খাঁটি কড়াপাক `বরফি`-র রেসিপি
বললেন অনুরাগ বসু। রণবীর-প্রিয়ঙ্কার `বরফি`-র শুটিং শেষে, কলকাতার মিডিয়াকে দেওয়া প্রথম এক্সক্লুসিভ সাক্ষাত্কার। ফাঁস করলেন বরফি-র ব্যাকস্টেজ ড্রামা। মুম্বইয়ে পোস্ট-প্রোডাকশন স্টুডিয়ো থেকে ফোনে কথা বললেন ২৪ ঘণ্টার প্রতিনিধি শর্মিলা মাইতির সঙ্গে
বললেন অনুরাগ বসু। রণবীর-প্রিয়ঙ্কার `বরফি`-র শুটিং শেষে, কলকাতার মিডিয়াকে দেওয়া প্রথম এক্সক্লুসিভ সাক্ষাত্কার। ফাঁস করলেন বরফি-র ব্যাকস্টেজ ড্রামা। মুম্বইয়ে পোস্ট-প্রোডাকশন স্টুডিয়ো থেকে ফোনে কথা বললেন ২৪ ঘণ্টার প্রতিনিধি শর্মিলা মাইতির সঙ্গে
সাততাড়াতাড়ি ট্রেলার রিলিজ করে দিলে বরফি-র। ছবি রিলিজ হতে তো সেই সেপ্টেম্বর মাস। পরিচালক হিসেবে কেমন লাগছে?
অনেক দিন বাদে ভাল করে ঘুম দিলাম। ময়রা হিসেবে আমি ফুল মার্কস পেয়ে গিয়েছি।
ট্রেলারটা আমরা দেখতে পাচ্ছি, আন্দাজ করছি, তোমার ফিল্মটা মিউজিক্যাল রম কম। কেমন যেন নির্বাক চলচ্চিত্রের গন্ধ পাচ্ছি। সন্দেহজনক!
না না, সায়লেন্ট একেবারেই নয়। সবাই কথা বলেছে। ডায়লগ আছে। চিন্তা নেই! তবে হ্যাঁ, একটা চেষ্টা করেছি, নির্বাক যুগের ছবির মধ্যে যে নির্মল আনন্দ ছিল। সেটাকেই নতুন আলোয় তুলে আনা।
তোমার মার্ডার, গ্যাংস্টার কিংবা কাইটস ছবির থেকে এক্কেবারে আলাদা চিন্তাভাবনা... তাহলে সায়লেন্ট ফিল্মস নিয়ে বেশ পড়াশুনো করেছ মনে হয়...
যে-সব ছবির নাম বললে, সেগুলোর একটা মজা আছে। তুমি যদি অডিয়ো অফ করে দিয়ে ছবিগুলো দেখতে থাকো, তাহলেও স্টোরিটা বুঝতে তোমার অসুবিধে হবে না। আবার চোখ বন্ধ করে বা ভিডিয়ো অফ করে যদি শুধু সংলাপ শুনতে থাকো, তাহলেও আমার ছবি বুঝতে পারবে। সেভাবেই আমি স্ক্রিপ্ট লিখি। ছোটবেলায় খুব মন দিয়ে রেডিয়ো-ড্রামা শুনতাম। সায়লেন্ট ফিল্ম খুব বেশি করে দেখেছি এমন নয়, তবে ভালবাসি। বরফি ছবির মিউজিক অনেকটাই আলাদা করার চেষ্টা হয়েছে। সায়লেন্ট ছবিকে নকল করা বা ফলো করা, কোনওটাই হয়নি।
সঙ্গে রণবীর কপূরের চ্যাপলিন-স্টাইলের অ্যাক্রোব্যাটিক্স। আরও বেশি করে সায়লেন্ট ছবির যুগের কথা মনে পড়ায়।
এখানেও ফলো করা হয়নি। একটু ভাল করে দেখলে বোঝা যাবে, রণবীর কিন্তু আসলে নিজস্ব একটা স্টাইল তৈরি করেছে। হাঁটাচলা, কথা বলার স্টাইল, সবই অন্যরকম। হ্যাঁ, ও সায়লেন্ট কমেডি স্টাডি করেছে। চার্লি চ্যাপলিন, বাস্টার কিটনদের কাজ মন দিয়ে দেখে প্র্যাকটিস করেছে। এটাই দারুণ ব্যাপার।
বরফি ছবিটার ক্ষেত্রে তুমি এত প্রচারবিমুখ ছিলে কেন? কিন্তু আজকাল বলিউডের বহু ছবি শুটিং ফ্লোরে যাওয়ার আগে থেকেই প্রচার অভিযান শুরু হয়ে যায়...
