দেশ থেকে দেশে, আক্রান্ত নারী, আক্রান্ত মানবতা
ধর্ষিত ২০১৩ সালে, ১০৪ তম আন্তর্জাতিক নারী দিবসের ঠিক আগের দিন কেরালার কোজিকোড়ে একটি ৩ বছরের শিশু শিকার হল গণধর্ষণের। রাস্তায় শিশুটিকে পিঁপড়ে মোড়া অচৈতন্য অবস্থায় উদ্ধার করে কিছু স্কুলপড়ুয়া। অন্যদিকে, গাজিয়াবাদের অদূরে এক ১৯ বছরের স্কুল ছাত্রীকে ধর্ষণ করে কিছু দুষ্কৃতী। আজ, ২০১৪ সালে, ১০৫ তম আন্তর্জাতিক নারী দিবসে এই পৃথিবী, এই দেশের আনাচে কানাচে আরও কত মেয়ে যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে, ধর্ষিত হচ্ছে তার কত শতাংশ ঠাঁই পাচ্ছে খবরের কাগজে? অঙ্কের হিসাব নিকাশ করতে গেলে শতাংশের ঘর লজ্জা পাবে। আর বৈবাহিক ধর্ষণ? সেতো এদেশে অপরাধই নয়।
ধর্ষিত ২০১৩ সালে, ১০৪ তম আন্তর্জাতিক নারী দিবসের ঠিক আগের দিন কেরালার কোজিকোড়ে একটি ৩ বছরের শিশু শিকার হল গণধর্ষণের। রাস্তায় শিশুটিকে পিঁপড়ে মোড়া অচৈতন্য অবস্থায় উদ্ধার করে কিছু স্কুলপড়ুয়া। অন্যদিকে, গাজিয়াবাদের অদূরে এক ১৯ বছরের স্কুল ছাত্রীকে ধর্ষণ করে কিছু দুষ্কৃতী। আজ, ২০১৪ সালে, ১০৫ তম আন্তর্জাতিক নারী দিবসে এই পৃথিবী, এই দেশের আনাচে কানাচে আরও কত মেয়ে যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে, ধর্ষিত হচ্ছে তার কত শতাংশ ঠাঁই পাচ্ছে খবরের কাগজে? অঙ্কের হিসাব নিকাশ করতে গেলে শতাংশের ঘর লজ্জা পাবে। আর বৈবাহিক ধর্ষণ? সেতো এদেশে অপরাধই নয়।
২০১২ শেষে দিল্লির চলন্ত বাসে ঘটে যাওয়া গণধর্ষণকে কেন্দ্র করে প্রতিবাদে উত্তাল হয়েছিল সারা দেশ। যার রেশ এখনও হয়ত মিলিয়ে যায়নি। সরকার থেকে সাধারণ মানুষ, সবাই এই সামজিক ব্যাধির অবসানের দাবি জানিয়েছিল। দাবি উঠেছিল আইন পরিবর্তনের। তার জেরে গঠিত হয়েছে ভার্মা কমিশন। তৈরি হয়েছে নয়া অর্ডিন্যান্স। কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতির বদল কি আদৌ হয়েছে? দিল্লির গণধর্ষণ নিয়ে দেশ যখন উত্তাল তার মধ্যেই দিল্লিতে স্কুল প্রিন্সিপালের লালসার শিকার হয় এক স্কুল ছাত্রী। বিহারে ট্রেন থেকে নামিয়ে গণধর্ষণের পর এক মহিলাকে খুন করে ঝুলিয়ে দেওয়া হয় গাছে। ত্রিপুরায় জনসমক্ষে গণধর্ষণের শিকার হন এক গৃহবধূ। সরকারী স্কুলে ৭ বছরের শিশু কন্যাকে ধর্ষিত হতে হয় শিক্ষকদের হাতে। মহারাষ্ট্রে তিন নাবালিকা বোনকে ধর্ষণের পর খুন করে ফেলে দেওয়া হয় কুয়োতে। কলকাতায় পরিতক্ত্য বাসে ধর্ষিত হন এক মানসিক ভারসাম্যহীন মহিলা। পার্কস্ট্রিটের ঘটনা দিল্লির আগে ঘটলেও প্রচারের আলোতে আসে এই ঘটনার পরই। তারপর একে একে কামদুনি, গেঁদে, গাইঘাটা, খরজুনা, লাভপুর... এবং...এই তালিকা আসলে সীমাহীন। ঘটনাগুলির মাত্র কিছু শতাংশ সামাজিক সীমারেখা টপকে স্থান পায় সরকারি তালিকায়। তার মধ্যে গুটিকয়েক ঠাঁই পায় কাগজে। আজ নাকি নারী দিবস?
শুধুমাত্র ধর্ষণকেই যদি ধরা হয়, সেক্ষেত্রে পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্রের সামাজিক পরিকাঠামোকে টপকে আইনের দোরগোড়ায় পৌঁছতে পারেন খুবই কম সংখ্যক মানুষ। এই সত্যিটাও সবারই জানা। কিন্তু এসব কিছু বাদ দিয়েও যাঁরা অভিযোগ নথিভুক্ত করতে পারেন তাঁদের মধ্যেও ক`জন সঠিক বিচার পান?
