যারা বীরুকে সম্মান দিলেন, ঈশ্বর তাঁদের ক্ষমা করুন
স্বরূপ দত্ত
আজ বীরেন্দ্র সেহবাগের অনুরাগীদের খানিকটা জ্বালা কমলো। দেরীতে হলেও নিজেদের ভুল শুধরে নিল বিসিসিআই। দিল্লিতে ভারত-দক্ষিণ আফ্রিকা শেষ টেস্টের শুরুর দিন। ঘটা করে তাঁকে
দেওয়া হল সংবর্ধনা। ফিরোজ শাহ কোটলায় তাঁর নামে স্ট্যান্ড হবে।
বীরেন্দ্র সেহবাগও আজ তাঁর পরিবারের মানুষগুলোকে সঙ্গে নিয়ে হাসিহাসি মুখে মাঠ ঘুরলেন। স্মারক নিলেন। ভালো ভালো কথা শুনলেন। এবং নিজে বললেন। তাঁর স্ত্রী গর্বিত হলেন। তাঁর
ছেলেরা বোঝার চেষ্টা করলেন, তাঁদের বাবা কত বড়!
দেশ-বিদেশ জুড়ে থাকা অগণিত বীরুভক্ত মনে মনে ভাবলেন, যাক সেহবাগকে অন্তত একটু সম্মান জানানো হল।
বীরুর পরিবারের লোকেরা ভাবলেন, যাক, যার শেষ ভাল, তার সব ভালো।
বীরুর মা কৃষ্ণা সেহবাগ ভাবলেন, হ্যাঁ, আমি আজ সত্যিই রত্নগর্ভা।
বীরুর স্ত্রী আরতী সেহবাগ ভাবলেন, ঈশ্বরকে বলি, প্রতি জীবনে যেন আমার স্বামী হিসেবে নজফগড়ের নবাবকেই পাই।
বীরুর দুই ছেলে আর্যবীর এবং বেদান্ত ভাবল, আমাদের, বাবার মতোই হতে হবে। সম্মান টস্মান তো আছেই। বাবা তো আজ নিজেই কথা দিয়েছে, বাবার রেকর্ড ভাঙতে পারলে, আমাদের
ফেরারি গাড়ি দেওয়া হবে। বাবা নিজেই দেবে।
আর বিসিসিআই কর্তারা বিশেষ করে এই অনুরাগ ঠাকুরের মতো সুদর্শন, বুদ্ধিমান, মানুষেরা হাতটা কচলাতে কচলাতে বাড়ি যেতে যেতে ভাবলেন, কী বোকা এরা। আমাদের গালাগাল করছিল,
দলে নিইনি বলে। আজ একটু সংবর্ধনা দিয়ে দিলাম, ব্যাটারা সব ভুলে গেল। ভালো হয়েছে, যেটা ব্যাটে আর মুখে বেশি কথা বলতো, সেটা একেবারে বিদায় নিয়েছে, নিজে থেকেই। আর আজ
তো আমরা একেবারে 'বরণ করে বিদায়' করেছি। আর নিন্দেও করতে পারবে না আমাদের।
ভাবছিলাম। অনেকক্ষণ ধরে ভাবছিলাম। বোঝার চেষ্টা করছিলাম, বীরুর মনটার মধ্যে কী হতে চলেছে। কী ঝড় বইছে। আজ কেন কলকাতার আকাশ কালো। কেন এত ঝোড়ো হাওয়া। শুধু
ভাবছিলাম। মনটা কিছুতেই মানছিল না, বীরু কেন ধোনির নামটা উচ্চারণ না করে, তাঁকেই মনে মনে দোষ দেবেন। আজ যদি ধোনিও কর্তা হতেন? তিনিও যদি অনুরাগ ঠাকুরদের মতো
ব্লেজার পরে বীরুর দিতে হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে বলতেন, তুমি দারুণ ক্রিকেটার ছিলে, বীরুর রাগ গলে তো জলই হয়ে যেত।
ঠিকঠাকভাবে গুছিয়ে বললে, এটাই বলতে চাইছি যে, আজ বীরু গেলেন কেন!