দেখো, আমি বিশ্বাস করি ছবির ব্যাপারে, বিশেষ করে এই ছবিটার ব্যাপারে বেশি-বেশি কথা বলে কোনও লাভ নেই। কাজে করে দেখানো উচিত। ছবি বলে-বলে দেখানোর চেয়ে, দেখিয়ে বলা বেশি এফেকটিভ। শুনলে রেগে যাবে তুমি,তবু বলছি, শুটিং চলাকালীন মিডিয়াকে ঘেঁষতে দিইনি কেন জানো? একে মাথায় এক গাদা চিন্তা, তার ওপর সাংবাদিকরা কী কেন কবে কোথায় -এত সব শক্তশক্ত প্রশ্ন করতে থাকে যে, এতে কনসেন্ট্রেশনের ব্যাঘাত হয়। একেই আমি কিছুই গুছিয়ে বলতে পারি না! তার ওপর আমার অ্যাসিস্ট্যান্টরা ভিড় সামলাতে অস্থির হয়ে যায়। খোঁজ রাখতে হয় স্টার-রা ঠিক সময়ে ঘুম থেকে উঠেছে কি না, মেক-আপ ভ্যানে ঠিক টাইমে ঢুকল কিনা, প্রপস রেডি কিনা। হাজার রকমের হ্যাপা! তা ছাড়া হোয়াই শুড আই টক? লেট মাই ফিল্ম টক। লেট পিপল টক অ্যাবাউট মাই ফিল্ম (হাসি)
এখন ট্রেলার এসে গিয়েছে মিডিয়ায়, এবার কে প্রথম কথা বলবে? মিডিয়া না পিপল?
মিডিয়া শুড মেক পিপল টক! (হাসি) আরে বাবা, কাজ শেষ করে কাজ দেখাই আমি। এটাই আমার টেকনিক।
কলকাতায় শুটিং করলেন, কিন্তু কাছের বন্ধুদেরও জানতে দিলেন না...?
রণবীর প্রিয়াঙ্কা শুটিং করছে খবর গেলে ক্রাউড সামলানো যেত না! তবে একটা মজার ব্যাপার ঘটেছিল কলকাতায়। প্রিয়ঙ্কার কস্টিউম আর মেক-আপ এমনই ছিল যে, চারদিক থেকে লোকে দেখছিল, কিন্তু চিনতে পারছিল না। ভাবছিল বোধহয় নতুন কোনও অভিনেত্রী হবে। এতে আমাদের শুটিং-এর বেশ সুবিধে হয়ে গিয়েছিল।
বুঝলাম! কিন্তু এখনকার বলিউডের বাজারে ছবির কাজ জলদি শেষ করাটাই নিয়ম। খরচ বাঁচে। কিন্তু আপনি প্রায় দুবছর পর ছবির কাজ শেষ করলেন, কারণটা কী?
