Morocco, FIFA World Cup 2022: একাধিক 'বিদেশি' ফুটবলার, কোচ ওয়ালিদ রেগরাগুইয়ের কৌশলেই 'সুপার পাওয়ার' মরক্কোর বিপ্লব
ফুটবল দুনিয়াকে একের পর এক আগুনে পারফরম্যান্সে চমকে দিলেও, দলের কোচ ও ফুটবলারদের অনেক কটাক্ষ হজম করতে হয়েছে। ব্রিটিশ মিডিয়া তো শুরু থেকে এই দলটার পিছনে পড়ে ছিলই, সঙ্গে নেতিবাচক সংবাদ প্রচার করার জন্য হাত ধুয়ে নেমে পড়েছিল মরক্কোরই একাধিক সংবাদমাধ্যম। প্রতিটা সাংবাদিক বৈঠকে জাতীয় দলে খেলা একাধিক 'বিদেশি মরক্কান'-দের নিয়ে কটাক্ষ করা হত। তোলা হত একাধিক চোখা চোখা প্রশ্ন।
জি ২৪ ঘণ্টা ডিজিটাল ব্যুরো: স্কোরবোর্ড সবসময় গাধা হয় না। চলতি বিশ্বকাপে (FIFA World Cup 2022) মরক্কোর (Morocco) গত পাঁচ ম্যাচের দিকে তাকালেই সেটা বোঝা যাচ্ছে। ক্রোয়েশিয়ার (Croatia) বিরুদ্ধে কাপ যুদ্ধের প্রথম ম্যাচ। ফলাফল ০-০। আটকে গেল গতবারের রানার্স দল। পরের ম্যাচে ২-০ ব্যবধানে উড়ে গেল ফিফা র্যাঙ্কিংয়ের দুই নম্বরে থাকা বেলজিয়াম (Belgium)। তৃতীয় ম্যাচে ফের জয়। এবার কানাডার (Canada) বিরুদ্ধে ১-২ ব্যবধানে জিতল মরক্কো। তিন ম্যাচে দুটি জয়। সহজেই নক আউটে চলে যাওয়া।
এরপর গত দুই ম্যাচে মরক্কোর পারফরম্যান্স দেখে বোঝার উপায় নেই ওরা 'অঘটন' ঘটাতে এসেছে। বরং কোচ ওয়ালিদ রেগরাগুইয়ের (Walid Regragui) ছক ও একাধিক 'বিদেশি মরক্কান'-এর একজোট করে বিপ্লব ঘটিয়ে দিয়েছে উত্তর আফ্রিকার এই দল। রুদ্ধশ্বাস প্রি কোয়ার্টার ফাইনালে স্পেনকে (Spain) ১২০ মিনিট আটকে রাখার পর, টাইব্রেকারে ৩-০ ব্যবধানে জয়। আর শেষ আটের ম্যাচে তো ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো (Cristiano Ronaldo) ও তাঁর পর্তুগালকে (Portugal) ১-০ ব্যবধানে হারিয়ে এবং কাঁদিয়েই বাড়ি পাঠিয়ে দিলেন আছরাফ হাকিমিরা (Achraf Hakimi)। তাই তো দ্বিতীয় সেমি ফাইনালে নামার আগে ফ্রান্সের (France) বিশ্বজয়ী কোচ দিদিয়ের দেশঁ (Didier Deschamps) পর্যন্ত সম্ভ্রম করছেন এই মরক্কোকে।
তবে ফুটবল দুনিয়াকে একের পর এক আগুনে পারফরম্যান্সে চমকে দিলেও, দলের কোচ ও ফুটবলারদের অনেক কটাক্ষ হজম করতে হয়েছে। ব্রিটিশ মিডিয়া তো শুরু থেকে এই দলটার পিছনে পড়ে ছিলই, সঙ্গে নেতিবাচক সংবাদ প্রচার করার জন্য হাত ধুয়ে নেমে পড়েছিল মরক্কোরই একাধিক সংবাদমাধ্যম। প্রতিটা সাংবাদিক বৈঠকে জাতীয় দলে খেলা একাধিক 'বিদেশি মরক্কান'-দের নিয়ে কটাক্ষ করা হত। তোলা হত একাধিক চোখা চোখা প্রশ্ন।
