নোট নাকচের বর্ষপূর্তিতে 'উলু-খাগড়া'রা কেমন আছেন?
সোমনাথ মিত্র: ট্রেন থেকে নেমেই হন্তদন্ত হয়ে হাঁটা দিলাম হাওড়া জেটির দিকে। প্রতিদিনের মতো আজও অফিস ঢুকতে লেট হবে মনে হচ্ছে। কার্যত ছুট লাগালাম। ঘাটে এসে দেখি তরী মাঝ গঙ্গায়। হাতে মিনিট দশেক সময়। অগত্যা রাজু-দার কাছে গিয়ে খান পাঁচেক লজেন্স কিনলাম। পকেট থেকে দশ টাকার খুচরো বার করতেই রাজু দা-র মন্তব্য, "দাদা, নোট দিন না।"
- নেই গো। তাহলে কাল নিও।
- এই করে সংসার চলে। কাল বললে হাঁড়ি চলবে? দিন খুচরো।
অবাক লাগে, বছর খানেক আগে তো কারোর খুচরো নেওয়ার এমন অনীহা ছিল না। বরং খুচরো না দিলেই সবজি বিক্রেতা, বাস কন্ডাক্টরদের নিদারুণ গোঁসা হত। হল টা কী?
রাজু বিড়বিড় করতে লাগল- বাড়িতে হাজার খানেক এক টাকার কয়েন পড়ে। কাউকে দিতে পারছি না। মোদী যে কী করল?
কাকতালীয়ভাবে, আজকেই মোদীর নোটবাতিলের বর্ষপূর্তি। যদিও এসবে রাজু আগরওয়ালের কোনও হেলদোল নেই। তাঁর সমস্যা অন্য জায়গায়। হাওড়া ফেরিঘাটে ১০ বছর ধরে লজেন্স বিক্রি করেন কিন্তু উপচি খুচরোর সমস্যায় কোনও দিনও পড়তে হয়নি রাজুকে। তাঁর কথায়, "নোট বাতিলে আমার তেমন কোনও অসুবিধা না হলেও খুচরোর জ্বালায় ঘুম কেড়েছে। কাস্টোমার নিতে চাইছে না। কিন্তু তারা দিলে আমি নিতে বাধ্য। লজেন্স বিক্রি করি দাদা, পিৎজা নয়।"
আরও পড়ুন- তৃণমূলের 'কালা দিবসে'র পাল্টা, নোট বন্দির বর্ষপূর্তিতে 'উল্লাস দিবস' বিজেপির
খুচরো পয়সা যক্ষের ধনের মতো ঘরে মজুত করে রাখতে বাধ্য হচ্ছেন রাজুর মতো অনেকেই। এর জেরে বাটা ব্যবসায়ীদের ব্যবসা লাটে উঠেছে। বাস কন্ডাক্টরকে দশ টাকা খুচরো দিলে ভ্রু কোঁচকান। দক্ষিণেশ্বর-বিবাদি বাগ রুটের কন্ডাক্টর পিন্টু দে বলেন, "দাদা, থলিতে যা খুচরো রয়েছে, বইতে গিয়ে শিরদাঁড়া ঝুঁকে যাচ্ছে। আর খুচরো দেবেন না।" কিন্তু আমজনতাই বা যায় কোথায়? তাদেরও খুচরোতে পকেট ভারী।
নরেন্দ্র মোদী বরাবরই দাবি করেছেন, বৃহত্তর স্বার্থে নোট বাতিল করাটা জরুরি ছিল। তবে, রাতারাতি ৫০০ এবং ১০০০ টাকার নোট বাতিল ঘোষণা হওয়ায় চরম দুর্ভোগে পড়েন আম জনতা। ব্যাঙ্ক-এটিএম-এ দীর্ঘ লাইন। ভোগান্তি। অপেক্ষা। এসবই ছিল সে সময়ে খবরের শিরোনাম। নোট বাতিলের জেরে বড়-মাঝারির সঙ্গে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছিল ছোট ব্যবসাগুলিরও। সেই ধাক্কা যে এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেনি স্বর্ণ কারিগর জয়ন্ত সামন্তের কথাতেই তা স্পষ্ট। বড়বাজারের এক সোনার দোকানের এই কারিগর বললেন, "এখনও কাজের মন্দা রয়েছে। প্রতিবছর কালীপুজোর সময় যে কাজের চাপ থাকত, এখন আর সেভাবে নেই। ফুরোনে কাজ করি। দিনের পর দিন কাজ না থাকলে খাব কী?"
আরও পড়ুন- রঘুরাম রাজনকে রাজ্যসভায় পাঠাচ্ছে আম আদমি পার্টি!
অন্যদিকে নোট বাতিলের পরপরই ভারত-কে 'ক্যাশলেস' করার জিগির তোলে কেন্দ্র। জোর দেওয়া হয় অনলাইন পেমেন্ট প্ল্যাটফর্মে। সমস্যায় পড়েন মূলত নগদ লেনদেনের ব্যবসায়ীরা। গাড়ি মেরামতকারী শুভঙ্কর ধারা বলেন, "নোট বাতিলের পর একমাস আমাদের কারখানা বন্ধ ছিল। এখন ব্যবসা ঠিকই চলছে। তবে, আমাদের নগদে বেশি কাজ হয়, সেই জায়গায় কিছু অসুবিধা হচ্ছে বৈকি!"
দেশ জুড়ে বিরোধীরা এই দিনটাকে কালো দিবস পালন করছে। বিজেপিও পাল্টা নেমেছে উল্লাস দিবস পালনে। তবে, কালো-উল্লাসের জাঁতাকলে যে উলু-খাগড়ার প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়ে উঠেছে, তা নিঃশ্চন্দেহে বলা যায়।