শান্তির রাজনীতি ও রাজনীতির শান্তি: নোবেলের নেপথ্যেও ক্ষমতার জোর?
ঊষসী মুখোপাধ্যায়
ঊষসী মুখোপাধ্যায়
মহাত্মা গান্ধী শান্তিতে নোবেল পাননি। খানিক হা-পিত্যেশ করেই ২০০৬ সালে তত্কালীন নরওয়ে নোবেল ইনস্টিটিউটের ডিরেক্টর গের লুন্দেস্তাদ বলেছিলেন, নোবেলের ইতিহাসে এটাই সবচেয়ে বড় ভুল! গান্ধী পাঁচবার শান্তি-স্বীকৃতির জন্য মনোনীত হয়েছিলেন। ১৯৩৭, ১৯৩৮, ১৯৩৯, ১৯৪৭ এবং মৃত্যুর ঠিক আগে ১৯৪৮ সালে। কিন্তু না, নোবেল কমিটি ব্রিটিশরাজের বিপক্ষে দাঁড়াতে পারেনি। নোবেল ফাউন্ডেশন মরণোত্তর পুরস্কার না-দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় ১৯৭৫ সালে, গান্ধীর মৃত্যুর ২৬ বছর পরে! মাঝের সময়টায় ভুল শুধরে নেওয়ার সুযোগও ছিল। কিন্তু না, নোবেল তাঁকে দেওয়া হয়নি। এই 'ভুল' যে আসলে অদ্যন্ত রাজনৈতিক, তা নিয়ে আজ প্রশ্নের অবকাশ নেই।
আজ এত কথা বলছি, নোবেল-মনোনয়নে আরও একটি 'রাজনৈতিক' ঘটনাকে কেন্দ্র করে। আমেরিকায় ভোটের দু’মাস আগে বিশ্বশান্তির দূত হিসেবে নোবেল শান্তি পুরস্কারে মনোনীত হয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প! তাঁর নাম প্রস্তাব করেছেন অতি-দক্ষিণপন্থী নরওয়ে পার্লামেন্টের সদস্য ক্রিশ্চিয়ান টাইব্রিং-গেড্ডে।
মহামারীতে জর্জরিত এই অন্ধকার পৃথিবীতে আচমকা কী এমন আশার আলো দেখালেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট? যে প্রেসিডেন্ট চিনকে জব্দ করতে এই টালমাটাল সময়ে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার অনুদান বন্ধ করে দেন, যে প্রেসিডেন্ট মানুষের আগে বাজার অর্থনীতিকে এগিয়ে রেখে লকডাউনের বিরোধিতা করেন! এই সেই প্রেসিডেন্ট, যিনি দুই দেশের মাঝখানে দেওয়াল তুলে দেওয়ার প্রতিশ্রুতিকে প্রোগ্রেসিভ মনে করেন! টুইট-যুদ্ধে যিনি উত্তর কোরিয়ার সর্বাধিনায়ককে পরমাণু অস্ত্রের ক্ষমতার কথা মনে করিয়ে দেন! যিনি শরণার্থী পরিবারের দুধের শিশুকে মা-বাবার থেকে আলাদা বন্দি করে রাখার নিদান দেন, বিশ্বশান্তিতে কী অবদান তাঁর? গেড্ডে (যিনি নেটোয় নরওয়ের প্রতিনিধি দলের চেয়ারম্যানও!) বলছেন, ইজরায়েল ও সংযুক্ত আরব আমিরশাহির কূটনৈতিক বন্ধন পশ্চিম এশিয়ার ইতিহাসে বৈপ্লবিক। দুই দেশের মধ্যস্থতাকারী হিসাবে কাজ করার জন্য নোবেল পেতেই পারেন ট্রাম্প! সেই প্রস্তাবের চিঠিতে কাশ্মীর ইস্যু নিয়ে ট্রাম্পের ভারত-পাকিস্তানের মধ্যস্থতা করতে চাওয়ার উল্লেখও করা হয়েছে! অন্য রাষ্ট্রের বিষয়ে অবাঞ্ছিত নাক গলানোর এই ঔদ্ধত্যকে সোজাসাপ্টা শান্তির চেষ্টা বলেই ধরে নেওয়া হচ্ছে কেন?