আজ বীরু বললেন না কেন, না, আমার নামে কোনও স্ট্যান্ড দরকার নেই। বীরেন্দ্র সেহবাগ এই নামটাই একটা 'স্ট্যান্ড' এটা এই লোকগুলোর বোঝা উচিত। এই লোকগুলো আসলে হাতে ৫ ফুট
লম্বা মাপার ফিতে নিয়ে বেরিয়েছে। এরা এভারেষ্টটা মাপতে পারবে না।
কত বল মাঠের বাইরে ফেলে দিয়েছেন অবলীলায়। তাহলে আজ কেন কটা অযাচিত উপহার উড়িয়ে দিতে পারলেন না অফ স্ট্যাম্পের উপর থেকে!
অবাক হলাম। এবং উত্তরও পেলাম। বীরেন্দ্র সেহবাগরা সব পারার জন্য এই পৃথিবীতে আসেন না। ভাল ক্রিকেট খেলবেন। ভদ্রসভ্য দেখতেও লাগবে। আবার ভালো ভালো কথা বলে মানুষের
সঙ্গে মেলামেশা করবেন আর জীবনে এগিয়ে যাবেন, এমনটা হওয়ার নয়। এটা পৃথিবীর নিয়ম। এটা বীরেন্দ্র সেহবাগের জন্যও প্রকৃতিও ব্যাতিক্রমী করেনি।
আর এখানেই মোক্ষম প্রশ্ন। প্রকৃতি করেনি। কিন্তু আমরা তো মানুষ। এই গ্রহের সবথেকে উন্নত প্রাণী। তার উপর আমরা আবার ভারতীয়। আমাদের থেকে নাকি অনেক কিছু শেখার গোটা
দুনিয়ার। কিন্তু শুনতে যেমন খুশি লাগুক, এটাই সত্যি যে, অন্তত ক্রীড়াক্ষেত্র আমাদের দেশের মানুষকে অনেক কিছু শিখতে হবে। অনেক কিছু। এ শেখার শেষ নেই।
কেন? কারণ, আমরা ক্রীড়াক্ষেত্রে সম্মান জানাতে পারিই না। একটা লোকের পরিচিতি তো ক্রিকেট খেলে। তাহলে তাঁর ক্রিকেট ছাড়ার পর কেন তাঁকে সম্মান জানানো? সংবর্ধনা দেওয়া? বীরেন্দ্র
সেহবাগকে সম্মান জানাতে হলে একটা স্ট্যান্ডের নাম কেন? একটা আস্ত স্টেডিয়ামের নামটাই তাঁর নামে করে দিলে হয় না কেন? করতে হয় অনেক কিছু। এই অনেক কিছুর মাপটারই কোনও
ধারণা নেই বাকিদের। তা সম্মানটা দেবে কীভাবে!