নক আউটে যাওয়ার পর তো মেজাজ হারিয়ে এর জবাব দিয়েছিলেন ওয়ালিদ রেগরাগুই বলেছিলেন, 'কেন অন্য দেশে জন্ম নেওয়া ছেলেদের বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে? মরক্কোয় জন্ম নেওয়া ফুটবলারদের বঞ্চিত করা হচ্ছে। কেন ওদের নিয়েই জাতীয় দল তৈরি করা হল না? কিন্তু এখন আমরা প্রমাণ করতে পেরেছি বিশ্বের সব মরক্কানই মরক্কোর জন্য। জাতীয় দলের হয়ে খেলার সময় সবাই মরক্কোর জন্য জীবন দিতেও তৈরি। মরক্কোর জন্য নিজের সেরাটা দিয়ে লড়াই করে। আমি এখন কোচিং করাই। আমার জন্মও ফ্রান্সে। কিন্তু নিজের দেশের সম্মান রক্ষার চেয়ে আর বেশি কিছু করার তাগিদ আমার নেই। শুধু আমার নয়, এই তাগিদ আমাদের পুরো দল দৌড়ে বেড়াচ্ছে। তাই দয়াকরে আপনারা পাশে থাকুন। আমরা ইতিহাস তৈরি করতে পারলে আপনারাও কিন্তু গর্বিত হবেন।'
ওয়ালিদ রেগরাগুই কিন্তু নিজেও বেশিদিন ধরে এই দলের কোচিং করাচ্ছেন না। কাতারে পা রাখার আগে মাত্র দু'টি ম্যাচে মরক্কোর কোচ হিসেবে ডাগআউটে দাঁড়ানোর সুযোগ পেয়েছিলেন ওয়ালিদ! অবিশ্বাস্য! এবারের বিশ্বকাপে মরক্কোর কোচের হটসিটে থাকার কথা ছিল বসনিয়ার ভাহিদ ভালিহোদজিরগের। কিন্তু কয়েকমাস আগে হঠাৎ করেই জাতীয় দলের ফুটবলারদের সঙ্গে সম্পর্ক মারাত্মক খারাপ জায়গায় চলে যায় ভাহিদের। অথচ তাঁর কোচিংয়েই কাতার বিশ্বকাপে খেলার সুযোগ পেয়েছিল মরক্কো। তবে পরিস্থিতি এতটাই খারাপ জায়গায় চলে যায় যে, নেদারল্যান্ডসের হয়ে খেলার সুযোগ পেয়েও না করে আসা চেলসির হাকিম জিয়েখ মার্চ মাসেই অবসর নিয়ে নিলেন! বিদ্রোহ করে বসেন আরও অনেকে। তাতেই মরক্কোর ফুটবল কর্তারা সিদ্ধান্ত নেন, অবিলম্বে সরাতে হবে ভাহিদকে। অগাস্টে দায়িত্ব দেওয়া হল ওয়ালিদকে।
তাহলে কি শুধু কোচ বদলেই কাতার বিশ্বকাপের শেষ চারে উঠে আসা? একদমই নয়। এর পিছনে রয়েছে মরক্কো ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের পরিকল্পনা। খোঁজ নিয়ে দেখা গিয়েছে বিশ্বকাপে মরক্কো দলের ২৬ জন ফুটবলারের মধ্যে ১৪ জনই খেলেন ইউরোপ নাহলে মরক্কোর বাইরে অন্য কোনও উন্নত লিগে। স্পেনে জন্মানো দেশের তারকা ফুটবলার আছরাফ হাকিমি খেলেন পিএসজিতে। চলতি বিশ্বকাপে এখনও পর্যন্ত 'এক' গোল খাওয়া গোলকিপার ইয়াসিন বোনোর জন্ম কানাডায়। এই বিশ্বকাপে মরক্কোর মাঝমাঠের স্তম্ভ সোফিয়ান আমরাবাত জন্মেছেন নেদারল্যান্ডসে। সোফিয়ান বুফাল ফ্রান্সে। হাকিম জিয়েক নেদারল্যান্ডসে।
আসলে ফুটবলে নিজেদের শক্তি বাড়াতে ১৯৯৮ সালের বিশ্বকাপের আগে থেকে প্রবাসে জন্ম নেয়া মরক্কান বংশোদ্ভূতদের জন্য জাতীয় দলের দরজা খুলে দেয় দেশটি। রয়্যাল মরক্কো ফুটবল ফেডারেশন ইউরোপের বিভিন্ন দেশে স্কাউট পাঠিয়ে খুঁজে বের করতে থাকে দেশীয় ফুটবল প্রতিভাদের। ইউরোপ জুড়ে প্রায় ৫০ লক্ষ মরক্কান বসবাস করেন। তখন একটা টেকনিক্যাল কমিটি ঠিক হয়, যারা ইউরোপের দেশগুলিতে খুঁজে খুঁজে দেখবে, কোন দেশের লিগে মরক্কোর কেউ ভাল খেলছে কি না। সেভাবেই প্রতিভার অন্বেষণ চলল। আর তারপর তো বাকিটা ইতিহাস।