কিছু সত্যি, কিছু বানানো

Updated By: Sep 24, 2017, 03:59 PM IST
কিছু সত্যি, কিছু বানানো

সুব্রত রায়

 

আমি কখনও পলিটিক্যাল মিটিং শুনতে যাই না। কারণ আমি জানি নেতারা কী বলবেন বা বলতে পারেন। আপনি যদি নেতার নাম আর কী উপলক্ষে মিটিং হচ্ছে, কবে হচ্ছে আমাকে বলতে পারেন তাহলে আমি ঐ নেতার বক্তব্য মোটামুটি আপনাকে বলে দিতে পারি। কিন্তু কয়েকদিন আগে হঠাৎ ফেঁসে গেলাম।

জিপিও-তে গিয়েছিলাম একটা প্যাকেটের খোঁজে। বিদেশ থেকে কয়েকটা বই আমার এক বন্ধু পাঠিয়েছে। প্যাকেটটা কলকাতায় এসেছে আমার কাছে খবর আছে। কিন্তু সেটা আমার বাড়িতে পৌঁছয় নি। তাই জিপিও-তে খোঁজখবর করতে গিয়েছিলাম। এ-টেবিল ও-টেবিল করতে করতে ঘণ্টা তিনেক কেটে গেল। কিন্তু প্যাকেটের সন্ধান মিলল না। আস্তে আস্তে জিপিও-র দরজা দিয়ে বেরিয়ে সিঁড়ির উপর এসে দাঁড়ালাম। নীচের দিকে তাকাতে চোখাচোখি হয়ে গেল আমার কলেজের সহপাঠী অনিলের সঙ্গে। অনিলের সঙ্গে তিন বছর পড়েছি। কলেজ ছাড়ার পর যোগাযোগ কমে গিয়েছিল। সেটার জন্য অবশ্য আমি দায়ী নই। অনিল কোনও এক কারণে কলেজের সহপাঠীদের সঙ্গে একদম যোগাযোগ রাখে নি। শুভ্র আমাদের ক্লাসে পড়ত – অনিলের ছোটবেলার বন্ধু। ক্লাস থ্রি থেকে একসঙ্গে পড়েছে। শুভ্র একদিন অভিযোগ করল, অনিলটা বদলে গেছে। রাস্তায় দেখা হল। প্রায় না চেনার ভান করল। আমার সঙ্গে অনিলের বছরে এক-দু’বার রাস্তায় দেখা হয়। প্রতিবারই এক প্রশ্ন, কেমন আছ? তোমার ফোন নম্বর এই তো, বলে আমার ফোন নম্বরটা বলেছে। দীর্ঘ এই পঁচিশ বছরে আমার ল্যান্ডলাইন-এর নম্বর তিনবার বদলে গেছে। তারপর মোবাইল এসেছে। অনিল নতুন নম্বর শুনে নিয়েছে, লিখে নেয় নি। পরেরবার যখন দেখা হয়েছে তখন ঠিক ঠিক নম্বর বলেছে। লোকমুখে শুনেছি অনিল হোম মিনিস্ট্রিতে কাজ করে। আমার অনুমান অনিল কোনো গোপন কাজের সঙ্গে যুক্ত। তাই পুরনো বন্ধুদের এড়িয়ে চলে। মজার কথা, অনিল আমার ফোন নম্বর নিয়েছে – কিন্তু কখনো ফোন করে নি।

 

বছর পাঁচেক আগে একদিন সকালে অনিলের ফোন। এই প্রথমবার।

- বাইপাসের মুখে যে বড় হাসপাতাল তার অনেক ডাক্তার, নার্সদের সঙ্গে তোমার তো পরিচয় আছে। আমার একটা উপকার করবে? আগামিকাল সকালে আমার স্ত্রীর কিডনি-স্টোন বার করার জন্য অপারেশন করা হবে। কিন্তু সেদিন অফিসের কাজে বিকেলে তিন দিনের জন্য আমাকে কলকাতার বাইরে যেতে হবে। আর্জেন্ট কাজ। না বলা যাবে না। তুমি তোমার পরিচিত ডাক্তার, নার্সদের একটু বলে দেবে? আর আমি না ফেরা পর্যন্ত আলপনার খোঁজখবর নেবে?

