অপলকে দেখা অপুজীবনী, জীবনজোড়া পথের পাঁচালী
শর্মিলা মাইতি ছবির নাম: অপুর পাঁচালী রেটিং: ****
অপলকে দেখা অপুজীবনী, জীবনজোড়া পথের পাঁচালী
শর্মিলা মাইতি
ছবির নাম: অপুর পাঁচালী
রেটিং: ****
চার বছর ধরে নির্মাণকার্য চলেছিল এ ছবির. সবশেষে টাকা জুগিয়েছিল পিডব্লুডি. শিশুশিল্পীদের বয়স বাড়ছে, শৈশবের নরম দেহরেখা এই বুঝি কৈশোর ছুঁল... বহু দড়িটানাটানির খেলা খেলে অবশেষে ছবি শেষ করেছিলেন নবীন সত্যজিত্. সত্যজিত্ রায়. একেই বলে শুটিং! সে সৃষ্টি রয়ে গেল সোনার তরীতে. স্রষ্টা পরপারে চলে গেলেন. সেই সৃষ্টিই জন্ম দিল অবিনশ্বর একটি নাম- অপু.
অপুর পাঁচালী ছাড়া আরও অন্য কোনও নাম রাখার অবকাশ ছিল না পরিচালক কৌশিক গাঙ্গুলির. সারাজীবন যিনি অন্তরালে, অতি অল্প জীবনরসদ এবং অতি বৃহত্ একটি নামের ছায়া বয়ে বেড়িয়েছেন, সেই সুবীর ব্যানার্জি. আজ তাঁর ছোট্টবেলার সেই চরিত্রের মুখচ্ছবি শোভা পায় প্রায় প্রতিটি, হ্যাঁ, প্রায় প্রত্যেকটি আন্তর্জাতিক ফিল্ম উত্সবে, তাঁর খোঁজ কেউ রাখে না. এই কলকাতা শহরেরই এক অনামী নিশ্চিন্দিপুরে, তাঁর দিনগুজরান. বড় বেশি সাধারণ মানুষের মতোই. এককামরা ঘর, দক্ষিণের জানালা, প্রয়োজনীয় জিনিস এখানে-সেখানে, নারীর নরম পরিপাট থেকে বঞ্চিত বহু, বহু যুগ.. এ-যেন স্ত্রীবিয়োগের পরের অপু.
আরও সত্যি বলতে গেলে, পরতে পরতে এমন সাধারণত্ব আজকের যুগে মেলা- অসম্ভব!
হারিয়ে যাওয়া সেই কাল্ট ফিগার. জার্মানি থেকে এক বিরল সম্মানে ভূষিত হচ্ছেন. “World’s most celebrated child artiste”. ফিল্ম ইনস্টিটিউটের স্টুডেন্টের ভূমিকায় গৌরব চক্রবর্তী. চিঠিটা বাস্তবের অপুর ঠিকানায় পৌঁছে দেওয়ার গুরুদায়িত্ব তারই. তার চেয়েও বেশি, তাকে কনভিন্স করানোর দায়িত্বও চিত্রনাট্যের চাবি তাঁর হাতে. এতদিনের অজানা সিন্দুকের দরজা খুলে যাচ্ছে তারই অনুসন্ধিত্সায়. আর তার পর. দরজার আইহোলে সেই অপলক চোখ, যাকে শেষবার দেখা গিয়েছিল ছেঁড়া চাদরের ফাঁকে. সত্যজিতের ক্যামেরায়.
শিশুশিল্পীরা বিলুপ্ত প্রজাতি. বাইসাইকেল থিভস, ইটি থেকে দ্য কিড, বিশ্ববন্দিত সেই সেব চরিত্ররা আজ কই? এই গুপ্তকক্ষ থেকে যে কোহিনূর বেরিয়ে এল, জেঠু আর ভাইপোর নানা কথোপকথনে যা দ্যুতি মেলে ধরল, তা তুলনারহিত.
