Swami Vivekananda: কর্মের কোলাহল ও না-কর্মের নির্জনতার মধ্য দিয়ে ফুটে উঠেছিল সহস্রদল বিবেকানন্দ-পদ্ম...
Swami Vivekananda Janmotithi: সে এক সাংঘাতিক ব্যাপার। সারাটা জীবন জুড়ে শুধু কাজ-কাজ-কাজ! তাঁর লেখায়, বাচনে, পত্রাবলীতে এই দুর্মর কর্মস্পৃহার চিহ্ন। ধ্যানযোগের সঙ্গেই কর্মযোগ। স্রোত ও শান্তি দুটিই নিজের মধ্যে অক্লেশে বহন করতেন। পারতেন, কারণ, তিনি নিস্পৃহতার চূড়ান্তে পৌঁছেছিলেন।
সৌমিত্র সেন
শ্রীঅরবিন্দ তাঁকে 'ভবিষ্যৎ ভারতের প্রতিনিধি' বলে চিহ্নিত করেছিলেন! ১৯০২ সালে প্রয়াণ। চল্লিশ অতিক্রম করেননি। তিনি স্বামী বিবেকানন্দ। ছোট্ট জীবন কিন্তু বিপুল জীবন। আর স্বামীজির বিপুল গভীর এই জীবন কর্মের কোলাহল ও না-কর্মের নির্জনতা-- এই দুইয়ের মধ্য দিয়েই ফুটে উঠেছিল। স্রোত ও শান্তি দুটিই তিনি নিজের মধ্যে অক্লেশে বহন করতেন। পারতেন, কারণ, তিনি তো নিস্পৃহতার চূড়ান্তে পৌঁছেছিলেন!
কর্মের প্রণোদনা?
উফ! সে এক সাংঘাতিক ব্যাপার। সারাটা জীবন জুড়ে শুধু কাজ-কাজ-কাজ! তাঁর লেখায়, বাচনে, পত্রাবলীতে এই দুর্মর কর্মস্পৃহার চিহ্ন দেখা যায়। শিকাগো-ফেরত স্বামী বিবেকানন্দ যে কী সাংঘাতিক কাজের মানুষ হয়ে দাঁড়িয়েছেন, তা তাঁর গুরুভাইরা ক্রমশ টের পাচ্ছিলেন। পাশ্চাত্য থেকে ফিরে বিবেকানন্দ ঝাঁপিয়ে পড়লেন দেশ ও দশের কাজে। শোনা যায়, গুরুভাইয়েরা খানিক কৌতুক করেই নাকি তখন বলতেন-- বেশ ছিলাম, জপ-ধ্যানে সময় কাটাতাম। নরেন বিলেত থেকে ফিরে এসে অবধি শুধু কাজ আর কাজ!
আরও পড়ুন: National Youth Day: সন্ন্যাসী হয়েও বিবেকানন্দ যুবকদের কী বলে গিয়েছেন শুনলে আশ্চর্য হবেন...
আসলে নিষ্কর্মা সন্ন্যাস তো বিবেকানন্দের আদর্শ ছিল না। তাঁর আদর্শ কর্ম, নিষ্কাম কর্ম। ধ্যানযোগের সঙ্গে সমান তালে কর্মযোগ। গুরুভাই স্বামী অখণ্ডানন্দকে এক চিঠিতে স্বামীজি লিখছেন, 'এই ঘোর দুর্ভিক্ষ, বন্যা, রোগ-মহামারীর দিনে কংগ্রেসওয়ালারা কে কোথায় বলো?' সামাজিক, কিংবা তার চেয়েও যা বড়, সেই মানবিক দায়িত্ববোধ থেকেই বিবেকানন্দ তাঁর গুরুভাইদের দিকে দিকে দরিদ্র অনাথ ক্ষুধার্ত অনাশ্রয়ীদের মধ্যে ছুটে যেতে বলতেন। এর পাশে মঠ-মিশনের দুঃসহ দুর্বহ কাজ তো ছিলই। ছিল পত্রিকার কাজ। দিকে দিকে গুরুর আদর্শ পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে বিশ্বজোড়া ঘুরে বেড়ানো।
আর নিজেকে কাজ থেকে গুটিয়ে নেওয়া, প্রত্যাহারের সাধনা?
আরও পড়ুন: Gangasagar: রাত পোহালেই গঙ্গাসাগর মেলা! জেনে নিন সাগর সম্বন্ধে অবাক-করা কিছু কথা...
