শুভ জন্মদিন Nagendra Prasad Sarbadhikary: খেলার মাঠে ভারতীয় স্বরের প্রতিষ্ঠাতা

ভারতীয় ফুটবলের জনক নগেন্দ্রপ্রসাদ সর্বাধিকারীর আজ ১৫৩ তম জন্মদিন। আজ বিশেষ দিনে গোলন্দাজ-এর দ্বিতীয় পোস্টার মুক্তি পেল।  

Updated By: Aug 28, 2021, 10:49 AM IST
শুভ জন্মদিন Nagendra Prasad Sarbadhikary: খেলার মাঠে ভারতীয় স্বরের প্রতিষ্ঠাতা

ভারতীয় ফুটবলের জনক নগেন্দ্রপ্রসাদ সর্বাধিকারীর আজ ১৫৩ তম জন্মদিন। তাঁর জীবন অবলম্বনে তৈরি হচ্ছে সিনেমা 'গোলন্দাজ'। নাম ভূমিকায় বাংলার সুপারস্টার দেব। ফুটবলের স্বর্ণযুগের ইতিহাস বড় পর্দায় ফুটিয়ে তুলবে এই ছবি। আজ বিশেষ দিনে গোলন্দাজ-এর দ্বিতীয় পোস্টার মুক্তি পেল। দেব নিজেই টুইটারে শেয়ার করে শ্রদ্ধার্ঘ্য জনিয়েছেন কিংবদন্তি ভারতীয় ফুটবলারকে। নগেন্দ্রপ্রসাদ সর্বাধিকারীর জন্মদিনে জি ২৪ ঘণ্টা ডিজিটালের জন্য বিশেষ প্রতিবেদন লিখলেন সোনারপুর মহাবিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের সহকারী অধ্যাপক শুভ্রাংশু রায়। 

শুভ্রাংশু রায়: বাস্তব জীবনে এমন অনেক ঘটনা ঘটে যা নাটকীয়তার ক্ষেত্রে সিনেমাকেও ছাপিয়ে যায়। যেমন ধরুন গান্ধীজির সেই দক্ষিণ আফ্রিকায় ফার্স্ট ক্লাস ট্রেন কামরা থেকে শ্বেতাঙ্গ না হওয়ার কারণে গলাধাক্কা খেয়ে প্রায় একা জনশূন্য প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে থাকা! এই রকম বহু ঘটনা অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তির জীবনে ঘটছে যা পরবর্তী সময়ে দুই মলাটের ফাঁকে বা সেলুলয়েডের পর্দায় নাটকীয় মুহূর্ত হিসেবে ধরা পড়েছে।

এমন একটি বাস্তব ঘটনা হয়তো কিছুদিনের মধ্যেই আমরা পর্দায় দেখতে পাব। এই ঘটনাটি যাঁর জীবনে ঘটেছিল, তাঁর আজ ১৫৩ তম জন্মদিন (২৭ আগস্ট,১৮৬৯)। ১৫২ বছর পূর্ণ করা এই মানুষটি আমাদের কাছে সেই অর্থে একটি বৃত্তের বাইরে, সেই রকম পরিচিত নন। কিন্তু তাঁর জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনাটি জানতে পারলে তাঁর ব্যক্তিত্ব এবং ন্যায়বোধের ছটা অনেক দূর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। নিছক ক্রীড়া সংগঠক পরিচয়কে ছাপিয়ে সামাজিক ন্যায়ের একজন সোচ্চার অথচ অনালোচিত ব্যক্তিত্বের সন্ধান মেলে। 

