Durga Puja 2022: প্রথম পুজো ||গল্প ||
অর্ণব চক্রবর্তী
প্রথম পুজো
অর্ণব চক্রবর্তী
“দাদা, আপনার ঘাড়ে ওটা কী লেগে আছে?”, ভুরু দুটো একেবারে কমল মিত্র স্টাইলে কুঁচকে, বেশ ছায়া দেবীর মত ভয় পেয়ে যাওয়া গলায় ভদ্রলোককে প্রশ্নটা করলাম।
বাবুবাগানের ঠাকুর দেখে শর্টকাট ধরে যে গলিটা দিয়ে সেলিমপুর পল্লীর প্যান্ডেলটায় যাওয়া যায় ওখানে দাঁড়িয়ে সবে আয়েশ করে একটা সিগারেট ধরিয়েছেন ভদ্রলোক। অনেকক্ষণ ধরেই ওনাকে চোখে চোখে রাখছিলাম, সেই স্টেশনপল্লীর প্যান্ডেলের কাছ থেকে। বাবুবাগান সেরে এবার তার গন্তব্য সেলিমপুর। আমি যে দস্তুরমত ওনার পিছু নিয়েছি সেই ব্যাপারটা ভদ্রলোক টের পান নি। অবশ্য দুর্গাপুজোর সন্ধেবেলা কলকাতার রাস্তায় যে হারে বাঙালী ঘোরাফেরা করে তার কাছে হাই ভোল্টেজ জার্মানি-পর্তুগাল ফুটবল বিশ্বকাপ ম্যাচের দর্শক সংখ্যাও নিতান্তই শিশু! তাই ওই ভিড়ে কেউ কাউকে ফলো করছে কিনা তা বুঝতে পারা অসম্ভব।
প্রশ্নটা আচমকা আসায় ভদ্রলোক সাতপাঁচ না ভেবেই তড়িঘড়ি নিজের ঘাড়ে হাত ঠেকালেন। যাক বাবা! কাজ হাসিল হয়ে এল বলে, এবার কোনো এক ছুতোয় ওনার ঘাড়ে আমার ডানহাতের বুড়ো আঙুলটা ঠেকাতে পারলেই কেল্লাফতে! সেই মহালয়ার পর থেকে গরু খোঁজার মত একখানা মানুষ খুঁজেছি যার শরীরের ভেতর সেঁধিয়ে এবারের দুর্গাপুজোটা দেখতে পাব!
আসলে ব্যাপার কী জানেন, যতই মরে ভূত হয়ে গিয়ে থাকি, দুর্গাপুজোয় ঠাকুর দেখার নেশা অত সহজে ছাড়া যায়না! আর পরলোকে গিয়ে আমি যে ডিপার্টমেন্টে পড়েছি সেখানের সিনিয়র ভূতগুলো কিন্তু মশাই দিব্যি ভালো! মানে পুজো-পার্বণে ছুটিছাটা দেয় আর কী! আমি তো মরেছি ধরুন তিন মাস মত হল, পরলোকে গিয়ে যখন জানতে পারলাম এখানেও দুর্গাপুজোয় ছুটি আছে, চাইলে কলকাতায় গিয়ে ঠাকুর দেখতে পারি, তখন মাইরি বলছি মনটা না জাস্ট আনন্দের চোটে আন্দামান হয়ে গেল! কিন্তু একটাই গেরো! স্রেফ আত্মা হিসেবে ঘোরাঘুরি করলে না পারব প্যান্ডেলে ঢুকতে, না পারব লাইনে দাঁড়িয়ে রাস্তার ধার থেকে রোল-চাউমিন খেতে, না পারব কোনো পুজোবার্ষিকী কিনতে। মানে পুজোর পুরো ফিলটাই ওপর ওপর নিতে হবে। ধুর, ওভাবে ঠাকুর দেখে মজা আছে নাকি!