আমি বেশ অবাক হলাম। অনিলের জানার কথা নয় আমার সঙ্গে ঐ সুপার-স্পেশালিটি হাসপাতালের ডাক্তার-নার্সদের চেনাশোনা আছে। ওখানকার মেট্রন সুলতাদি, আমার বন্ধুর দিদি। আর সার্জারির হেড অতুলদা, আমার কলিগ অজয়ের দাদা। যাইহোক, আমি কয়েকদিন আলপনার দেখাশোনা করলাম। আলপনা দুঃখ করে বলল, আপনার বন্ধুর কাণ্ডটা দেখলেন, আগে অফিস পরে বাড়ি। বিয়ের সময় বলে দিয়েছে যে ও কী কাজ করে জিজ্ঞাসা করা যাবে না। হোম মিনিস্ট্রিতে একজন অফিসার। ব্যাস এই পর্যন্ত।

আমি আস্তে আস্তে সিঁড়ি দিয়ে নেমে ফুটপাতে এসে দাঁড়ালাম। অনিলের পাশে একজন লম্বা মতন ভদ্রলোক।

অনিল বলল – এনাকে চেন?

আমি বললাম – না।

- ভালো করে দেখো।

ভদ্রলোকের দিকে সোজাসুজি তাকালাম। লম্বায় ছ’ফুটের চেয়ে বেশি। খাড়া নাক। আমাদের চেয়ে বেশ খানিকটা বড়। চুল সাদা। মুখে মৃদু মৃদু হাসি।

- না আগে কখনো দেখেছি বলে মনে পড়ছে না।

- পারলে না তো। তা এনার নাম বলছি। ভজহরি মুখার্জি।

আমি আবার ধাঁধায় পড়লাম। ভজহরি মুখার্জি নামে কাউকে আমি চিনি না। অনিল একটু চুপ করে থেকে বলল – এনার আর একটি নাম আছে। অনুমতি পেলে বলি।

ভদ্রলোক ঘাড় নাড়লেন।

- এনার আর একটি নাম হল টেনিদা। পটলডাঙার টেনিদা।

আমি সত্যি সত্যি যাকে বলে হাঁ হয়ে যাওয়া তাই হয়ে গেলাম। পটলডাঙার টেনিদা। ছোটবেলা থেকে যার গল্প গোগ্রাসে গিলেছি। তিনি কিনা আমার সামনে দাঁড়িয়ে!

আমি নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম – টেনিদা কিছু মনে করবেন না। আপনার নাম ভজহরি আমি জানি। কিন্তু ভজহরি মুখার্জি সশরীরে আমার সামনে ভাবতেই পারিনি। তা কমলেশ ব্যানার্জি, স্বর্ণেন্দু সেন আর কুশলকুমার মিত্র কেমন আছেন?

টেনিদার মুখ হাসিতে ভরে গেল।

- তুমি দেখছি আমাদের সকলের ভালো নামগুলি জানো। কমলেশ মানে প্যালারাম শ্যামাচরণ দে স্ট্রিটে একটা বই-এর দোকান করেছে – নারায়ণ পুস্তক ভাণ্ডার। নারায়ণ গাঙ্গুলির সব বই সেখানে পাওয়া যায়। তবে অন্য লেখকদের বইও সেখানে থাকে। কলকাতায় নারায়ণবাবুর বই-এর খোঁজ করতে হলে প্যালার দোকানে সবাই আসে।

- প্যালাদা কি দোকানে বসেন?

- বসেন মানে? রোজ দশটা থেকে ছ’টা অবধি। আর দোকানে বসে বই পড়ে। লেখাপড়ায় আমার মতন মা-গঙ্গা হলে কী হবে, বাংলা গল্প-উপন্যাসের একদম কারেন্ট খবর ওর কাছ থেকে পাওয়া যাবে।

- দোকানটা ভাল চলে তাহলে?

- ভাল মানে? খুব ভালো। আমি মাঝে মাঝে ওর দোকানে যাই। খুব খাওয়ায়। দিলখুশার কাটলেট, প্যারাগনের সরবত, বাঞ্ছারামের কচুরি – খাওয়ার পক্ষে কলেজ স্ট্রিট এক আদর্শ জায়গা।