সমুদ্রের মতো এগিয়ে যাওয়া গল্প. যাতে বার বার আছড়ে পড়ে পথের পাঁচালীর দৃশ্য. সেই নয়নাভিরাম, বার বার দৃষ্টিক্ষেপণেও নষ্ট-না-হয়ে-যাওয়া সেই সব দৃশ্য, অপুজীবনীতে মিশে যায়. সম্মোহিত দর্শক বার বার টাইমমেশিনে ঘুরতে ফিরতে থাকেন. ইতিহাস, বাস্তব নাকি ম্যাজিক রিয়্যালিজম. টাইম-স্পেস এলোমেলো করে জীবনজুড়ে অপুর ট্রিলজির নিশিডাকে একটি জীবনের ফ্রেম তৈরি হয়ে যায়.
যৌবনের সুবীরের চরিত্রে পরমব্রত. স্টার্ট, অ্যাকশন, ক্যামেরা থেকে যোজন যোজন দূরের, অথচ সত্যজিতের ছবির কত কাছের. তার জীবনে ছায়াসঙ্গী হয়ে থাকে অপুর ট্রিলজি. নকশাল পেরিয়ে কমিউনিজম আসছে. এই সুবীর পোড়-খাওয়া যুবক, আন্দোলনের স্রোতে, বিপ্লবের স্রোতে গা ভাসায় না. সংসার টেনে চলে প্রাণপণে. তবু এই জীবনেও বার বার বিয়োগ নেমে আসে. বাবা, স্ত্রী অসীমা, সদ্যোজাত পুত্রসন্তান. মৃত্যু জয় করে বার বার জীবনে ফিরে আসে সুবীর. তবু একটি প্রশ্ন তার পিছু ছাড়ে না. তুমি কী অপু? আপনি কী অপু? তুই কী অপু? প্রতি পদেই যেন সেই অপুর জীবনেরই অনুশীলন. কাশবনে ঘেরা টাওয়ারে কান পেতে তার বউকে শোনায় ট্রেন আসার শব্দ. ভারতীয় ছবির সর্বকালের সেরা সেই দৃশ্যকে এমন কুর্নিশ আর কেউ জানাতে পারেননি!
পার্নো অসীমার ভূমিকায়. বোধকরি আরও একটু সাবধান হতে পারতেন পরিচালক. পাড়াগেঁয়ে বধূটি যখন “রিশকা” বলেন রিসাইকল কথাটি শুনে. তখন কেমন করে “টাইপিং স্পিড” কথাটি এমন শুদ্ধ উচ্চারণে বলতে পারেন? পার্নো যথাসাধ্য করেছেন লাজুক মেয়েয়টিকে ফুটিয়ে তোলার, সুন্দর মানিয়েছে তাঁকে. সদ্যোজাতকে একটিবার দেখতে পাওয়ার বাসনার দৃশ্যেও বেশ প্রাণবন্ত. প্রাণবন্ত ঋত্বিকও.
শীর্ষ রায়ের ক্যামেরা এ পর্যন্ত সবচেয়ে সেরা. বহু পুরস্কারের বাহারে নয়, যে ক্যামেরার কাজ স্থান পাবে চিরস্থায়ী মিউজিয়ামে. বহু বিশ্ববিদ্যালয়ে একদিন চর্চিত হবে. অপূর্ব এডিটিং. সাদা-কালো ফ্রেমের ব্যবহার. কৌশিক গাঙ্গুলির শব্দ ছবিতেও যেমন মনে হয়েছিল, ইন্টারভ্যাল নিতান্ত নিষ্প্রয়োজন. এ-ছবিও তেমনই. ইন্টারভ্যাল ফুটে উঠলে মনে হয় ছন্দ পতন হল.
শেষ দৃশ্যকটি ভোলার নয়, বৃষ্টির দিনে সদ্যোজাত সন্তানকে কবরদান.. নৌকা ভেসে যায় জীবন নদীতে, ধীরে ধীরে অপসৃয়মান অপুর দেহরেখা.