বাঁকুড়ায় এ বার বিরসার প্রকৃত মূর্তি স্থাপনের ঘোষণা তৃণমূলের
পুয়াবাগানে তৃণমূল-বিজেপি; অমিত-দিলীপ-শ্যামল-সুভাষ নিমিত্ত মাত্র! সেখানে শুধুই হাসে অন্তর্যামী!
নিজস্ব প্রতিবেদন: সাকার-নিরাকার বিরোধ ধর্মের ক্ষেত্রেই খুব প্রমিনেন্ট বলে দেখা গিয়েছে। কিন্তু স্বপ্নেও কখনও এটা বোধ হয় ভাবা যায়নি যে, রাজনীতির ক্ষেত্রেও একটু অন্যরকম ভাবে এই সাকার-নিরাকার ডাইকটোমি ছায়া ফেলে যাবে, আর সঙ্গে জুড়ে যাবে আইকনক্ল্যাজম!
যা স-আকার, মানে, যার আকার আছে, সেটাই তো মূর্তি ধরে। কিন্তু যখন সেই মূর্তি নিয়েই দ্বিধাদ্বন্দ্ব-ভালোমন্দের আবহ তৈরি হয়ে ওঠে এবং মূর্তিটি ক্রমশ 'নেই' হয়ে যেতে থাকে তখন বিষয়টি পরোক্ষ ভাবে ক্রমশ নিরাকারত্বের দিকেই পাশ ফিরে যায়। এবং তখন সাকার-নিরাকার অক্ষ-কোটি সংঘাত বড় হয়ে ওঠে। সেই লগ্নে মনে হওয়া অস্বাভাবিক নয়-- ভাঙ রে, ভাঙ রে, ভাঙ! পাথর ভাঙ! ভেঙে খান খান হোক মূর্তি। অর্থাৎ, সাকার-নিরাকার থেকে ক্রমে আইকনক্ল্যাজমের দিকে পাড়ি।
কেন এই তত্ত্বকথা? আসলে স্বয়ং বিরসা মুন্ডা এই তত্ত্ব আলোচনার ক্ষেত্র প্রস্তুত করে দিয়েছেন।
ক'দিন আগে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বাঁকুড়া সফরে গিয়ে আদিবাসীদের মহান নেতা বিরসা মুন্ডাকে শ্রদ্ধা জানান। তাঁর শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের কিছু পরেই যে মূর্তিতে তিনি শ্রদ্ধা জানিয়েছেন, সেটি বিরসা মুন্ডার নাকি তা আদিবাসী সম্প্রদায়ের কোনও শিকারির প্রতীকী মূর্তি, এই নিয়ে শাসক ও বিরোধী দু'দলের মধ্যে তরজা শুরু হয়।
তরজাটি মজার। তৃণমূল বলছে, ওই মূর্তিটি বিরসার নয়। দিলীপ ঘোষ শুনে অম্লানবদনে বলে দিয়েছেন, যদি তা না-ও হয়, তবু আজ থেকে (মানে, যেদিন অমিত শাহ ওই মূর্তিতে মালা দিলেন, সেদিন থেকে) মূর্তিটি পৃথিবীতে বিরসার বলেই স্বীকৃতি পাবে, কেননা ওতে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন স্বয়ং অমিত শাহ!
বিরসা ভগবান নিশ্চয়ই অলক্ষ্যে থেকে হাসছেন এ সব দেখে। কেননা, তিনি দেখছেন, ক্ষণে-ক্ষণেই তিনি 'আছে-নেই'এর দ্বন্দ্বে উধাও হচ্ছেন আর ফিরে আসছেন। মূর্তি আছে বলে তিনি 'সাকার', আবার প্রকৃত মূর্তি নেই বলে পর মুহূর্তেই 'নিরাকার'। ক্ষণে-ক্ষণেই মূর্তি গড়ে ওঠা ও ভেঙে যাওয়ার এই আশ্চর্য পলিটিক্যাল রোলার-কোস্টারে চেপে তাঁর পবিত্র অস্তিত্বটাই তো স্রেফ আইডিয়ায় পর্যবসিত হয়ে পড়ছে!