ঘটনাটি ঘটেছিল জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার দুই বছর পরে অর্থাৎ ১৮৮৭ র কোনও এক সন্ধ্যায়। ১৮ বছরের তরুণ নগেন্দ্রপ্রসাদ মণি দাস নামে অসম্ভব প্রতিভাবান এক তথাকথিত  'নিচু জাতের ' খেলোয়াড়কে ওয়েলিংটন ক্লাবে খেলানোর বিরুদ্ধে গুঞ্জন উঠলে এক মিটিং ডেকে দীপ্ত কণ্ঠে বলে উঠেছিলেন " আমি বুকের রক্ত দিয়ে ক্লাব তৈরি করেছি, বংশ পরিচয় নিয়ে খেলোয়াড় তৈরি করিনি। জাতপাত নিয়ে খেলার আসর আমি সাজাব না, তৈরি করব খেলোয়াড় জাত।" তারপর নিজের তৈরি ক্লাব ছেড়ে এক কথায় বেরিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। 

এত অল্প বয়সে কত সমাজ বিপ্লবের কথা উচ্চারণ করেছিলেন তিনি, সেই সময়ের প্রেক্ষিতে একবার ভাবুন তো! তবে তিনি কথা রেখেছিলেন। ১৯৪০ সালে মৃত্যুর আগে পর্যন্ত তিনি এদেশে খেলোয়াড় তৈরির চেষ্টার কোনো ত্রুটি রাখেননি। কখনও তিনি নিজে খেলোয়াড় হিসেবে সতীর্থদের উৎসাহ দিয়েছেন কখনও ক্লাব সংগঠক হিসেবে কলকাতা বা পার্শ্ববর্তী এলাকায় গড়ে তুলেছেন অসংখ্য স্পোর্টস ক্লাব। আবার ক্রীড়া প্রশাসক হিসেবেও নিজেকে জড়িয়েছেন বেশ কিছু নামজাদা টুর্নামেন্টের প্রতিষ্ঠার সঙ্গে। আবার জীবনের শেষ পর্বে কলমও ধরেছেন অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে খেলাধুলো প্রসঙ্গেও।

নগেন্দ্রপ্রসাদ সর্বাধিকারীর পরিচিতি যে ঘটনার জন্য সেটি ঘটেছিল ১৮৭৭ সালে। আট বছর বয়সী নগেন্দ্র প্রসাদ তাঁর মা হেমলতা দেবীর সঙ্গে গঙ্গাস্নানে যাচ্ছিলেন। তাঁর যাওয়ার পথে ঘটনা পরম্পরায় একটি ফুটবল সামনে এসে পড়ে। ফুটবল এসেছিল ময়দানে খেলা কয়েকজন শ্বেতাঙ্গের কাছ থেকে। "কিক ইট বয়, কিক"। বালক নগেন্দ্র যেন যে বলে  কিক মারলেন সিনেমার পর্দায় মতো সে বল গিয়ে পড়ল হেয়ার স্কুলের মাঠে, যেখানে সতীর্থদের নিয়ে নগেন্দ্রপ্রসাদ ফুটবল খেলায় রত।

তাঁরই উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হল বয়েজ ক্লাব, ওয়েলিংটন ক্লাব, ফ্রেন্ডস ক্লাব ও প্রেসিডেন্সি ক্লাব ইত্যাদি। প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্র নগেন্দ্রপ্রসাদের তত্বাবধানে ওয়েলিংটন ক্লাবে ফুটবলের সঙ্গে শুরু হল হকি, ক্রিকেট এবং রাগবি খেলা। রাগবি খেলাটি অবশ্য খুব বেশিদিন চালু ছিল না। এক দুর্ঘটনার পরে রাগবি খেলা ক্লাবে বন্ধ করে দেন নগেন্দ্রপ্রসাদ। ওয়েলিংটন ক্লাব প্রথম ময়দানে তাঁবু ফেলা ভারতীয় ক্লাব। ওয়েলিংটন ক্লাব যখন বেশ জনপ্রিয়, তখনই মণি দাসকে সুযোগ দেওয়া নিয়ে বিতর্ক এবং নগেন্দ্রপ্রসাদের সরে যাওয়া। তারপর সমস্ত ক্লাবগুলিকে একত্রিত করে নিজের শ্বশুরবাড়ি শোভাবাজার রাজবাড়ির দালানে প্রতিষ্ঠা করলেন শোভাবাজার ক্লাব। ইতিমধ্যে মফঃস্বলে নিজের কর্মকাণ্ড প্রসারিত করেছিলেন  নগেন্দ্রপ্রসাদ।