একটা উদাহরণ আজ বড় প্রাসঙ্গিক মনে হচ্ছে। বলি। আচ্ছা, আপনারা নিয়মিত বিশ্বফুটবল দেখেন নিশ্চয়ই। খুব পছন্দ করেন। এবং স্পেন যে ফুটবলটা একটু পছন্দ টছন্দ করে এটা মানবেন
নিশ্চয়ই।
স্পেনের ফুটবলাররাই শুধু ভাল বা, ও দেশের ক্লাব ফুটবলে মেসি, রোনাল্ডোরা খেলেন বলেই স্প্যানিশ লিগটা সেরা এটা এক্কেবারে ঠিক। বরাবরই এমন হত। বার্সা এবং রিয়েল মাদ্র্রিদ ফুটবল
দুনিয়ার সেরা ফুটবলারদেরই খেলাতো।
বার্সার খেলা যখন হয়, মনে হয় নিশ্চয়ই ভাবেন, ইস ওই গ্যালারিতে বসে যদি খেলা দেখতে পারতাম। প্রসঙ্গত বলা, বার্সার নিজের মাঠ ক্যাম্প ন্যুতে কত লোক ধরে মানে ক্যাপাসিটি কত
জানা আছে? এখন সংখ্যাটা ৯৯ হাজারের সামান্য বেশি। ১৯৫৭ থেকেই এই স্টেডিয়ামের দর্শকাসন ৯৩ হাজারের বেশি। কিন্তু বরাবর এমনটা ছিল না। বার্সার এই ক্যাম্প ন্যু স্টেডিয়ামটা তৈরি
হয়েছে ১৯৫৭ সালে। তার আগে তা হলে বার্সা কোন মাঠে খেলতো? খেলতো তাদের আগের স্টেডিয়াম ক্যাম্প দে লেস কোর্টসে। এবং সেই স্টেডিয়ামে খুব গাদাগাদি করেও ৬০ হাজার লোক
বসতে পারতেন। তাতে অসুবিধা কিছু হচ্ছিল না সেই যুগে। কিন্তু গোল বেধেছিল। কেন? বলছি।
হাঙ্গেরির এক ফুটবলারের জন্য। ভদ্রলোকের নাম লাজলো কুবালা।
কে এই কুবালা? মারাদোনাও নন, পেলেও নন, রোনাল্ডো, মেসি, জিদান, কেউ নন। আসলে একটু বেশিই বোধহয়। কেন?
১৯২৭ সালে জন্মেছিলেন হাঙ্গেরির বুদাপেস্টে। আসলে মা ছিলেন হাঙ্গেরির মানুষ। বাবা আবার পোলিশ-স্লোভাক। ফুটবলটা খেলতেন কুবালা ছেলেবেলা থেকেই। তাঁর জীবনে অনেক কষ্ট। তখনও
যে পৃথিবীটা গজরাচ্ছিল। সমাজতন্ত্র। আমেরিকা, রাশিয়া, জার্মানি, জাপান, রাষ্ট্রনেতারা, যুদ্ধ, অস্ত্র, ট্যাঙ্ক, সৈন্য, আর আহত, নিহত, এই তো ছিল চারটি শব্দ। এই দিয়েই যে গোটা পৃথিবীটা
চলছিল। তাই কুবালাকেও কোনও সময় হয়ে যেতে হয়েছিল রিফিউজি। পুরো গল্প অন্যদিন বলব। আজ যেটুকু দরকার সেটাই। তো একদিন কুবালা একটি ম্যাচকে বেছে নিয়েছিলেন, নিজে একটু
বাঁচার জন্য। 'স্বাধীন' হয়ে বাঁচার জন্য। তাই রিফিউজি একাদশের হয়েই মাঠে নেমেছিলেন এসপ্যানোয়েলের বিরুদ্ধে। কিছু নয়, ওই ম্যাচে শুধু নিজের জাত চেনাতে ৪ টে গোল করেছিলেন। মাঠে
উপস্থিত ছিলেন তখনকার বার্সেলোনা চেয়ারম্যান অগাস্ত মন্তাল গালোবার্ট। দেরী করেননি একটুও। জমিদারের মতো নায়েব মশাইকে ডেকে বলেছিলেন, ও হে কে আছো, এই ছেলেটাকে এখনই
বার্সায় সই করাও। বাকিটা ইতিহাস। যে কুবালা আজ ইতালি, কাল স্পেন, পরশু হাঙ্গেরি ঘুরতে ঘুরতে হয়ে গিয়েছিলেন রিফিউজি, সেই কুবালা হলেন বার্সার নয়নের মণি। তাই ট্রফি জিতলেন
১৪ টা! একাই শুরু করলেন লাল-নীল জার্সিতে ফুল ফোটানে। বিশ্বে চলছে গোলা-গুলি, কুবালা করছেন গোল, গোল আর গোল। তাঁর জনপ্রিয়তা এমন বেড়ে গেল, ওই ৬০ হাজারি মাঠে যে
আর দর্শক ঢোকানোর সাহস দেখাতে পারছিলেন না বার্সা কর্তারা। এত বড় কুবালা সত্যি! স্টেডিয়াম যে কোনও দিন ভরে গিয়ে, দুর্ঘটনা ছিল সময়ের অপেক্ষা। তাই সিদ্ধান্ত নেওয়া হল, নতুন
স্টেডিয়াম তৈরির। হ্যাঁ, আজকের যে ক্যাম্প ন্যুতে মেসি, রোনাল্ডোদের দাপিয়ে খেলতে দেখেন এল ক্লাসিকোতে, সেই স্টেডিয়ামটাই বানানো শুধু কুবালাপ্রেমীদের ভিড় সামলানোর জন্য!
