট্রিতে আর ভালো কিছু হচ্ছে না কেন? যখন সত্যি সত্যিই আমরা আমাদের বাঙালিয়ানাকে ভালবাসব। আমরা বাংলা ভাষাকে ভালোবাসব. তখনই বাংলা শীর্ষে পৌঁছবে। যদি আমরা মনে মনে ঠিক করি যে আমরা সত্যিই বাংলা ভাষাকে ভালবাসি, এবং আলোচনা কম করে নিজেদের মধ্যে ভালোবাসাটা বেশি থাকে সেটাই ভাল। আমরা ফেসবুকে লেখার জন্য লিখছি না, আমরা সত্যিই বাংলা ভাষাকে ভালবাসি এবং তার জন্য যা যা করার আমরা করতে পারি, এটাই আজকের দিনে প্রতিজ্ঞা হওয়া উচিৎ সকলের।