কারণ অনেক। কখনও বৃষ্টি ভিলেন। কখনও দার্জিলিং-এর ক্রাউড। কখনও ভূমিকম্প। কখনও ডেট প্রবলেম। কত বলব? শুনলে হাসি পাবে তোমাদের, আমরা উটিতে শুটিং করবার প্ল্যান করলাম যখন, তখন খটখটে রোদ্দুর। শুটিং শুরু হওয়ার ঠিক আধঘণ্টা আগে থেকে তুমুল বৃষ্টি! পাততাড়ি গুটিয়ে ফেলে আবার শিডিউল ঠিক করতে হল। কলকাতায় অবশ্য তেমন কোনও প্রবলেম হয়নি। কিন্তু দার্জিলিং, ওরে বাবা! কোন এক লোক্যাল নিউজপেপারে বেরিয়ে গিয়েছিল এই শুটিং-এর কথা! ব্যস, কোথা থেকে পিলপিল করে লোক আসতে শুরু করল। গাড়ি করে দূর থেকেও নেহাত কম লোক আসেনি। সবাই একবার রণবীরকে ছুঁয়ে দেখতে, অটোগ্রাফ নিতে চায়। এত ক্রাউড সামলানোর ইনফ্রাস্ট্রাকচারও ছিল না আমাদের। শুটিং পন্ড হতে খুব হতাশ হয়েছিলাম!
আর ডেট প্রবলেম? সত্যিই কি রণবীর প্রিয়ঙ্কার ডেট একসঙ্গে পাওয়া যাচ্ছিল না, নাকি অন্য কিছু!
ওদের দু`জনের হাতেই অনেক ছবি। শুটিং কোনও কারণে না হলে আবার দুজনকে একসঙ্গে পাওয়া বেশ টাফ। মনোমালিন্যের প্রশ্নই ওঠে না। সত্যি বলতে কী, দুবছর ধরে বরফি বানানোর জন্য বেশ ভাল করে জ্বাল দিয়েছি দুধে। সন্দেশ বানানোর সময়ে দেখেননি, কত গাঢ় করে দুধ ফোটাতে হয়? বহু দিন ধরে, বহু ধৈর্য ধরে দুধে জ্বাল দিয়েছি। ময়রা হিসেবে জানি, আমার বরফিটা খাঁটি কড়াপাকের। ভেজাল নেই। মিষ্টি হবেই!
বাহ্, বেশ ভালই বললে তো কথাটা!
কড়াপাকের বরফি খেতে ভালই হয়, বন্ধু।
তোমার এই ছবিতে আমরা নতুন নতুন প্রপস দেখছি। মুখোশ, খাঁচায় সাদা ইঁদুর, পাখি...
জঁর হিসেবে বরফি আমার আগের ছবিগুলোর চেয়ে আলাদা। ঠিক করেছিলাম এমন ছবি বানাবো, যা দেখে আমার দুই বাচ্চা মেয়েও এনজয় করে! অ্যাট দিস পয়েন্ট অফ মাই কেরিয়ার, আই নিড টপ ডেলিভার দ্য বেস্ট। আমার বড় মেয়ে ঈশানার নামে প্রোডাকশন হাউজ বলে কথা! অন্তত আমার পুঁচকে মেয়ে যাতে হাততালি দিয়ে বলে, বাবা, এক্সেলেন্ট মুভি! খারাপ ছবি বানালে বড় হয়ে এই মেয়েই বলবে, বাবা, তুমি আমার নাম ইউজ করে বদনাম করে দিলে!
তোমার ছবিতে নয়া আমদানি ইলিয়ানা। এর আগেও বলিউডে মল্লিকা শেরাওয়াত, কঙ্গনা রানাওয়াতদের উপহার দিয়েছ তুমি...