তা-ও আছে বইকি! কাজপাগল বিবেকানন্দের জীবনের শেষ কয়েক বছরে গুরুভাইদের দেওয়া কাজের নিরন্তর নির্দেশের মধ্য়ে, কাজে ডুবে যাওয়ার মধ্যেই কাজ থেকে সরে থাকার একটা বাসনাও যেন উঁকি দিয়ে গিয়েছিল। চিঠিপত্রে মাঝে মাঝেই উঁকি দিচ্ছিল তাঁর এই মনোভাব। কখনও নিবেদিতাকে লিখছেন, 'আমি আর কাজ করতে চাই না-- এখন বিশ্রাম ও শান্তি চাই।' কখনও তুরীয়ানন্দকে লিখছেন, 'এখন তোমরা যা হয় করো। আমার কাজ আমি করে দিয়েছি। গুরুমহারাজের কাছে ঋণী ছিলাম-- প্রাণ বার করে শোধ দিয়েছি।' লিখেছেন, 'আমার শরীর-মন ভেঙে গেছে। বিশ্রাম অত্যাবশ্যক।' ক্রিস্টিনকে লিখেছেন, 'আমেরিকায় উপার্জিত সব টাকা ভারতে পাঠিয়ে দিচ্ছি। এবার আমি মুক্ত, আগের মতো ভিক্ষাজীবী সন্ন্যাসী, মঠের সভাপতির পদও ছেড়ে দিয়েছি।' কখনও আবার সেই তুরীয়ানন্দকেই লিখছেন--আমি এখন জিরেন নিতে চলেছি! তাঁর দর্শনে আসলে কাজও সত্য, কাজ থেকে সরে আসাও সত্য। কাজ আর না-কাজের মধ্যে দিয়েই সেদিন ফুটে উঠছিল সহস্রদলপদ্মের মতো বিপুল গরিমাময় এক মহা-বিবেকানন্দ।
আজও তাঁর এই কাজ ও না-কাজের ছন্দোময়তা আমাদের ছুঁয়ে দেয়। তাঁর প্রাসঙ্গিকতা আজও এতটুকু ম্লান হয়নি! তাঁর ঈপ্সিত কাজ তো কত হয়েছে, কত হয়ে চলেছে (কত হবেও হয়তো), কিন্তু কাজ হয়ে গেলেই তাঁর প্রাসঙ্গিকতা কমে যায় না। কেননা, তাঁর না-কাজের পরিসর থেকে আমাদের ঘরগেরস্থালিতে ছায়া ফেলে যায় প্রশান্তিমাখা এক বিবেকানন্দের নিস্পৃহতার কাব্য।
ইউজিন পেট্রোভিচ চেলিশেভ। ই পি চেলিশেভ নামেই বেশি পরিচিত ইনি। মারা গিয়েছেন মাত্র আড়াই বছর আগে। ২০২০ সালের জুলাই মাসে। দীর্ঘজীবী এই মানুষটি রাশিয়ান অ্য়াকাডেমি সায়েন্সের সর্বসময়ের সদস্য, রাশিয়ার ভাষা-সাহিত্য ও বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে অত্যন্ত ধ্রুপদী এক নাম। তবে তাঁর অন্য পরিচয়ও আছে। তিনি প্রখ্যাত ভারততত্ত্ববিদ। রাশিয়ার অন্য়তম শ্রেষ্ঠ ভারততত্ত্ববিদ। এহেন ই পি চেলিশেভ বিবেকানন্দ-ব্যাখ্যায় বলেছিলেন-- বিবেকানন্দ একসময় সুদূর অতীতে পরিণত হবেন, কিন্তু তাঁর অত্যুজ্জ্বল স্মৃতি কোনও দিনই ম্লান হবে না।
ঠিক কী বলেছিন ই পি চেলিশেভ?
ই পি চেলিশেভ বলেছিলেন-- 'বহু বছর পেরিয়ে যাবে, বহু প্রজন্ম অতিক্রান্ত হবে; বিবেকানন্দ ও তাঁর যুগ সুদূর অতীতে পরিণত হবে। কিন্তু সারা জীবন ধরে যিনি স্বদেশবাসীর উজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখেছেন; ভারতবাসীকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য, দুঃখপীড়িত দেশবাসীকে জাগিয়ে তোলবার জন্য, অবিচার ও নিষ্ঠুরতার গ্রাস থেকে তাদের মুক্ত করা জন্য যিনি এত কিছু করেছেন-- সেই মানুষটির স্মৃতি কখনোই ম্লান হবে না। সমুদ্রতীরের পাথুরে ঢালু অংশ যেমন তরঙ্গের আঘাত এবং ঝড়ঝঞ্ঝা প্রতিকূল আবহাওয়ার বিরুদ্ধে তীরভূমিকে সতত রক্ষা করে, সর্বদা নির্ভীক এবং নিঃস্বার্থ বিবেকানন্দ ঠিক তেমনভাবেই তাঁর দেশের শত্রুদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে গিয়েছেন।'
এমন মানুষকে ইতিহাস কখনও ভোলে না, ভুলতে পারে না। বিবেকানন্দের মতো মানুষেরা আসলে কোনওদিনই 'সুদূর অতীতে পরিণত' হন না। আর যিনি 'ভবিষ্যৎ ভারতের প্রতিনিধি', তাঁকে আমরা ভুলবই-বা কী করে! তাই আজও আমরা ফিরে ফিরে তাঁর কাছে যাই। সহস্রদল বিবেকানন্দ-পদ্ম আজও আমাদের মুগ্ধ করে, মগ্ন করে, লুব্ধ করে, প্রতিজ্ঞ করে, সাহসী করে।
ই পি চেলিশেভ একটা ছোট্ট ভুল করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন-- '..বিবেকানন্দ ... তাঁর দেশের শত্রুদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে গিয়েছেন।' 'গিয়েছেন' কথাটা বিবেকানন্দের পক্ষে উপযুক্ত নয়; কেননা, তাঁর সেই সংগ্রাম শেষ হয়নি, তা আজও চলছে। তিনি হয়তো চিরবিশ্রামে, কিন্তু তাঁর মনন, তাঁর প্রাণন আজও কর্মমুখর। না-কাজ থেকে তিনি এক শাশ্বত কাজের ভিতরে চির অন্তঃশীল!
(Zee 24 Ghanta App দেশ, দুনিয়া, রাজ্য, কলকাতা, বিনোদন, খেলা, লাইফস্টাইল স্বাস্থ্য, প্রযুক্তির লেটেস্ট খবর পড়তে ডাউনলোড করুন Zee 24 Ghanta App)