বাঁকুড়া থেকে অমিত শাহ বিদায় নিতেই পরের দিন ওই বিতর্কিত মূর্তিস্থলে হাজির হয়ে মূর্তিটি বিরসা মুন্ডার নয় বরং তা এক আদিবাসী শিকারির প্রতীকী মূর্তি দাবি করে মূর্তিটির শুদ্ধকরণ করেন স্থানীয় তৃণমূল নেতৃত্ব ও একাধিক আদিবাসী সংগঠনের প্রতিনিধিরা।
ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই (গতকাল বিরসা মুন্ডার জন্মদিনে) ফের পুয়াবাগানে হাজির হয়ে মূর্তিটির নতুন করে শুদ্ধকরণ করেন আদিবাসীদের একটি অংশ। ওই মূর্তি আসলে বিরসারই দাবি করে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধাও জানান তাঁরা। অনুষ্ঠানে হাজির থেকে মূর্তিতে ফুল দিয়ে বিরসার প্রতি শ্রদ্ধা জানান বাঁকুড়ার বিজেপি সাংসদ সুভাষ সরকার।
সেই ঘটনার ২৪ ঘণ্টা কাটতে না কাটতেই আবার মূর্তি প্রসঙ্গে রাস্তায় নামতে দেখা গেল তৃণমূল ও বেশ কয়েকটি আদিবাসী সংগঠনের কর্মীদের। আজ, সোমবার পঞ্চায়েত দফতরের রাষ্ট্রমন্ত্রী তথা তৃণমূলের বাঁকুড়া জেলা সভাপতি শ্যামল সাঁতরার নেতৃত্বে পুয়াবাগানে যান তৃণমূল নেতাদের একাংশ ও আদিবাসী সংগঠনগুলির কর্মীরা। এ দিন তাঁরা ওই এলাকায় (তাঁদের দাবিমতো) শিকারির মূর্তির পাশেই বিরসার বিশালাকার এক মূর্তি স্থাপনের জন্য স্থান নির্বাচন করেন। সেখানে তাঁদের দাবি, শিকারির মূর্তিকে মালা দিয়ে আদিবাসীদের ভগবান বিরসা মুন্ডাকে আসলে অসম্মান করেছে বিজেপি। তাই বিরসার মূর্তি আসলে কেমন, তা বিজেপি নেতাদের দেখানোর জন্য ওখানে প্রকৃত মূর্তি স্থাপনের উদ্যোগ।
এ দিকে বিষয়টি নিয়ে চুপ করে থাকেনি বিজেপিও। তৃণমূল আদিবাসীদের প্রতি যে বঞ্চনা করেছে সেই পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতেই তারা এই কান্ড করছে বলে কটাক্ষ করেছেন বাঁকুড়ার বিজেপি সাংসদ সুভাষ সরকার।
কিন্তু কেন এই মূর্তি-কনফ্লিক্ট?
কেন আবার? আর কয়েক মাস পরেই রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন। বিরসা মুন্ডার মূর্তি-বিতর্ক জিইয়ে রেখে দু'পক্ষই আদিবাসী ভোট-ব্যাঙ্ককে নিজেদের পক্ষে টানার চেষ্টা করছে। অন্তত তেমনটাই তো মনে করছে সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক মহল।
তা হলে কী দাঁড়াল? মূর্তি আছে, না নেই, তা ওরিজিনাল না নকল-- এ সব নিয়ে ঘোর ধুন্ধুমারের মাঝে একটাই সত্য উঁকি দিল-- বাঙালি শেষ পর্যন্ত আইকনক্লাস্ট। তার নামে যত দুর্নামই দাও, সে কিন্তু একটা একটা ধাঁচায় আটকে থাকার বান্দা নয়। সে মুহূর্তে মুহূর্তে নিজেকে গড়ে, ভাঙে, আবার গড়ে আবার ভাঙে। সেখানে তৃণমূল-বিজেপি, অমিত-দিলীপ-শ্যামল-সুভাষ নিমিত্ত মাত্র! সেখানে শুধুই হাসে অন্তর্যামী!
আরও পড়ুন: দাদা নেই! ভাইফোঁটার দিনে তাই বিষণ্ণ শহিদ রাজেশের বোন শকুন্তলা