যদিও এটা ট্রাম্পের প্রথম মনোনয়ন নয়। এর আগেও গেড্ডে এবং নরওয়ের আর একমেম্বার অফ পার্লামেন্ট যৌথভাবে ট্রাম্পকে শান্তি-স্বীকৃতির জন্য বেছে নিয়েছিলেন। ২০২১ সালের লক্ষ্যে এটা ট্রাম্পের দ্বিতীয় মনোনয়ন। গেড্ডের প্রস্তাবের দু’দিন পরে সুইডিশ পার্লামেন্টের সদস্য ম্যাগনাস ইয়াকোবসনও সার্বিয়া-কসভো শান্তিচুক্তির জন্য মার্কিন প্রেসিডেন্টের নাম শান্তি পুরস্কারের জন্য পাঠিয়েছেন।
গান্ধী পাননি। কিন্তু ভোটের মুখে ট্রাম্প বিশ্বশান্তির ইতিহাসে নাম তুলে ফেললেও ফেলতে পারেন! আর সেই সম্ভাবনা থেকেই বিশ্বজুড়ে শুরু হয়েছে তুমুল এক বিতর্ক: শান্তি নোবেল কি এবার বন্ধ করে দেওয়া উচিত?
এই প্রশ্নের কারণ একা ট্রাম্প নন। কারণটা যুক্তি, অতীতচারণের।
শান্তি এবং অশান্তি এই দুটো ধারণাই রাষ্ট্রশক্তির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। বিশ্বশান্তি একটি রাজনৈতিক ধারণা। যে ধারণা কখনও একপক্ষের বয়ানের উপর নির্ভরশীল নয়। বারাক ওবামা থেকে আন সাং সুচি, বিতর্কিত বহু রাজনীতিক এই পুরস্কার প্রাপ্তির পর এমন অনেক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যা 'শান্তি'র বার্তা থেকে শতহস্ত দূরে। সুচি-র জমানায় যেমন রোহিঙ্গা সমস্যা বিশ্বে তোলপাড় ফেলেছে, তেমনই ওবামার নেতৃত্বেই পশ্চিম এশিয়ায় যুদ্ধ করেছে আমেরিকা। ওবামাকে নোবেল দেওয়ার সিদ্ধান্তে পরবর্তী কালে ঢোঁক গিলতে বাধ্য হয়েছে নোবেল কমিটির প্রধান! ইতিহাস বলছে, বিশ্বের সবচেয়ে বিতর্কিত কিছু স্বীকৃতি নোবেল
শান্তি পুরস্কারের হাত ধরেই এসেছে। ট্রাম্প নিজেই বলেছেন, তাঁর ৪ পূর্বসূরির মতো তিনিও 'বহু ভালো কাজ করেছেন' এবং নোবেলের যোগ্য হকদার! তবে ট্রাম্পের মনোনয়নে যে 'বিভ্রান্তি' আছেই, ঠারেঠোরে বুঝিয়ে দিয়েছেন প্রস্তাবক গেড্ডে। বলেছেন, 'কমিটির উচিত স্রেফ তথ্যের ভিত্তিতে ট্রাম্পের বিচার করা, তাঁর আচরণের ভিত্তিতে নয়!'
এ-প্রসঙ্গে বলে রাখা ভালো, ১৯৩৯ সালে অ্যাডল্ফ হিটলার শান্তি নোবেলের জন্য মনোনীত হয়েছিলেন। সুইডিশ পার্লামেন্টের এক সদস্য সম্ভবত ব্যাঙ্গ করেই সেই প্রস্তাব দিয়েছিলেন, কিন্তু সেই ব্যঙ্গ-তত্ত্ব সঠিক কিনা তা জানা যায় না। সেই ঘটনার কয়েকবছর পরে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইতি টানার স্বীকৃতি স্বরূপ নোবেল শান্তি পুরস্কারে মনোনীত হন জোসেফ স্তালিনও। একবার নয়, স্তালিনের নাম প্রস্তাব হয়েছিল দু'বার। ১৯৪৫ এবং ১৯৪৮ সালে!