- তাহলে একদিন প্যালাদার সঙ্গে আলাপ করে আসব।

- প্যালার একটা গল্প শোনো। এটা নারায়ণবাবু কোথাও লেখেন নি। ম্যাট্রিকে প্যালা অঙ্কে দু’বার গাড্ডা খেয়েছে। প্রত্যেকবার বাবা-ছেলের বয়সের অঙ্ক আসত, আর প্যালা অঙ্ক কষলে দেখা যেত ছেলের বয়স বাবার চেয়ে বেশি। সেবার প্যালা একটা চালাকি করল। অঙ্ক করার পর খাতায় যেখানে বাবা আছে সেটা কেটে ছেলে লিখে দিল আর যেখানে ছেলে আছে সেটা কেটে বাবা করে দিল। তাতেও রক্ষা পেল না, চব্বিশে গিয়ে আটকে গেল। পরের বার সেই একই ধরনের অঙ্ক। প্যালা লাফাতে লাফাতে পরীক্ষার হল থেকে বেরোল। বাবার বয়স এবার ছেলের চেয়ে বেশি হয়েছে। বাড়ি ফিরতে প্যালার ডাক্তার মেজদা জিজ্ঞাসা করলেন, কত উত্তর হয়েছে? প্যালা বলল, এবার ঠিক আছে। বাবার বয়স বেরিয়েছে ৯৬ আর ছেলের বয়স ৪। মেজদা গম্ভীর হয়ে বললেন, পরীক্ষা হয়ে গেলে আমার সঙ্গে হাসপাতালে দেখা করবি। একটা ছাগল আর তোর ব্রেনটা স্ক্যান করে দেখব কোথায় কোথায় মিল আছে।

আমি বললাম – ক্যাবলাদা কেমন আছেন?

টেনিদা বললেন – ক্যাবলা এখন বিগ বস। ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্কে খুব উঁচু পদে কাজ করে। সারা পৃথিবী ঘুরে বেড়ায়। বছরে চার-পাঁচবার দেশে আসে। আর আসার সময় আমার জন্য অনেক চকলেট নিয়ে আসে। এই মাস-দুয়েক আগেকার কথা। হঠাৎ সকাল সাড়ে-ছ’টার সময় আমার বাড়িতে এসে হাজির। বলল, সিঙ্গাপুরে এসেছিলাম। তোমার সঙ্গে সকালে চা খাবার ইচ্ছে হল তাই চলে এলাম। রাতে এলাম। বিকেলে আমেরিকা চলে যাব। ভাবখানা এই রকম – শ্যামবাজারে এসেছিলাম, পটলডাঙা ঘুরে গেলাম। গত বছর কুশল মিত্র IIT-তে Convocation Address দিয়েছে। Times of India-র প্রথম পাতায় সুট-টাই পরা ক্যাবলার ছবি – চেনাই যাচ্ছিল না। শুনেছি অর্থনীতিতে এখন একজন ওয়ার্ল্ড ফিগার।

- আর হাবুলদা?

- হাবলাটার কথা আর বোলো না। এখনো সাবালক হয়ে উঠতে পারলো না। কয়েকটা দোকানে হিসাবের খাতা লেখে। সেদিন কী হয়েছে শোনো। সার্দান অ্যাভিনিউ দিয়ে হাঁটছি। হঠাৎ ঝমঝম করে বৃষ্টি নামল। আশপাশে দাঁড়াবার কোনো জায়গা নেই। আমার পাশ দিয়ে একজন দৌড়ে গেল। ভালো করে তাকিয়ে চেঁচিয়ে বললাম, এই হাবলা দৌড়চ্ছিস কেন? হাবুল আমার গলাটা শুনে বলল, দ্যাখতাসো না কত জুরে বৃষ্টি পরতে আসে। ভিইজ্যা যামু না। আমি বললাম, তোর হাতে তো ছাতা আছে দেখতে পাচ্ছি। হাবুল দাঁড়িয়ে পড়ে ছাতা খুলে বলল, অ্যাক্কারে মনে আসিল না। সাতিরনিসে আইও। সলো কুনখানে গিয়াখাড়া হই।

ই-নৈবেদ্য- দেবীরূপের মাহাত্ম্যটা স্মরণে রেখে যেন কাজ করেন আজকের দুর্গারা

হাবলার আর এক কাণ্ড শোনো। আমাকে ফোন করেছে। আমার ফোনটা তখন খারাপ। তাই পায় নি। হাবলা ঠিক তার পরের নম্বর ডায়াল করেছে। ঘটনাচক্রে সেটা আমার পাশের বাড়ির ভোলাদের ফোন। ভোলা আমাকে ডেকে দিয়েছে। এর কিছুদিন পর প্যালার দোকানে ফোন করেছে। রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ির জন্য প্যালার লাইন মাস খানেক ধরে খারাপ। এবার হাবলা ঠিক তার পরের নম্বর ডায়াল করেছে। ফোন ধরে এক মহিলা চেঁচাতে শুরু করেছেন। রোজ আপনি আমাকে ফোন করে বিরক্ত করছেন। আমি পুলিসে খবর দেব। হাবুল তো ভয়ে পান্তুয়া। যাইহোক সরি-টরি বলে সে যাত্রা কোনো বকমে রেহাই পেয়েছে।