হাওড়ায় ঈশ্বরচন্দ্র কুণ্ডুর পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করে গড়ে তোলেন হাওড়া স্পোর্টিং এবং চুঁচুড়ায় প্রতিষ্ঠিত হয় চুঁচুড়া স্পোর্টিং। শোভাবাজার ক্লাবের দরজা কিন্তু বর্ণ হিন্দুদের পাশাপাশি দলিত, পার্সি ,খ্রিস্টান এমনকী মুসলমানদের জন্য উন্মুক্ত রেখেছিলেন নগেন্দ্রপ্রসাদ সর্বাধিকারী। আইএফএ শিল্ড টুর্নামেন্ট আয়োজকদের মধ্যে তিনিই ছিলেন একমাত্র ভারতীয়। তাঁর ক্লাব শোভাবাজার স্পোর্টিং প্রথম ভারতীয় দল হিসেবে আইএফএ শিল্ডে অংশগ্রহণ করেছিল।  

১৯১১ মোহনবাগান অ্যাথলেটিক ক্লাবের আইএফএ শিল্ড জয় নিয়ে যদিও নগেন্দ্রপ্রসাদ সর্বাধিকারীর কোনও মন্তব্য আমরা খুঁজে পাই না। তবে তাঁর প্রসঙ্গে সমকালীন একজন বিখ্যাত আন্তর্জাতিক বাঙালির মন্তব্য মেলে। স্বামী বিবেকানন্দ শিকাগো থেকে কলকাতায় ফিরে শোভাবাজার রাজবাড়িতে দেওয়া প্রথম সম্বর্ধনা সভায় নগেন্দ্র প্রসাদের দিকে ইঙ্গিত করে বলেছিলেন ' ওর মতো মানুষ, ওই রকম মরদ চাই আমাদের দেশের.....' 

স্যার ডন ব্র্যাডম্যানের সঙ্গে জন্মদিন শেয়ার করা এই উত্তর কলকাতার এই 'মরদ' নগেন্দ্র প্রসাদ আসলে সেই সময়ের প্রতিনিধিত্ব করেন যে সময় সমগ্র বাঙালি জাতি ব্রিটিশ শাসকের ছুঁড়ে দেওয়া 'এফিমেনেসি' তকমাকে  উপড়ে ফেলতে পাগল হয়েছিল। এই সময়ের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড এবং বিভিন্ন ব্যক্তিত্ব  আমাদের অনেকটাই পরিচিত । কিন্তু খেলার মাঠে বাঙালির আত্মস্বর প্রতিষ্ঠায় যে মানুষটি এতোটাই কার্যকর ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন সে তুলনায় তিনি আমাদের কাছে অনেকটাই অপরিচিত রয়ে গিয়েছেন।

আশা নিয়ে শেষ করি নাটকীয়তায় ভরপুর নগেন্দ্রপ্রসাদের জীবন কাহিনী আগামীদিনে সিনেমার পর্দায় এলে মানুষ এই বিরাট মাপের ব্যক্তিত্বকে নতুন করে চেনার সুযোগ পাবে। যে কোনও  বায়োপিকে সাফল্য বোধহয় বিস্মৃতির আস্তরণের জাল ছিঁড়ে পর্দায় তাঁকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার মধ্যেই নিহিত থাকে।

(Zee 24 Ghanta App দেশ, দুনিয়া, রাজ্য, কলকাতা, বিনোদন, খেলা, লাইফস্টাইল স্বাস্থ্য, প্রযুক্তির লেটেস্ট খবর পড়তে ডাউনলোড করুন Zee 24 Ghanta App)

.