খুন নয় আত্মহত্যাই, সিসিটিভি ফুটেজ দেখে বুরাড়িকাণ্ডে রহস্যভেদ করল দিল্লি পুলিস
বাড়ির বিভিন্ন জায়গা থেকে ১১টি ডায়েরি উদ্ধার করেছেন তদন্তকারীরা। ২০০৭ সাল থেকে ওই ডায়েরিগুলি লেখা হচ্ছিল। মাঝে ডায়েরি লেখা বন্ধ হলেও ২০১৫ সালে ফের ডায়েরিগুলিতে লেখালেখি শুরু হয়। ডায়েরিতে পাওয়া তথ্য অনুসারে পুলিসের ধারণা, ২০০৭ সালে ভাটিয়া পরিবারের কর্তার মৃত্যু হয়। এর পরই বাড়ির ছোট ছেলে ললিত দাবি করে, মৃত বাবাকে দেখতে পায় সে।
নিজস্ব প্রতিবেদন: দিল্লির বুরাড়ি গণআত্মহত্যার ঘটনা এবার সিসিটিভি ফুটেজ থেকে উল্লেখযোগ্য তথ্য পেল পুলিস। ওই ফুটেজে দেখা যাচ্ছে, ওই রাতে বাইরে থেকে বেশ কিছু প্লাস্টিকের টুল নিয়ে ফিরছেন বাড়ি বড় বউ সবিতা ও তাঁর মেয়ে নিধি। পুলিসের দাবি, আত্মঘাতী হতে এই টুলগুলিই ব্যবহার করেছিলেন তাঁরা। তদন্তকারীরা বলছেন, মনবিকারগ্রক্ত ছোট ছেলে ললিতের কথা মানতে গিয়েই করুণ পরিণতি হয়েছে গোটা পরিবারের।
বুরাড়িকাণ্ডের তদন্তে ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছে অন্ধবিশ্বাস ও তুকতাকের তত্ত্ব। ঘটনার রাতের যে সিসিটিভি ফুটেজ উদ্ধার হয়েছে তা খতিয়ে দেখে ক্রমশ এব্যাপারে নিশ্চিত হচ্ছেন তদন্তকারীরা। ক্রমশ ক্ষীণ হচ্ছে বাইরের কারও হাত থাকার সম্ভাবনা। ওই ঘটনায় বুধবার রাতে একটি সিসিটিভি ফুটেজ প্রকাশ করেছে দিল্লি পুলিস। তাতে দেখা যাচ্ছে, বেশ কয়েকটি টুল নিয়ে বাড়িতে ঢুকছেন বড় বউ সবিতা ও তাঁর মেয়ে নিধি। কিছুক্ষণ পর টেলিফোনের তার নিয়ে বাড়িতে ঢোকে ২ নাবাল ধ্রুব ও শিবম। এর পর রাত ১০.৩৯ মিনিটে বাড়ি থেকে বেরোতে দেখা যায় এক ডেলিভারি বয়কে। রাত ১০. ৫৭ মিনিটে কুকুরকে হাঁটিয়ে বাড়ি ফেরেন ভূবনেশ। সেই রাতে আর কাউকে ভাটিয়া পরিবারের বাড়িতে ঢুকতে বা বেরোতে দেখা যায়নি।
১ জুলাই সকাল ৫.৫৬ মিনিটে বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ায় একটি পিক আপ ট্রাক। ভাটিয়া পরিবারের মুদির ব্যবসা রয়েছে। রোজের মতো গাড়ি থেকে দুধের ট্রে ও পাঁউরুটির বাক্স নামিয়ে রাখেন গাড়িচালক। সকাল ৬.০৩ মিনিটে গাড়ি নিয়ে চলে যান তিনি।
বাড়ির বিভিন্ন জায়গা থেকে ১১টি ডায়েরি উদ্ধার করেছেন তদন্তকারীরা। ২০০৭ সাল থেকে ওই ডায়েরিগুলি লেখা হচ্ছিল। মাঝে ডায়েরি লেখা বন্ধ হলেও ২০১৫ সালে ফের ডায়েরিগুলিতে লেখালেখি শুরু হয়। ডায়েরিতে পাওয়া তথ্য অনুসারে পুলিসের ধারণা, ২০০৭ সালে ভাটিয়া পরিবারের কর্তার মৃত্যু হয়। এর পরই বাড়ির ছোট ছেলে ললিত দাবি করে, মৃত বাবাকে দেখতে পায় সে। তাঁর আত্মা ললিতের মধ্যে প্রবেশ করে। মৃত বাবার সঙ্গে কথা বলেন তিনি। দাবি, পরিবারের কল্যাণের জন্য ললিতকে নানা নির্দেশ দেন মৃত ব্যক্তি। সেই নির্দেশ মেনে সুফল মিলছিল বলেও লেখা রয়েছে ডায়েরিতে। এমনকী বাবার মতো গলার আওয়াজে কথাও বলত সে।