আমি দুপুর বারোটার সময় এই চত্তরে এসেছিলাম। এখন প্রায় সাড়ে তিনটে।

অনিলকে বললাম, চলো, একটু এগোলে একটা লোক গরম প্যাটিস বিক্রি করে। বড় খিদে পেয়েছে। দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে বললাম, চারটা প্যাটিস – এক জায়গায় দুটো আর অন্য দু’জায়গায় একটা করে। টেনিদাকে বলতে হল না দুটো প্যাটিসের প্লেটের দিকে হাত বাড়ালেন।

অনিল বলল – গলাটা শুকিয়ে গেছে, সফট ড্রিঙ্ক খাওয়া যাক। একটা ৫০০ আর দুটো ২০০ মিলি লিটারের বোতল দিন না।

টেনিদা আবার হাত বাড়িয়ে ৫০০ মিলি লিটারের বোতলটা তুলে নিলেন।

ই-নৈবেদ্য- উত্তম কুমারের মহালয়ার পর শুধু ইট ছোড়া বাকি ছিল

পেটটা ঠাণ্ডা হওয়ার পর ভাল করে বিবাদী বাগের দিকে তাকাতে অন্য রকম মনে হল। রাস্তায় কোনো গাড়ি নেই। বাস, ট্রাম চলছে না। প্রচুর পুলিস। এখানে ওখানে লোকে জটলা করছে। দূরে টেলিফোন ভবনের ধারে একজন হ্যান্ড মাইক নিয়ে বক্তৃতা দিচ্ছে। কান পাততে মনে হল নোট বাতিলের বিরুদ্ধে গরম গরম কথা বলছে।

আমি বললাম – ব্যাপারটা কী?

অনিল বলল – তুমি অনেকক্ষণ জিপিও-র মধ্যে ছিলে বলে খবরটা পাও নি। নোট বাতিলের পর ব্যাঙ্ক আর এটিএম-এ টাকা না পেয়ে কয়েকটা ব্যাঙ্ক আর এটিএম ভাঙচুর হয়েছে। শুনেছি পুলিসকে দু’এক জায়গায় লাঠি চালাতে হয়েছে।

আমি বললাম – তাই তো! আচ্ছা টেনিদা নোট বাতিলের জন্য আপনার অসুবিধা হয় নি?

টেনিদা একটা হাই-ক্লাস হাসি হেসে বললেন – আমার তো মাসে সাত হাজার টাকা লাগে। মাসের শেষে বা প্রথমে একবার ব্যাঙ্কে যাই। টাকা তুলতে। ব্যাঙ্কের সকলে আমাকে চেনে। গত পঁচিশ বছরে বহু কর্মচারী বদলি হয়েছে। অনেকে রিটায়ার করেছে। কিন্তু আমার কন্টাক্ট নষ্ট হয়নি। ম্যানেজার বদলি হলে নতুন ম্যানেজারকে চার্জ বুঝিয়ে দেবার সময় আমাকেও বুঝিয়ে দিয়ে যায়। আমাকে লাইনে দাঁড়াতে হয় না। আমি সোজা ম্যানেজারের ঘরে যাই। ম্যানেজার চা খাওয়ান আর নিজে গিয়ে চেক ভাঙিয়ে টাকা নিয়ে আসেন। ১০০ টাকার ৪০-টা, ২০ টাকার ১০০-টা আর ১০ টাকার ১০০-টা। আমি কোনো দিন ৫০০ বা ১০০০ টাকার নোট ছুঁয়ে দেখিনি।

আমি বললাম – নোট বাতিলের ব্যাপারে আপনার কী মতামত?