নোবেল কমিটির কিছু ছকভাঙা সিদ্ধান্তেও রাজনীতির চড়া রং লেগেছে। চিনা সমাজকর্মী লিউ জিয়াবো ২০১০ সালে যখন শান্তি-স্বীকৃতি পাচ্ছেন, তখন তিনি জেলে বন্দি, তাঁর রাজনৈতিক অধিকারটুকুও দু’বছরের জন্য ছিনিয়ে নিয়েছে চিন সরকার! ১৯৯১ সালে মায়ানমারের আন সাং সুচি-ও বন্দি অবস্থাতেই নোবেল পেয়েছেন। ১৯৩৫ সালে জার্মান সাংবাদিক ও রাজনৈতিক কর্মী কার্ল ভন ওসিটক্সিকে শান্তি পুরস্কার দেওয়া হয় জেলবন্দি থাকাকালীনই। পশ্চিমি দুনিয়া এঁদের শান্তির দূত মনে করলেও রাজনৈতিক কারণেই রাষ্ট্রনায়করা তাঁদের ‘ক্ষতিকর’ মনে করেছেন!
বহু বিতর্ক, বহু অভিযোগ। তবে এই কয়েনের উল্টোপিঠও তো আছে!
১৯৬০ সাল পর্যন্ত বেছে বেছে ইউরোপীয় এবং আমেরিকানদেরই মূলত শান্তি পুরস্কার দেওয়ার চল ছিল। পরবর্তী কালে সেই প্রবণতা দৃশ্যতই ভেঙেছে। তালিবানের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে মাথায় গুলি খাওয়া একরত্তি মালালা ইউসুফজাই থেকে সমাজকর্মী কৈলাস সত্যার্থী, পরমাণু অস্ত্র বিরোধী সংগঠন থেকে আন্তর্জাতিক রেড ক্রস, মার্টিন লুথার কিং, নেলসন ম্যান্ডেলা, মাদার টেরেজা, রাষ্ট্রসঙ্ঘের শরণার্থী পরিষদের মতো স্বীকৃতি
মানবতাকে অগ্রাধিকার দিয়েছে। চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, মানবতার কষ্টিপাথরই বিশ্বশান্তির প্রধান মাপকাঠি। তবুও স্বীকৃতির উপর রাজনীতির প্রভাব অস্বীকার করা যায়নি।
৮ অক্টোবর ট্রাম্প যদি এই স্বীকৃতি পান, তাহলে ইজরায়েল ও তার পড়শিদের মধ্যে শান্তিরক্ষার চেষ্টা করা চতুর্থ নোবেল প্রাপক হবেন! ট্রাম্পের পুরস্কারের হাত ধরে, অঙ্কের হিসেবে বিশ্বজুড়ে দুঃস্থের পাশে দাঁড়ানো রেড ক্রসের স্বীকৃতি-সংখ্যার (৩) থেকে আরব-ইজরায়েল মধ্যস্থতার 'চেষ্টা'র জন্য দেওয়া স্বীকৃতির সংখ্যা বেড়ে যাবে।
তবুও ইজরায়েলের সঙ্গে তার পাড়াপড়শির বিবাদ মিটবে কি?
রাজনীতি, প্রভাব এবং স্বীকৃতি। এই তিনের টানাপোড়েনের কথা যতবারই ঘুরে ফিরে আসে, ততবারই ভেসে আসে নোবেলের ইতিহাসে থাকা সবচেয়ে ব্যতিক্রমী নামটা!
স্বীকৃতি নেওয়া মানেই প্রাতিষ্ঠানিকতার 'কাছের মানুষ' হয়ে যাওয়া, সেই কবেই বলে গিয়েছেন জঁ পল সাঁত্র (উচ্চারণভেদে সার্ত্রে)। ১৯৬৪ সালে যে ফরাসি ঔপন্যাসিক-দার্শনিক হেলায় প্রত্যাখ্যান করেছেন নোবেলের স্বীকৃতি! সাহিত্যের নোবেল ফিরিয়ে যিনি শিখিয়ে গিয়েছেন, স্বীকৃতি যতই বড় হোক না কেন, প্রতিষ্ঠান তার থেকেও বড়!
আরও পড়ুন- নেহরু থেকে মোদী- গোড়াতেই গলদ! কাশ্মীরের বদলা তিব্বতে নিলে জব্দ হত চিন