পুলিস জানিয়েছে, ডায়েরি অনুসারে পরিবারের বড় ছেলে ভূবনেশের মেয়ে প্রিয়াঙ্কার বিয়ে হচ্ছিল না। ললিতের নির্দেশে পুজো করার পর তাঁর বিয়ে ঠিক হয়। এর পরই ললিতের কথার ওপর আস্থা আরও বেড়ে যায় পরিজনদের। ডায়েরির শেষ দিকে লেখা হয়েছে, পরিবারের মঙ্গলের জন্য কঠোর সাধনা করতে হবে। সেজন্য সবাইকে গলায় ফাঁস লাগিয়ে ঝুলে পড়তে হবে। তাতে কষ্ট হবে কিন্তু ভয় পেলে চলবে না। যন্ত্রণার কথা কেউ জানতে না পারে সেজন্য হাত-মুখ থাকবে বাঁধা। সামনে একটি পাত্রে রাখা থাকবে জল। সেই জলের রং নীল হলে পরিবারের প্রয়াত কর্তা এসে তাঁদের প্রাণ বাঁচাবেন।
শিয়ালদহের সঙ্গে জুড়ল জম্মু! শুরু হল হামসফর এক্সপ্রেসের যাত্রা
মনে করা হচ্ছে, ললিতের ওপর পরিবারের সদস্যদের আস্থা এতটাই ছিল যে, গলায় ফাঁস লাগালে যে মৃত্যু অনিবার্য, এই সাধারণ বুদ্ধিও লোপ পেয়েছিল তাঁদের। ভাটিয়া পরিবারের সদস্যরা নিশ্চিত ছিলেন, কষ্ট হলেও প্রাণে বেঁচে যাবেন তাঁরা। সেজন্য সকালের খাবারও তৈরি করে রেখেছিল পরিবারের সদস্যরা।
মনোবিদরা বলছেন, অডিটরি হ্যালুসিনেশন বা দৃষ্টিভ্রম নামে একটি মানসিক রোগের শিকার ছিলেন ললিত। এই রোগে আক্রান্ত মানুষ মৃত ব্যক্তির গলার আওয়াজ শুনতে পান। এই রোগের চিকিত্সা রয়েছে বলে জানাচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। তবে ললিত এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার পর তাঁকে চিকিত্সকের কাছে নিয়ে যাওয়ার বদলে জ্যোতিষ - তান্ত্রিকের চর্চা শুরু করেছিল পরিবারের লোকেরা। তার ফলেই এই করুণ পরিণতি।
পুলিসের এই তত্ত্ব যদিও এখনো মানতে নারাজ ভাটিয়া পরিবারের জীবিত সদস্যরা। কোনও রকম তন্ত্র মন্ত্রের যোগ মানতে নারাজ তারা। তাঁদের দাবি, খুন করা হয়েছে ১১ জনকে।
গত ১ জুলাই সকালে উত্তর দিল্লির বুরাড়িতে একই পরিবারের ১১ জনের দেহ উদ্ধার হয়। মৃতদের মধ্যে ছিলেন পরিবারের কর্তী নারায়ণী দেবী (৭৭), তাঁর ২ ছেলে ভূবনেশ (৫০), ললিত (৪৫), নারায়ণীদেবীর মেয়ে প্রতিভা (৫৭) বাড়ির দুই বউ সবিতা (৪৮), টিনা (৪৪) ও তাঁদের সন্তান প্রিয়াঙ্কা (৩৩), নিধি (২৫), মেনেকা (২৩), ধ্রুব (১৫) ও শিবম (১৫)। নারায়ণী দেবী বাদে বাকি সবাইকেই ঝুলন্ত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। মৃতদেহের হাত ও চোখ ছিল বাঁধা। মুখে গোঁজা ছিল কাপড়।