টেনিদা একটু ভেবে বললেন – এসব ক্যাবলা ভাল বলতে পারে। কিছু লোকের অসুবিধা হয়েছে এটা ঠিক। কিছু লোক অবশ্যই খুব দরকার ছাড়া এখন জিনিস কিনছে না। একথা ঠিক সরকারের ব্যাপারটা গোপন রাখা প্রয়োজন ছিল। তাই আগে থেকে অনেক অনেক নতুন ৫০০-টাকার নোট ছাপা সম্ভব ছিল না। একটা কাজ করা যেত। ৬/৮ মাস আগে থেকে নতুন ২৫০-টাকার নোট ছাপা শুরু করলে কেউ সন্দেহ করত না। নোট বাতিলের পর ২৫০-টাকার নতুন নোট বাজারে ছেড়ে দিলে এত ঝামেলা হত না। তবে লোকে মনে হয় একটু বাড়াবাড়ি করছে বলে আমার ধারণা। এই যে কিছুদিন আগে দেখছিলাম পোস্ট-অফিসে এমআইএস-এর টাকা পেতে লোকদের চার-পাঁচ ঘণ্টা লাইন দিতে হচ্ছিল তখন তো এত হৈ চৈ হয় নি। তবে বেশ কিছু কালো টাকা আর জাল টাকা আউট অব সারকুলেশন হয়ে যাবে বলে আমার মনে হয়। যাকগে এসব ভাবার জন্য অনেক পণ্ডিত ব্যক্তি আছেন। আমি বাবা বেশি কথা বলব না। আজকাল প্রায়ই লোকে আমার মুখে কথা বসিয়ে দিচ্ছে। এই সেদিন দমদম যাচ্ছিলাম। চিড়িয়ার মোড়ে শুনলাম মাইকে রক্ত দেবার জন্য আবেদন করছে। কাছে গিয়ে দেখি একটা ব্লাড ডোনেশন ক্যাম্প চলছে। সুন্দর করে সাজিয়েছে। কিন্তু এ কী! অনেক পোস্টারের সঙ্গে আমাদের চারমূর্তিকে নিয়ে একটা পোস্টার ঝুলছে। তাতে আমার নাম করে লেখা আছে, বুঝলি প্যালা, আমার তো বয়সের গাছ-পাথর নেই; তোর তো পিলেটা মস্ত বড়। হাবলাটা কোনও দিনও সাবালক হবে না। ক্যাবলা, তুই-ই একমাত্র রক্ত দিতে পারিস। চল, মানুষের একটা উপকার করে আসি। প্রথমে খুব রাগ হল। আমি কবে এসব কথা বললাম? পরে মনে হল কথাগুলি তো মিথ্যে নয়। বললেও কোনো দোষ হত না। আর আমার নামে দুটো বেশি লোক যদি রক্ত দেয় সে তো ভাল কথা। ভাগ্যিস আমাকে কেউ চিনতে পারে নি।

ই-নৈবেদ্য- রেডিও ধার্মিক মীরের কাছে মহীষাসুরমর্দিনী আজও গাইডবুক

আমি বললাম – আচ্ছা টেনিদা আপনার সঙ্গে নারায়ণবাবু্র পরিচয় ছিল?

টেনিদা বললেন – ছিল মানে? খুব ভাল পরিচয় ছিল। না হলে আমাকে নিয়ে গল্প লিখতেন কী করে? তবে লেখার মধ্যে আজগুবি কথাই বেশি থাকত। একদিনের গল্প শোনো। আমাকে নিয়ে বেশ কয়েকটা গল্প লেখার পর দেখি লোকে আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করছে। একদিন সকালে নারায়ণবাবুর বাড়ি গিয়ে হাজির হলাম, কড়া কড়া কথা শোনাব বলে। নারায়ণবাবু চেয়ারে বসে মন দিয়ে লিখছেন। আমাকে সোফায় বসতে ইঙ্গিত করে আবার লেখায় মন দিলেন। মিনিট পাঁচেক পর আশা-বৌদি এককাপ চা আর প্লেটে করে দুটো গরম সিঙাড়া আমার সামনে রেখে গেলেন। সিঙাড়ায় কামড় দিয়ে বুঝলাম ভিতরে আলুর বদলে মাংসের কিমা আছে। চোখ বুজে তারিয়ে তারিয়ে সিঙাড়া দুটো শেষ করে চোখ খুলে দেখলাম প্লেটে আরও দুটো সিঙাড়া। কী হল? বুঝলাম আশা-বৌদি আরও দুটো রেখে গেছেন। যাইহোক একটু পরে নারায়ণবাবু্র লেখা শেষ করে আমার দিকে ফিরে বললেন, কী টেনি কী খবর? অনেকদিন আসো নি। আমি বললাম, আপনি আমার নাম করে যা তা লিখছেন। লোকে হাসাহাসি করছে।