এবার আসি বীরুর কথায়। এটা স্পেন নয়। এটা ভারত। এখানে ফুটবল নয়, এখানে ক্রিকেটটাই ধর্ম। ঘণ্টার ধর্ম। যদি ধর্মই হতো, তাহলে বীরেন্দ্র সেহবাগের জন্য আস্ত একটা স্টেডিয়াম
বানাতে হতো বিসিসিআইকে। একটা স্ট্যান্ড, একটা স্টেডিয়ামের নাম, ওসব ওই অনুরাগ ঠাকুর, শ্রীনিবাসন, শশাঙ্ক মনোহরদের মতো কর্তাদের নামে হোক।
কুবালা-বীরেন্দ্র সেহবাগরা স্টেডিয়াম তৈরি করাতে বাধ্য করেন। মন্দির গড়ার জন্য স্বপ্নাদেশ দেন। মুর্খগুলো যদি বুঝতো, কোর্ট-প্যান্ট-টাই পরে, হাসি হাসি মুখে কেমন দিলাম বলে সংবর্ধনা
দেওয়ার সাহসটাই পেত না।
বলার আরও অনেক। আজ নয়, পরে বলব, শুধু দাবিটা জানিয়ে রাখা। বীরেন্দ্র সেহবাগের নামে একটা আস্ত স্টেডিয়াম অনেকদিন আগে থেকে করে রেখেছে এ পৃথিবীর অনেক 'বীরু ধর্মের'
মানুষেরা। তোমাদের ক্রিকেট ধর্মের থেকে বীরু ধর্মের লোকের সংখ্যা একটু বেশিই। ক্রিকেট ধর্মের লোকেরা এখানে সংখ্যালঘু। তাতেও বীরুধর্মের লোকেদের পক্ষ থেকে আজও কোনও অসহিষ্ণুতা
দেখানো হল না। যাদের শেখার, তারা কোনওদিন এটাই শিখুক! তাহলেই হবে।
শেষ বেলায় একটা কথা। কী এমন ফুটবলার কুবালা? এই যে আজকের দিনে আপনারা ওয়াল পেরিয়ে বাঁকানো ফ্রি কিকে গোল করতে দেখেন সবাইকে, এই কাজটা প্রথমবার করে দিয়ে বলে
গিয়েছিলেন এই পৃথিবীটাকে। ওই প্রাচীরটাকে টপকানো যায়। তার আগে ফ্রি কিক থেকে ডাইরেক্ট গোল এ পৃথিবীতে কেউ কখনও করেনি। ঠিক যেমন ছক্কা মেরে ডাবলসেঞ্চুরি, ট্রিপল সেঞ্চুরি
করা যায়, এ পৃথিববী ভাবেনি। বুঝলেন বাবুমশাই, কোন দুটো লোককে এক ছবিতে রাখা হল? আজ যাঁরা সেহবাগকে সম্মান-টম্মান দিলেন, ঈশ্বর যেন, তাঁদের ক্ষমা করেন।