ইলিয়ানা ডি`ক্রুজ কে সারপ্রাইজ আইটেম বলতে পারো। আমাদের এক কমন ফ্রেন্ডের মারফত আলাপ। দেখে মাথাতেও আসেনি কাস্টিং করার ব্যাপারটা। গল্প করতে করতে হঠাত্ মনে হল, মেয়েটার একটু-আধটু মেক-ওভার করলে একদম ক্যারেক্টারে ফিট করে যাবে। ওর কথাবার্তা, রুচির মধ্যে একটা বাঙালি-বাঙালি এস্থেটিকস আছে। লুক টেস্ট ওকে হয়ে গেল।
রণবীরকেও আমরা যেভাবে স্ক্রিনে দেখে অভ্যস্ত, তার সঙ্গে মেলাতে পারছি না! চরিত্রটা ওর ভেতরে ঢুকিয়ে দিতে কতটা শ্রম দিতে হয়েছে?
আমি প্রথমে স্ক্রিপ্টটা লিখেছিলাম মাত্র দশ পাতার। সেটা নিয়েই দেখা করতে গেলাম রণবীরের সঙ্গে। আগে ততটা আলাপ ছিল না। তবে রণবীর হচ্ছে নিউ জেনারেশনের সবচেয়ে প্রতিভাবান অভিনেতা। কখনও নিজেকে ম্যানারিজমে আটকে রাখে না। ওয়েক আপ সিড কিংবা রকেট সিং-এর চরিত্রটা দেখো, কিছুতেই মেলাতেই পারবে না অন্জানা-অনজানি বা রকস্টার-এর রণবীরের সঙ্গে। চরিত্র নিয়ে ও যতদূর চিন্তা করতে পারে, অনেক অভিনেতা সেখানে পৌঁছতেই পারবে না! আর অন-স্ক্রিন প্রেজেন্স, ডিকশন আর এক্সপ্রেশন নিয়ে জাস্ট কোনও কথাই হবে না! যাই হোক, দশ পাতার স্ক্রিপ্টটাই ও খুব মন দিয়ে শুনল। সেদিন ওর বডি ল্যাঙ্গোয়েজ দেখে আমিও কনফিডেন্স পেয়ে গিয়েছিলাম। ছবি করলে, রণবীরকেই লিড করব। বিলিভ মি, ও না বললে ছবিটা করতামই না। দুদিন বাদে রণবীর ফোন করে বলল, দাদা আমি রোলটা করতে চাই। ব্যস, নো লুকিং ব্যাক!
কাইটস-এ হৃতিক রোশনের সঙ্গে বারবারা মোরির লভ স্টোরি নিয়ে বাজার গরম ছিল। রণবীর-প্রিয়ঙ্কার ব্যাপারে আমি কি কিছু মিস করে গেছি?
(হাসি) কিচ্ছু মিস করোনি। আরে বাবা, ওদের পুরোটাই অন-স্ক্রিন রোম্যান্স। অফ স্ক্রিনে যে যার বাড়ি। শুটিং বার বার ক্যানসেল হওয়ায় কাজের চাপ এত বেশি ছিল যে, অফ স্ক্রিন আমরা কেউ কিচ্ছু ভাবার টাইম পাইনি। অন গড! তবে একটা বিশেষ এক্সপিরিয়েন্স হল এই শুটিং শেষ করে। আমার আর সব ছবির ফাইন্যাল প্যাক-আপ ডিক্লেয়ার করার পর ছবির কলাকুশলীদের মধ্যে উল্লাস আর স্বস্তির নিঃশ্বাস পড়ে! সবাই বলে, এবার বাড়ি গিয়ে ঘুম দেব, বেড়াতে যাব, পাব বা ডিস্কে যাওয়ার প্ল্যান করতে শুরু করে সব্বাই। কিন্তু বরফি-র শেষ দিন শুটিং-এ যখন চেঁচিয়ে বললাম- প্যাক আপ! দেখি সবাই কেমন নিঃঝুম। দেখি, অনেকেরই চোখে জল। আমিও ঝাপসা দেখতে শুরু করলাম। আসলে এত দিন ধরে ছবিটার সঙ্গে সবার একটা আত্মীয়তা তৈরি হয়ে গিয়েছিল।