নারায়ণবাবু বললেন, শোনো হে টেনি গতকাল নানা কারণে মনটা খুব খারাপ ছিল। সব সময় মনে হয় একটা গ্লানি নিয়ে বেঁচে আছি। বিকেলে তোমাকে নিয়ে একটা গল্প লিখতে শুরু করলাম। মনটা ভাল হয়ে গেল। অনেকটা লিখে ঘুমতে গেলাম। এই এখন গল্পটা শেষ হল। গল্পটা শোনো। নাম দিয়েছি কুট্টিমামার দন্ত-কাহিনী। পুরো গল্পটা পড়লেন। আমি বললাম, আমার কুট্টিমামার নাম গজগোবিন্দ হালদার এটা ঠিক। সাহেবরা তাঁকে আদর করে ডাকে মিস্টার গাঁজা-গাবিন্ডে, এটাও ঠিক। কিন্তু বাঘের তাড়া খেয়ে বারো সের ওজনের কালীসিঙ্গির মহাভারত বগলদাবা করে গাছে উঠবেন এটা কখনো হতে পারে না। মানুষের মত বাঘের ৩২-টা দাঁত আছে কিনা জানি না। কিন্তু গাছের উপর থেকে মহাভারত বাঘের মুখে পড়তে ৩২-টা দাঁত মাটিতে গড়াগড়ি খেতে লাগল কিম্বা বাঘ কুট্টিমামার বাধানো দাঁত নিজের মুখের মধ্যে ঢুকিয়ে টুথ-ব্রাশ আর টুথ-পেস্ট নিয়ে হাওয়া হয়ে গেল একথা কেউ বিশ্বাস করবে না। নারায়ণবাবু্ বললেন, দেখে নিও এই গল্পটা সুপার-হিট হবে। গল্পটা বেরোবার মাস-দুয়েক পরে ১০-টা বাচ্চাকে জিজ্ঞাসা করে দেখো, কেউ দাঁত নিয়ে প্রশ্ন করবে না। মহাভারতের ঘায়ে দাঁত ভাঙতে পারে কি পারে না এই নিয়ে কেউ মাথা ঘামাবে না। তোমাকে একটা কথা বলি। তারক গাঙ্গুলিকে ক’জন চেনে? সিটি কলেজের রুটিনে দেখতে পাবে বাঙলার ক্লাস নেন টিএনজি। নারায়ণ গাঙ্গুলিকে কিছু লোক চেনে বটে, তবে তার চেয়ে বেশি চেনে টেনিদাকে। সেদিন এক সাহিত্য সভায় এক প্রবীণ সাহিত্যিকের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। তিনি বললেন, নারায়ণ তোমার সব লেখা আমি পড়েছি। বিশেষত শিলালিপি উপন্যাস কয়েকবার পড়েছি। আমার বাড়িতে অনেক পত্র-পত্রিকা আসে। ছোটদের পত্রিকা বা পূজাসংখ্যা এলে প্রথমেই দেখি টেনিদার গল্প আছে কি না। সেটা প্রথমেই পড়ি। আমি নিজে যতই অ্যাকাডেমি পুরস্কার আর কয়েক'শ বই লিখে থাকি না কেন, ৫০ বছর পরে আমার বই কেউ পড়বে কি না জানি না। তা তুমি আর তোমার টেনিদা অমরত্ব পেয়ে গেছ এ কথা আমি জোর গলায় বলতে পারি।

এসব শোনার পর আমার মাথাটা কেমন গুলিয়ে গেল। যা বলতে এসেছিলাম তা আর বলা হল না। আজ তাহলে আসি বলে নারায়ণবাবুর বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলাম।

ই-নৈবেদ্য- ইতিহাসের আলোকে মোগলমারি 

অনিল বলল – একটু হাঁটা যাক, গল্প করতে করতে। লিন্ডসে স্ট্রিটে একটা দোকানে ভাল রোল পাওয়া যায়।

মনে হল টেনিদার চোখ দুটো চকচক করে উঠল। আমরা হাঁটতে শুরু করলাম। বাস-ট্রাম স্বাভাবিক হতে আরও কিছুক্ষণ সময় লাগবে।

