#ভ্রমণ: শীতের শহরে রোদ্দুর পিঠে নিয়ে চলুন চার্চ-দর্শনে
যেখানে আপনার জন্য সদাই দু'দণ্ড শান্তি বিছিয়ে জনকল্লোল থেকে দূরে, আড়ালে।
সৌমিত্র সেন
শহরের পেটের ভিতরে কত যে আলাদা আলাদা শহর লুকিয়ে তার ইয়ত্তা নেই! শহরের পরতে পরতে অন্য শহর। এ শহরের ধমনীতে মিশে রয়েছে খ্রিস্টীয় সংস্কৃতি, ইসলামি সংস্কৃতির নানা প্রবাহ। এ শহরের স্থাপত্য়ে, সংস্কৃতিতে বহুত্ববাদের নানা অভিজ্ঞান। সেই চিহ্নগুলি খুঁজতে বেরনো একটা অভিজ্ঞতাই।
যেমন, শীতের আমেজি রোদ্দুরে বা উইকেন্ডের যে কোনও দিনে একবেলার জন্য বেরিয়ে পড়ে ঘুরে ঘুরে দেখে নেওয়া চলে এ শহরের গির্জাগুলি। এ দেশে বা এ শহরে গির্জা যে কেবল ইংরেজদের হাতেই নির্মিত হওয়া শুরু হয়েছিল, তা কিন্তু নয়। ইংরেজরা এ দেশে আসার অনেক আগে থেকেই খ্রিস্টধর্মাবলম্বী আর্মেনিয়ান ও পর্তুগিজরা এসেছিল এ শহরে। কিছুটা পরে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। তাদের সূত্রে ইংরেজ বণিকদল। এই সমস্ত ধারার সম্মিলিত সূত্রেই এ শহরের বুকে একে একে তৈরি হতে থাকে গির্জাগুলি। প্রাচীন এই সব গির্জা এ শহরের নাগরিক ইতিহাস ও সংস্কৃতির সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে।
এই ভরা শীতের দিনে অনায়াসে বেরিয়ে পড়া চলে একবেলার ডে-আউটিংয়ে। পিঠে সোনা রোদ্দুরের আদর নিয়ে ঘুরে ফেলা যায় শহরের গির্জাগুলি। যেখানে দু'দণ্ড শান্তি বিছিয়ে থাকে জনকল্লোলের দূরে। আপনিও অনুভব করতে পারেন সেই শান্তি, সেই ছায়া, সেই স্নিগ্ধতা, সেই প্রাচীনতা।
যেমন, সেন্ট জেমস চার্চ। পোশাকি নাম--জোড়া গির্জা। ১৮২৬ সালে চার্চটি ছিল আমহার্স্ট স্ট্রিট সন্নিহিত লেবুতলায়। সেটি একদা মেরামতির জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। হয়েছিল সংস্কারের চেষ্টাও। তবে ১৮৫৮-য় সেটি পুরোপুরি ভেঙে পড়ে। পরে লোয়ার সার্কুলার রোডে একটি বাড়ি-সংলগ্ন বাগান কেনা হয় নতুন গির্জা তৈরির জন্য। সেখানেই তৈরি হয় সেন্ট জেমস গির্জা।
তবে সম্ভবত এ শহরের সব চেয়ে প্রমিনেন্ট, সব চেয়ে জনপ্রিয় গির্জা সেন্ট পলস ক্যাথিড্রাল। কলকাতার ক্যাথিড্রাল মানেই সেন্ট পলস ক্যাথিড্রাল। ১৮১৯ নাগাদ বিশপ মিডলটনের উদ্যোগে একটি গির্জা তৈরির পরিকল্পনা করা হয়েছিল। শুরু হয় জমি খোঁজা। আজ যেখানে ক্যাথিড্রাল সে সময়ে সেখানে ছিল ঘন জঙ্গল। সেখানেই ১৮৩৯ সালে গির্জার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়। ইন্দো-গথিক স্থাপত্যের নিদর্শন এই গির্জাটি তৈরি করতে সময় লেগেছিল আট বছর। ইন্দো-গথিক শৈলীতে নির্মিত এই গির্জাটি ১৮৪৭ সালে সাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হয়।
চলুন ডালহৌসী। এখানে আগে ছিল পুরনো মেয়র্স কোর্ট। সেই কোর্টেই মহারাজ নন্দকুমারের ফাঁসির আদেশ হয়েছিল। ১৭৯২ সালে পুরনো আদালতের বাড়িটি ভেঙে ফেলা হয়। তবে রাস্তাটির নাম ওল্ড কোর্ট হাউস স্ট্রিট-ই দেওয়া হয়। ১৮১৫ সালে এই জায়গাটি গির্জা তৈরির জন্য দেওয়া হয় স্কটিশদের। ১৮১৮ সালে গির্জাটির উদ্বোধন হয়। এটিই হল কলকাতার বিখ্যাত 'লাল সাহেবের গির্জা' তথা সেন্ট অ্যান্ড্রুজ চার্চ। ডালহৌসি অঞ্চলের এই গির্জাটি গ্রিক স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত।
সময়টা সতেরো শতকের মাঝামাঝি। পর্তুগিজরা বাণিজ্যের কারণে কলকাতায় বসতি স্থাপন করল। শোনা যায়, জোব চার্নকও নাকি তাঁদের সাহায্যেই এ শহরে বসতি স্থাপন করেন। পর্তুগিজরা সুতানুটি অঞ্চলে প্রথমে একটি উপাসনালয় তৈরি করেছিলেন। পরে মুরগিহাটা অঞ্চলে তাদের বসতি স্থাপিত হয়। নতুন করে তৈরি হয় উপাসনালয়টিও। সেটিই আজকের পর্তুগিজ চার্চ। ১৭৯৯ সালে এটি নির্মিত। যার পোশাকি নাম 'ক্যাথিড্রাল অফ দ্য মোস্ট হোলি রোজারি'।
সতেরো শতকের প্রথম দিকে আর্মেনিয়ানরা কলকাতায় আসে। ব্র্যাবোর্ন রোড, চিনাবাজার অঞ্চল ছিল তাদের বসতি। এখানেই তাঁরা একটা উপাসনালয় তৈরি করান। সেটিই আর্মেনিয়ান চার্চ। গবেষকদের মতে এটিই হল কলকাতার প্রাচীনতম গির্জা।
পার্ক স্ট্রিটের মিডলটন রো'তে অবস্থিত সেন্ট থমাস চার্চ। ১৯৯৭ সালে এই রোমান ক্যাথোলিক এই চার্চেই শায়িত ছিল মাদার টেরেসার মরদেহ। ১৮৪১ সালে এই চার্চের ভিত্তিপ্রস্তর স্তাপিত হয়েছিল। ১৮৪২ সালে এটি সকলের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছিল।
শীতের একটা বেলা এই গির্জা-দর্শনে কাটালে মনটা নিশ্চিত ভাবেই এক আশ্চর্য মদিরতায় পূর্ণ হয়ে উঠবে। হয়তো এ শহরের প্রতি ভালোবাসা বেড়েও যেতে পারে কয়েকগুণ।