ডিপার্টমেন্ট থেকেই বলল দুর্গাপুজো ঠিকঠাক মত এঞ্জয় করতে চাইলে কারুর শরীরে ঢুকে পুজোটা কাটাতে হবে। তাই মহালয়া থেকেই তক্কে তক্কে ছিলাম, আজ অবশেষে সুযোগ এসেছে! এখানে বলে রাখি, এই শরীরে সেঁধিয়ে যাওয়ার কিন্তু একটা স্পেসিফিক টেকনিক আছে। যার শরীরে ঢুকব তার ঘাড়ের একটা নির্দিষ্ট স্পটে ডানহাতের বুড়ো আঙুলটা ঠেকিয়ে এক বিশেষ প্রক্রিয়ায় হাল্কা চাপ দিতে হবে। ব্যাস, একদম ঢ্যাঁড়স সেদ্ধর মত সুড়ুৎ করে গলে যাব ভেতরে। যার শরীরে ঢুকলাম তার কেবল একবার মাথা টলে যাবে, আর কিছু টের পর্যন্ত পাবে না। শুধু তার ভেতর বেদম উৎসাহ এসে যাবে ঘুরে ঘুরে ঠাকুর দেখে পায়ে ফোস্কা ফেলার, গোঁতাগুঁতি করে হলুদ বিরিয়ানি খাওয়ার, বা বন্ধুবান্ধবদের সাথে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আড্ডা মারার।
আমার তো আজকাল রীতিমত সন্দেহ হয় মশাই; বেঁচে থাকতে দেখেছি আমার বন্ধুগুলো দুর্গাপুজো এলেই কেমন যেন উদ্ভট হয়ে যেত; রোদ-বৃষ্টি কিচ্ছুর তোয়াক্কা না করে প্যান্ডেলের পর প্যান্ডেল ঘোরা, নর্থ থেকে সাউথ ঠাকুরের পর ঠাকুর দেখতে দেখতে খ্যাচাং খ্যাচাং করে সেলফি তোলা, আর রাতে ঘণ্টা তিনেক ঘুমিয়ে নিয়েই আবার বেরিয়ে পড়া--- এসব পাক্কা ঘাড়ে ভূত চাপার লক্ষণ! নাহলে আপাত নিরীহ ছেলে-মেয়েগুলো পুজোর সময়ে খামোখা অমন ক্ষ্যাপা ষাঁড় কেন হয়ে উঠত বলুন?
যাইহোক যা বলছিলাম, ভদ্রলোক আমার প্রশ্ন শুনে ঘাড়ে হাত দিয়ে আমার দিকে ফিরলেন। আমি খুব স্বাভাবিকভাবেই এগিয়ে গিয়ে ওনার ঘাড়ে হাত দিতে দিতে বললাম, “আরে এখানটায়!”
বুড়ো আঙুলটা ঠেকিয়ে সবে চাপ মেরেছি, লোকটারও একবার মাথাটা ঘুরে গেছে। কী বলব মশাই, লোকটার ঘাড়ের ভেতর থেকে একটা বিদঘুটে মুখ অল্প বেরিয়ে এসে খ্যানখ্যানে গলায় ধমক দিল, ‘আ গেল যা! কোন হালার পো আবার ঢুকতে চায়? উফ, বহু ক্যাচালের পর মহালয়ার দিন সন্ধেবেলা এই ব্যাটাকে বাগিয়েছি! লক্ষ্মীপুজোর আগে কিছুতেই নড়ছি না, ভাগ এখান থেকে! তেমন হলে কালীপুজোর সময়ে চেষ্টা করিস, এখন যা!”
বলেই আমার বুড়ো আঙ্গুলে জোরে কামড় বসালো। আমি চটপট হাত ছাড়িয়ে নিয়ে সোজা হাঁটা দিলাম সেলিমপুরের দিকে। ধুর আমার ভাগ্যটা মরে যাওয়ার পরেও খারাপই রয়ে গেল! যাও বা একজন জুটল ঠাকুর দেখব বলে, কোন এক ভূত তার ভেতর গ্যাঁট হয়ে বসে আছে! বলি ও মশাইরা, শুনছেন? আপনাদের কারুর ঘাড়ে চাপতে দেবেন প্লিজ? মাইরি বলছি দশমীর দিনেই চলে যাব! নাহলে যে মরার পর প্রথম পুজোটা আমার একেবারে মাঠে মারা যাবে! প্লিজ দিন না একটু ঘাড়ে চাপতে!
পড়ুন, বাঙালির প্রাণের উৎসবে আমার 'e' উৎসব। Zee ২৪ ঘণ্টা ডিজিটাল শারদসংখ্যা