আমি বললাম – টেনিদা আপনি আপনার একটা গল্প বলুন যেটা নারায়ণবাবুর লেখাতে নেই।

টেনিদা একটু ভাবলেন।

- শোনো আমি তখন ক্লাস সেভেনে পড়ি। আমাদের সংস্কৃত পড়াতেন হরি পণ্ডিত। হরিচরণ তর্কতীর্থ। প্রথম ক্লাসে বর্ণমালা পড়াতে গিয়ে বললেন, বুঝলি সংস্কৃতে বাংলার মতো ডয়-শূন্য র, ঢ-শূন্য র, অন্তঃস্থ-অ, চন্দ্রবিন্দু এসব নেই।  আমি বললাম, স্যর, অনেক মানুষ নিশ্চয়ই সংস্কৃত ভাষায় কথা বলে।

- অবশ্যই বলে।

- তারা মরে গেলে ভূত হয়।

- হতে কোনো বাধা নেই।

- তাহলে ভূত হয়ে কথা বলে কী করে। কারণ শুনেছি ভূতেরা চন্দ্রবিন্দু দিয়ে কথা বলে।

হরি পণ্ডিত চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। আমি বুঝতে পারলাম হরি পণ্ডিত আমাকে পিটিয়ে আমসত্ত্ব বানিয়ে দেবেন। আমি ক্লাসের পিছনের দরজা দিয়ে এক দৌড় লাগালাম। সিঁড়ি দিয়ে তরতর করে নেমে কলেজের লাগোয়া খেলার মাঠের দিকে লক্ষ্য করে। হরি পণ্ডিত আমাকে তাড়া করে প্রায় মাঠের কাছে চলে এসেছেন। হেডস্যর বসন্তবাবু এ দৃশ্য দেখে দোতলার নিজের ঘর থেকে নেমে কী হয়েছে কী হয়েছে বলতে বলতে মাঠের মধ্যে এসে দাঁড়ালেন। আমি হেডস্যর-এর পিছনে এসে দাঁড়ালাম।

ই-নৈবেদ্য- তা থৈ থৈ যোনি

হরি পণ্ডিত হেডস্যরকে বললেন, বসন্ত তুমি সরে দাঁড়াও। আমি টেনিকে শায়েস্তা করব।

হেডস্যর বললেন, স্যর কী হয়েছে? তারপর সব শুনে বললেন, টেনিকে আমার হাতে ছেড়ে দিয়ে আপনি ক্লাসে যান। আমি এমন শাস্তি দেব টেনি সারা জীবনে ভুলতে পারবে না। আমাকে বললেন, টেনি তুমি জান হরি পণ্ডিতের কাছে আমিও পড়েছি। তুমি ওনার সঙ্গে ইয়ার্কি মারতে গেছ? চলো ক্লাসে গিয়ে সবার সামনে  বলবে, ভুল হয়ে গেছে। আমি বললাম, স্যর আমার একটা প্রশ্ন আছে? পণ্ডিত মশাই কি কাশী, বৃন্দাবন এই সব তীর্থে গিয়ে তর্ক করে তর্কতীর্থ হয়েছেন। বসন্তবাবু বললেন, টেনি এবার কিন্তু তোমাকে সত্যই বেত মারব। আমরা দু’জনে ক্লাসে ফিরে এলাম। বললাম, পণ্ডিত মশাই আমার ভুল হয়ে গেছে। হেডস্যর বুঝিয়ে দিয়েছেন সংস্কৃত জানা ভূতেরা চন্দ্রবিন্দু দিয়ে কথা বলে না। হেডস্যর হাসতে গিয়ে গম্ভীর হয়ে আলতো করে আমার পিঠে একটা কিল মেরে নিজের ঘরে চলে গেলেন।

টেনিদা দ্বিতীয় রোলটা খেতে খেতে বললেন - আর একটা দুঃখের কাহিনি শুনবে? শিশির মঞ্চের পাশ দিয়ে যাচ্ছি। একটা শো ভেঙেছে। আমার চেয়ে লম্বা এক ভদ্রলোকের মুখোমুখি হয়ে গেলাম। তাঁর পাশের ভদ্রলোক নিশ্চয়ই আমাকে চেনেন, বললেন, মানিকদা ইনি পটলডাঙার টেনিদা। মানিকবাবুর সারা মুখ হাসিতে ভরে গেল। আমি একটু সাহস করে বললাম, স্যর, আমার একটা কথা শুনবেন? কুট্টিমামাকে নিয়ে একটা ট্রিলজিকরুন না। দারুণ জমে যাবে। একটা অস্কারও পেয়ে যেতে পারেন। লালমোহনবাবু কুট্টিমামার পার্ট করবেন। আর আমরা চারজন নিজেদের চরিত্রে অভিনয় করব। মানিকবাবুর হাসি নিমেষে মিলিয়ে গেল। ভারি গলায় বললেন, আচ্ছা, আচ্ছা ভেবে দেখব। ভেবে দেখেছিলেন কি না জানিনা। তবে ওনার সঙ্গে আর কোনোদিন দেখা হয় নি।