পরিসংখ্যানের দিকে নজর দিলে যে বাস্তবের মুখোমুখি হতে হয়, সেটা যথার্থই শিউরে ওঠার মত। আইনের প্রয়োগ যদি যথাযথ না হয় সেক্ষত্রে নতুন আইন প্রণয়ন করে কোন লাভ হবে কি না, নিম্নলিখিত পরিসংখ্যান কিন্তু তার দিকে বড়সড় প্রশ্নচিহ্ন ঝুলিয়ে দেয়।
কেন্দ্রীয় সরাষ্ট্রমন্ত্রকের তথ্য অনুযায়ী ২০১১ সালে সারা দেশে মোট ১৫,৪২৩টি ধর্ষণের ঘটনা নথিভুক্ত হয়েছে।
কিন্তু তার মধ্যে মাত্র ৪,০৭২টি ক্ষেত্রে অপরাধীদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ, মাত্র শতকরা ২৬.৪% ক্ষেত্রে বিচার পাওয়া গিয়েছে। বাকি ১১,৩৫১টি ঘটনা এখনও লালফিতের ফাঁসে আটকে রয়েছে। কবে সেই সব ঘটনার মুক্তি ঘটবে, সে বিষয়ে সঠিক কোনও ইঙ্গিত এখনও পর্যন্ত পাওয়া
যায়নি। ফলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই প্রকৃত অপরাধীরা বহাল তবিয়তে এই সমাজের বুকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। সারা দেশের মধ্যে ২০১১ সালে সব থেকে বেশি ধর্ষণের ঘটনা নথিভুক্ত হয়েছে মধ্যপ্রদেশে। সরকারি মতে ওই বছর মোট ৩,৪০৬টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে এই রাজ্যে। যার মধ্যে মাত্র ২৩.৬% ক্ষেত্রে দণ্ডাজ্ঞা পাওয়া গেছে।
নারী সুরক্ষা নিয়ে রাজ্য সরকার যতই গর্ব করুক না কেন এ তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে আছে পশ্চিমবঙ্গ। শুধু সরকারি তথ্য অনুযায়ীই ২০১১ সালে এ রাজ্যে ধর্ষিত হয়েছেন মোট ২,৩৬৩ জন। কিন্তু লজ্জাজনক ভাবে মাত্র ১১.৫% ক্ষেত্রে অপরাধীরা শাস্তি পেয়েছে। শুধু তাই নয় অপরাধীদের যথাযথ শাস্তি দানের শতকরা হিসেবে
পশ্চিমবঙ্গ দেশে একেবারে নিচের সারিতে। যদিও, এই রাজ্যগুলিতে মোট ধর্ষণের সংখ্যা পশ্চিমবঙ্গের থেকে অনেক কম।
আশ্চর্যজনকভাবে উত্তরপূর্বের ছোট্ট রাজ্য মণিপুরে ধর্ষণ কান্ডে অভিযুক্তদের ক্ষেত্রে ১০০% দণ্ডাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। ২০১১ সালে দেশের মধ্যে সবথেকে কম ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে সিকিমে। ১৬টি। তার মধ্যে ৫৫% ক্ষেত্রে শাস্তি পেয়েছে অপরাধীরা। উত্তরপূর্বের আরেক রাজ্য নাগাল্যান্ডেও ৮৪.২% ক্ষেত্রে অপরাধীদের শাস্তি দেওয়া
হয়েছে। পিছিয়ে নেই মিজোরামও। যদিও আসাম, ত্রিপুরাতে ধর্ষণের নথিভুক্ত ঘটনা আর শাস্তি প্রাপ্তির শতকরা হিসেবের মধ্যে বড়সড় দূরত্ব রয়েছে।
অন্যদিকে মহারাষ্ট্র, কেরল, অন্ধ্রপ্রদেশ, ছত্তিশগড়, উত্তরপ্রদেশ এবং ওড়িশাতে ২০১১ সালে সরকারি তথ্য অনুযায়ী ধর্ষণের সংখ্যা ১০০০-এর বেশ কিছু বেশি। কিন্তু এদের মধ্যে একমাত্র উত্তরপ্রদেশে শতকরা ৫৪.৫ জন অপরাধী শাস্তি পেয়েছে। বাকি রাজ্য গুলিতে শাস্তি দানের শতকরা হার ৩০-এর কম।
যৌননির্যাতনের নিকৃষ্টতম অংশ সম্ভবত ইচ্ছার বিরুদ্ধে কাউকে যৌনসম্পর্ক স্থাপনে বাধ্য করা। যার পোশাকি নাম ধর্ষণ। যদিও তার মধ্যে থেকে এখনও আমাদের দেশের আইন বাদ দেয় বৈবাহিক ধর্ষণের ঘটনাকে। কিন্তু ধর্ষণ ছাড়াও আমাদের দেশে মেয়েদের উপর লাগাতার চলতে থাকা যৌননিগ্রহের ঘটনার সংখ্যাটা আসলে এতই বেশি তাকে বোধহয় আর তালিকাভুক্ত করাও সম্ভব না।