বিশ্বনাগরিকের স্বপ্ন উড়ান

"কতটা পথ পেরলে তবে মানুষ বলা যায়?`` ম্যারাথনের দৌড়টা কিন্তু গুয়োর মারিয়াল শেষ করেছিলেন। না, পদক জেতা তাঁর হয়ে ওঠেনি। কিন্তু তাতে সত্যিই কি কিছু এসে যায়? সুদান থেকে আমেরিকা হয়ে লন্ডনে অলিম্পিকস্‌ ট্র্যাকের দূরত্ব অঙ্কের হিসাবে হয়ত সহজেই বার করে ফেলা যায়।-- এসব নিয়েই লিখেছেন আমাদের প্রতিনিধি রায়া দেবনাথ

Updated By: Sep 27, 2012, 08:04 PM IST

"কতটা পথ পেরলে তবে মানুষ বলা যায়?`` ম্যারাথনের দৌড়টা কিন্তু গুয়োর মারিয়াল শেষ করেছিলেন। না, পদক জেতা তাঁর হয়ে ওঠেনি। কিন্তু তাতে সত্যিই কি কিছু এসে যায়? সুদান থেকে আমেরিকা হয়ে লন্ডনে অলিম্পিকস্‌ ট্র্যাকের দূরত্ব অঙ্কের হিসাবে হয়ত সহজেই বার করে ফেলা যায়। কিন্তু এই পথ পেরিয়ে আসার পিছনে প্রতিটা মুহূর্তের সঙ্গে যে লড়াইটা করতে হয়েছিল ২৮ বছরের ছেলেটাকে, কোন অঙ্কের হিসাবে কি তাকে মেপে ফেলা সম্ভব? - এসব নিয়েই লিখেছেন আমাদের প্রতিনিধি রায়া দেবনাথ।
 দৌড়টা গুয়োর শুরু করেছিল ৮ বছর বয়সে। তবে শখে নয়। সুদানের আর পাঁচটা ছেলের মতই প্রাণ বাঁচাবার তাড়নায় দৌড়ে বেরাত সে। গৃহ যুদ্ধে আক্রান্ত সুদানে জন্মের পর থেকেই গুয়োর মারিয়াল শুধু মৃত্যু আর রক্ত দেখেছিলেন। ১০ বছর বয়সের মধ্যেই গুয়োর হারিয়েছিলেন আট সহদরকে। পরিবারের আরও ২০ সদস্য বলি হয়েছিল হানাহানি, যুদ্ধের সুদানের। ১৯৯৩ সালেই বাড়ি ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন গুয়োর। মিলিটারি বন্দুকের নল থেকে পালিয়ে পালিয়ে এক উদ্বাস্তু শিবির থেকে আর এক উদ্বাস্তু শিবিরে ছুটে চলা। বহু বার পালানোর ব্যর্থ চেষ্টা। বহু বার খুব কাছ থেকে মৃত্যুকে বুড়ি ছুঁয়ে আসা। অভিশপ্ত শৈশবের সঙ্গে যুঝতে যুঝতে যখন গুয়োর ক্লান্ত ঠিক তখনই হঠাৎ একদিন দুরসম্পর্কীয় কাকার হাত ধরে পৌঁছে যান কায়রো। সেখান থেকে ইউএসএ-র আরিজুয়ানা।
পেশাদারি খেলাধুলার শুরুটা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এসে। কিন্তু অলিম্পিকসের আগে পর্যন্ত মার্কিন নাগরিকত্ব জোটেনি গুয়োরের। তাঁর মাতৃভূমি ততদিনে সুদান থেকে বিচ্ছিন্ন। দক্ষিণ সুদান নাম নিয়ে সে তখন পৃথিবীর নবীনতম দেশ। ২০১১ সালে তৈরী হওয়া এই দেশটি এখনও পর্যন্ত অলিম্পিকস কমিটির তালিকা ভুক্ত হয়েনি। যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও ম্যারাথনের মঞ্চে অবতীর্ণ হওয়া অনিশ্চিত হয়ে যায় গুয়োরের। ঠিক তখনই পাশে পেয়ে যান আন্তর্জাতিক অলিম্পিকস কমিটিকে। ইতিহাসে প্রথম বারের জন্য আরও ৪ জনের সঙ্গে `বিশ্ব নাগরিক` হিসাবে ট্র্যাকে দৌড়াবার অনুমতি পান তিনি। একমাত্র গুয়োরই অলিম্পিকস ম্যারাথনে ফাইনালের দরজাটা খুলতে পেরেছিলেন।
ম্যারাথনের পথে যখন গুয়োর দৌড়াচ্ছিলেন দক্ষিণ সুদানে তখন ঘোর বর্ষা। গুয়োরের ফেলে আসা ছোট বেলায় ফেলা আসা গ্রামের মানুষগুলো ততক্ষণে পাড়ি দিয়ে ফেলেছেন আর একটা ম্যারাথনের রাস্তা। নিজেদের গ্রাম থেকে ৩০ মাইল দূরে আর এক গ্রামে। যেখানে ছিল ওই অঞ্চলের একমাত্র টেলিভিশনের হদিশ। গুয়োরকে অলিম্পিকসের ট্র্যাকে এক বার মাত্র দেখতে পাওয়ার তীব্র বাসনার কাছে বোধহয় পৃথিবীর সব দূরত্বই নগণ্য ছিল।
ম্যারাথন গুয়োর শেষ করেছিলেন ৪৭ নম্বরে। কিন্তু তুচ্ছ একটা নম্বরে কি মাপা যাবে গুয়োরের সাফল্যকে। বিশ্বনাগরিক হিসাবে অলিম্পিকসে দৌড়ালেও তাঁর দেশটা যে আসলে দক্ষিণ সুদান। রণ ক্লান্ত দক্ষিণ সুদান। অপরিসীম দারিদ্র্য, হাহাকার, বাতাসে বারুদের তীব্র গন্ধে সিঁটিয়ে থাকা কয়েক হাজার মানুষের পুঁচকে একটা দেশ। সদ্য পাওয়া স্বাধীনতাটুকুকে চেটেপুটে খাওয়ার পদ্ধতি টুকুও জানা নেই যে দেশের মানুষগুলোর। গুয়োরের দৌড় আসলে এই মানুষগুলোকে স্বপ্ন দেখার সাহস জুগিয়েছে। ভাবতে শিখিয়ে `হ্যাঁ, আমরাও পাড়ি।` হদিশ দিয়েছে মুক্তির উড়ানের। তাই যতদিন অলিম্পিকসের মশাল জ্বলবে ততদিন শ্বাশত থাকবেন গুয়োর মারিয়াল। চ্যাম্পিয়ান না হয়েও পেয়ে যাবেন `চ্যাম্পিয়ান অফ চ্যাম্পিয়ানস`-র মর্যাদা।

.