ই-নৈবেদ্য- আদর্শ শঙ্কর, দুর্গমকে সুগম করাই প্যাশন অভিযাত্রী অনিন্দ্যর

টেনিদার রোল শেষ। বললেন – চলো রাস্তা পার হই। ওপারে গিয়ে বাস ধরব। বাস আসার আগে শেষ গল্পটা শুনে নাও। প্যালার দোকানে বসে চা খাচ্ছি। এক ভদ্রলোক তাঁর মেয়েকে নিয়ে দোকানে ঢুকলেন। মেয়েটির বয়স সাত কী আট।

- জেঠু আমাকে এক কপি চারমূর্তি দাও না।

প্যালা উঠে গিয়ে র‍্যাক থেকে একটা বই বার করে এনে মেয়েটির হাতে দিয়ে বলল - রুপু কেমন আছ? তুমি তো সেদিন চারমূর্তি এক কপি নিয়ে গেলে।

- ওটা মিঠুকে জন্মদিনে দিয়ে দিয়েছি।

বুঝলাম প্যালা বাচ্চাটিকে চেনে। প্রায়ই বোধহয় বই কিনতে আসে। প্যালা এদিক ওদিক তাকিয়ে আমার দিকে আঙুল তুলে বলল, ঐ যে ভদ্রলোক চা খাচ্ছেন ওকে চেন? উত্তরের অপেক্ষা না করে বলল, উনি পটলডাঙার টেনিদা। মেয়েটি কয়েক সেকেন্ড আমার দিকে তাকিয়ে নিচু হয়ে কাউন্টারের তলা দিয়ে ভিতরে চলে এল। বইটা আমার হাতে দিয়ে বলল, জেঠু বইতে একটা সই করে দাও। এই প্রথম একজন আমার অটোগ্রাফ চাইল। প্যালার ক্যাশমেমো লেখার জন্য রাখা বল পয়েন্ট পেনটা দিয়ে লিখলাম, ভজহরি মুখোপাধ্যায়। মেয়েটি বলল, এতে হবে না। লেখো টেনিদা।

- আচ্ছা ঢাউস ঘুড়ি যখন তোমায় আকাশে তুলল, তখন কেমন লাগছিল? গঙ্গার পারে গাছে আটকে যাওয়ার পর কাকগুলি ঠোকরাতে খুব ব্যথা পেয়েছিলে, তাই না? তুমি স্তোরিয়া দে মোগারা পুঁদিচ্চেরি বোনানজা বাই সিলিনি কামুচ্চি বইটা পেলে কোথায়? তুমি ল্যাটিন ভাষা কবে শিখলে?

ই-নৈবেদ্য- ''মায়ের বিয়ের শাড়ি চুরি করে, পাঁচ বছর বয়সে পুজোয় হাতেখড়ি''

টেনিদা তাঁর ডান হাত দিয়ে মুখটা মুছে নিলেন।

- বোঝো ব্যাপারখানা। নারায়ণবাবু গাঁজাখুরি গল্প লিখেছেন আর সকলে সেটাকে সত্যি বলে ধরে নিয়েছে। প্যালা, হাবুল আর ক্যাবলাকে নিয়ে আমি ময়দানে ঢাউস ঘুড়ি উড়াতে গিয়েছিলাম একথা সত্যি। কিন্তু একটা ঢাউস ঘুড়ি আমার মতো একজনকে টেনে আকাশে তুলবে এটা নারায়ণবাবুর একদম বানানো। আর ছোট বড় সবাই বিশ্বাস করেছে ঐ যে কী এক উদ্ভট নামের ল্যাটিন বই সেটা আমি পড়েছি। আমার সান্ত্বনা লোকে এইসব হাবি-জাবি গল্প পড়ে আনন্দ পেয়েছে বিশ্বাস করেছে। তার সব কৃতিত্ব নারায়ণবাবুর।

টেনিদা কব্জি উলটে ঘড়ি দেখে বললেন – পাঁচটা বাজে। এই বাসটা কলেজ স্ট্রিট যাবে। প্যালার সঙ্গে একবার দেখা করে যাই।

.